জুমবাংলা ডেস্ক : মোহাম্মদ হাবিব (ছদ্মনাম)। একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। চলতি বছরের মাঝামাঝি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি বিজ্ঞাপন তার নজরে আসে। বিজ্ঞাপনে বলা হয়, কক্সবাজারের নামিদানি রিসোর্ট বিনিয়োগের সুযোগ; যাতে ৯০ দিনে বিনিয়োগের দ্বিগুণ মুনাফা দেওয়া হবে। চাকরির পাশাপাশি বাড়তি উপার্জন আসবে এমনটি ভেবে ‘গোল্ডেন রিচ’ নামের ওই অ্যাপসে বিনিয়োগ করেন। পরে বুঝতে পারেন তিনি প্রতারণার ফাঁদে পড়েছেন। বিষয়টি উল্লেখ করে মিরপুর থানায় একটি মামলা করেন। হাবিবের মতো বরগুনার শাহজালাল, ঝালকাঠির মুরাদসহ আরও অনেকে কথিত রিসোর্ট ব্যবসায় বিনিয়োগ করে প্রতারিত হয়েছেন।
আইনশৃঙ্খলাবাহিনী বলছে, এই চক্রের মূলহোতা মিঠুন কুমার রায়। তিনি পাশ্ববর্তী দেশে বসে এই অ্যাপস চালাচ্ছিল। দুই দেশের নাগরিক এই মিঠুন। আর দেশে বসে তার হয়ে কয়েকজন কাজ করছিল। তাদের মধ্যে অন্যতম- রিয়াজুল ইসলাম ফকির, তরিকুল ইসলাম ও তাজিরুল ইসলাম। যারা ভারতে গিয়ে অ্যাপস উদ্বোধন অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছিল। পরে দেশে ফিরে বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে সাড়ে পাঁচ হাজারের বেশি বিনিয়োগকারী তৈরি করেছিল। আর তাদের কাছ থেকে হাতিয়ে নিয়েছে কয়েক কোটি টাকা। যার বেশির ভাগ গুপ্তমুদ্রা বা ক্রিপ্টোকারেন্সির মাধ্যমে বিদেশে পাচার করা হয়েছে।
এই অ্যাপের বিনিয়োগকারী ঝালকাঠির নয়ন। তিনি স্থানীয় একটি কোম্পানিতে চাকরি করেন। ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘স্থানীয় একজনের মাধ্যমে অ্যাপসটির খবর পাই। এরপর গুগল প্লে-স্টোর থেকে অ্যাপসটি নিজের মোবাইলে ডাউনলোড করি। পরে বিকাশের মাধ্যমে তাদের দেওয়া একটি বিকাশ নম্বরে ২৫ হাজার টাকা দিই। তিনমাস অপেক্ষা করার পর দেখি অ্যাপসে আর প্রবেশ করতে পারছি না। তখন বুঝলাম প্রতারণার ফাঁদে পড়েছি।’
অনেকে নয়নকে বলেছিল এখানে বিনিয়োগ না করতে। তারপরও তিনি সেখানে বিনিয়োগ করেন। এটা ভুল হয়েছে উল্লেখ করে নয়ন বলেন, ‘ভাবছিলাম নতুন কোম্পানি। ৯০ দিন অপেক্ষা করার পর যদি দ্বিগুণ হয়, তাই রিস্ক নিয়েছি।’
রাজধানীর মিরপুরের বিনিয়োগকারী মোহাম্মদ হাবিব। ঢাকাটাইমসকে তিনি বলেন, ‘কক্সবাজারের রিসোর্টে বিনিয়োগের বিজ্ঞাপন দেখেই মূলত সেখানে টাকা লগ্নি করি। তবে এভাবে ফাঁদে পড়ব বুঝতে পারিনি।’
‘তাদের স্কিম ছিল আপনি যে বিনিয়োগ করবেন, তার দ্বিগুণ মুনাফা ফেরত দেওয়া হবে। পাশাপাশি যাদেরকে অ্যাপসে বিনিয়োগ করাবেন সেখান থেকেও কিছু কমিশন পাওয়া যাবে। ধাপে ধাপে সেখান থেকে আরও বিভিন্ন অফারে টাকা পাওয়ার সুযোগ ছিল।’
শনিবার ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) এডিসি জুনায়েদ আলম সরকার ঢাকা টাইমসকে জানিয়েছেন, প্রথমে গুগল প্লে স্টোর থেকে গোল্ডেন রিচ নামে অ্যাপস নামিয়ে সেখানে অ্যাকাউন্ট খুলতে হয়। এরপর সেখানে থাকা ইলেক্ট্রনিক্স পণ্য কিনতে হয়। এসব পণ্যই একজন ক্রেতার বিনিয়োগ। যা পরবর্তীতে বিক্রি করে অর্জিত মুনাফা থেকে লভ্যাংশ দেবার কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু সেটা কোনো বিনিয়োগকারী পাননি। এরপরই তাদের প্রতারণার বিষয়টি প্রকাশ্যে আসে। গত নয় মাসে এই অ্যাপসের মাধ্যমে হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে ২০ থেকে ৩০ কোটি টাকা।
ডিবি পুলিশ জানিয়েছে, এই অ্যাপসটির প্রধান উদ্যোক্তা এখন পলাতক। তিনি দেশে আছেন নাকি পাশ্ববর্তী দেশে পালিয়ে গেছেন সেটার খোঁজ চলছে। তবে চক্রের প্রধান তিনজনকে গ্রেপ্তার করা গেছে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তারা জানিয়েছে, এই অ্যাপসের মাধ্যমে তারা অনেক বিনিয়োগকারী পেয়েছে। ৯০ দিনে বিনিয়োগের টাকা দ্বিগুণ ফেরত পাবার বিজ্ঞাপনে অনেকে সেখানে বিনিয়োগ করে। কক্সবাজার, কুয়াকাটা ও ভারতে রিসোর্ট কেনার প্রলোভনে এই বিনিয়োগ করানো হয়।
যেসব প্রলোভন
সূত্র বলছে, একজন গ্রাহক অ্যাপসটি সাইনআপ করে একহাজার টাকা দিয়ে একটি রোবট কিনতে পারত। যা তিনমাসের ভিতরে দুইহাজার টাকা হবে বলে জানানো হতো। তাছাড়া আইডির রেফারেন্স কোড নিয়ে অন্যজন আইডি খুললে ২০০ টাকা অটো বোনাস পাবে এবং পরের জনের
রেফারেন্স নিয়ে নতুন আইডি খোলা হলে সেও ১০ লেভেল পর্যন্ত ১০ টাকা করে পাবে। এছাড়া এজেন্ট, কান্ট্রি ম্যানেজার ও ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডরা গ্রাহকদের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করে সরাসরি অ্যাপের মূলহোতা মিঠুন কুমার রায়ের দেওয়া ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ডিপোজিট করতো।
পরবর্তীতে মিঠুন কুমার রায় জানায়, সে এজেন্ট, কান্ট্রি ম্যানেজার ও ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডরদের জিবি কয়েন নামে একটি ভার্চুয়াল মুদ্রা চালু করবে। এই ভার্চুয়াল মুদ্রা অনলাইনে ছাড়ার জন্য মিঠুন কুমার ভারতে উদ্ভোধনী অনুষ্ঠান করে। যাতে বাংলাদেশ থেকে ১০/১২ জন অনুষ্ঠানে যোগ দেয়।
কে এই মিঠুন কুমার
মিঠুন সর্বপ্রথম ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ‘এসপিসি ওয়ার্ল্ড এক্সপ্রেস’ এর এজেন্ট ছিলেন। সেখানে কাজ করার সময় বিভিন্ন এজেন্টের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। পরবর্তীতে তিনি ‘গোল্ডেন রিচ’ অ্যাপ চালু করে। গ্রাহকের যে টাকা এজেন্টের কাছে আসত তা মিঠুন কুমার নিজের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নম্বরে ও মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসের মাধ্যমে সংগ্রহ করত। এই অর্থ পাবার পর অ্যাপসের ওয়ালেটে নির্দিষ্ট পরিমাণ পয়েন্ট দেখানো হতো। কিন্তু কোনো গ্রাহক তার আইডি থেকে ওই পয়েন্টের মাধ্যমে টাকা উত্তোলন করতে পারত না। কারণ সবকিছুই তার হাতে ছিল। ডিবি বলছে, তদন্তে পাওয়া গেছে, মিঠুন কুমার বাংলাদেশ ও ভারতের নাগরিক। দেশের এনআইডিতে তার বাবার নাম বৈদনাথ রায়। আর ভারতের এনআইডিতে বাবার নাম নিমাই রায়।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।