সাইফুল ইসলাম, মানিকগঞ্জ: দীর্ঘ ২০ বছর ফেরি চলাচল বন্ধ থাকার পর চলতি বছরের শুরুর দিকে আরিচা ঘাটে ফের ফেরি চলাচল শুরু হয়। ফেরি চলাচল শুরু হওয়ার পর থেকেই অনিয়মের আখড়ায় পরিণত হয়েছে দীর্ঘদিন পর সচল হওয়া এই ঘাটটি। ফেরির টিকিট কাটা থেকে শুরু করে ফেরিতে গাড়ি উঠা পর্যন্ত নানা ধরনের ভোগান্তী পোহাতে হয় গাড়ি চালকদের । সরকার নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে বেশি টাকা না দিলে মেলেনা ট্রাকের টিকিট। আর ফেরিতে উঠতে স্থানীয় দালাল চক্রের হয়রানির শিকার হতে হয় ছোট বড় সব ধরনের গাড়ি চালকদের।
জানা গেছে, মানিকগঞ্জের আরিচা থেকে পাবনার কাজিরহাট পর্যন্ত ফেরি পারাপারে বড় ট্রাকের ভাড়া ১৮৫০ টাকা, মাঝারি ট্রাকের ভাড়া ১৪০০ টাকা,ছোট ট্রাকের ভাড়া ১০৮০ টাকা, ডেলিভার ভ্যানের ভাড়া ৯৮০ টাকা, পিক আপ ও বড় জীপের ভাড়া ৯২০ টাকা প্রাইভেট কারের ভাড়া ৬৮০ টাকা ও মোটর সাইকেলের ভাড়া ১০০ টাকা। প্রইভেট কার ও মোটর সাইকেলের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত টাকা না নিলেও ছোট বড় সব ধরনের ট্রাকের টিকিট কাটতে অতিরিক্ত টাকা দিতে হয় চালকদের। কখনো কখনো টিকিট দেওয়ার সময় ট্রাক চালকদের কাছ থেকে গাড়ি প্রতি ১০০ টাকা থেকে শুরু করে ৫০০ বা ১০০০ টাকা পর্যন্ত বেশি নেয় বিআইডব্লিউটিসির আরিচা শাখার টিকিট কাউন্টারে থাকা কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। অতিরিক্ত টাকা না দিলে টিকিট পেতে নানা ধরনের হয়রানি করা হয় ট্রাক চালকদের। এছাড়া গাড়ি নিয়ে ফেরিতে উঠতে চাইলে স্থানীয় দালালদের টাকা দিতে হয়। দালালরা টাকা নিয়ে পেছনে আসা গাড়িকে ফেরিতে আগে উঠার বন্দোবস্ত করে দেয়। চালকদের অভিযোগ বিআইডব্লিউটিসির কর্মকর্তা-কর্মচারী ও পুলিশকে ম্যানেজ করেই সক্রিয় এই দালাল চক্র।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, আরিচা ফেরিঘাটে গাড়ির চাপ একটু বেশি হলেই চার থেকে পাঁচ জন করে কয়েকটি গ্রুপ বিভিন্ন গাড়ির চালকদের সাথে ফেরিতে আগে উঠানো নিয়ে দামাদামি করছে। প্রতিটি গাড়ি থেকে ১০০ থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত নিয়ে সিরিয়ালে পেছনে থাকা গাড়ি ভিন্নপথে ঘুরিয়ে ফেরির পন্টুনের সামনে পৌছে দেয়। আর সিরিয়াল অমান্য করে পেছনে থেকে পন্টুনের সামনে আসা গাড়ির টিকিটও দেওয়া হয় ফেরির পন্টুনের সামনে থেকে অথবা ফেরিতে উঠার পর। অপরদিকে, বিআইডব্লিউটিসির আরিচা ঘাটের টিকিট কাউন্টারের সামনে গাড়ি চালকদের টিকিট কাটার লাইনে গিয়ে দেখা যায় প্রতিটি গাড়ি থেকে নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে অতিরিক্ত টাকা নেওয়া হচ্ছে। অতিরিক্ত টাকা দিতে না চাইলে ট্রাক চালকদের নানাভাবে হয়রানি করা হয়।
ফেরি পারের অপেক্ষায় থাকা ট্রাক চালক চালক সাইজুদ্দিন বলেন, ফেরির টিকিট কাটতে গিয়েও বেশি টাকা দিতে হয়। আবার ফেরিতে আগে উঠতে হলেও দালালদের মাধ্যমে টাকা দিয়ে ফেরিতে উঠতে হয়। দালালদের টাকা না দিলে ফেরিঘাটে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকতে হয়।
সিরিয়াল অমান্য করে পেছন থেকে পন্টুনের সামনে আসা আরেক ট্রাক চালক আব্দুর রহিম বলেন, ফেরিঘাটে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকার চেয়ে দুইশ বা তিনশ টাকা দিয়ে আগে যাওয়া ভালো। এখানে বসে থাকলেও তো অনেক টাকা খরচ হয়। তার চেয়ে ভালো দালালদের ২০০ টাকা দিয়ে অন্য পথ দিয়ে ঘুরে সামনে এসেছি।
আরেক ট্রাক চালক মোহাম্মদ আলী বলেন, আমার বড় গাড়ি। আমার গাড়ির টিকিটের দাম ১৮৫০ টাকা হলেও কাউন্টার থেকে ২১০০ টাকা নিয়েছে। অতিরিক্ত টাকা না দিলে কাউন্টারের লোকজন ফেরির টিকিট দেয়না। তাই বাধ্য হয়েই বেশি টাকা দিয়ে টিকিট নিয়েছি।
স্থানীয় দালাল মিঠু ও আকাশ বলেন, আমরা সবসময় ঘাটেই থাকি। কিছু কিছু গাড়ি পেছন থেকে ফেরির পন্টুনের সামনে নিয়ে দেই। এতে ড্রাইভাররা খুশি হয়ে আমাদের ২০০ বা ৩০০ করে টাকা বখশিস দেয়। বিআইডব্লিউটিসির লোকজন অথবা পুলিশ দেখলে কোন সমস্যা হয় কি’না জানতে চাইলে তারা বলেন, বিআইডব্লিউটিসির লোকজন অথবা পুলিশ আমাদের কিছুই বলেনা। আমরা সবসময় ঘাটেই থাকি, তারা এটা জানে।
সরকার নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে অতিরিক্ত টাকা নেওয়ার কথা স্বীকার করে বিআইডব্লিউটিসি’র আরিচা শাখার টার্মিনাল সুপারিনটেনডেন্ট (টিএস) শাহীন উল্টো প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে বলেন, কোন ঘাটে বেশি টাকা নেয়না? সব ঘাটেই বেশি টাকা নেয়, আমরাও নেই। এখানে রাজনৈতিক নেতা, পুলিশ প্রশাসনের লোক ও সাংবাদিকসহ অনেকেই আসে। অসুবিধা নেই, একটু ধৈর্য্য ধরেন। ঘাটটা আরেকটু রানিং হলে যার যেটা প্রাপ্য সেটা পৌছে দিব।
এ ব্যাপারে বিআইডব্লিউটিসি’র আরিচা শাখার ব্যবস্থাপক আবু আবদুল্লাহ বলেন, এর আগে ঘাট এলাকা থেকে কয়েকজন দালালকে শিবালয় থানার ওসি সাহেব বিতারিত করেছিল। এখন দালাল আছে কি’না সেটা আমার জানা নেই। দালালরা যদি আবার এসে থাকে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। টিকিট কাউন্টারে তিনটি গ্রুপে কাজ করে। অতিরিক্ত টাকা নেওয়ার বিষয়ে আপনি যেহেতু অভিযোগ করলেন আমি তাদের সতর্ক করে দিব। তারপরও কেউ যদি অতিরিক্ত টাকা নেয় তার বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নিব।
এ বিষয়ে শিবালয় থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোঃ ফিরোজ কবির বলেন, ফেরির টিকিট দেওয়া থেকে শুরু করে গাড়ি ফেরিতে উঠা পর্যন্ত সবকিছু মেইনটেন করে বিআইডব্লিউটিসি কর্তৃপক্ষ। আমাদের কাজ সেখানে আইন-শৃঙ্খলা ঠিক রাখা। ফেরিঘাট এলাকা নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব বিআইডব্লিউটিসি কর্তৃপক্ষের। টিকিট কাউন্টারে বেশি টাকা নেওয়া বা বাইরের কেউ টাকা নিয়ে ফেরিতে আগে পরে গাড়ি উঠায় তাহলে এর জবাব বিআইডব্লিউটিসি কর্তৃপক্ষ দিবে। তবে এদের বিরুদ্ধে কেউ অভিযোগ দিলে আমি তাৎক্ষনিক ব্যবস্থা নিব।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।