জুমবাংলা ডেস্ক : গত ৬ জুলাই রাতে সাপে কামড়ায় টাঙ্গাইলের মির্জাপুরের আশিক খান (২৬) নামে এক যুবককে। পরদিন ভোরে তাকে আনা হয় ঢাকার একটি হাসপাতালে। সেখানেই রবিবার (৭ জুলাই) চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয় তার। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, সাপের বিষের প্রতিষেধক অ্যান্টিভেনম প্রয়োগ করেও তাকে বাঁচানো যায়নি। চিকিৎসকরা বলছেন, অ্যান্টিভেনম দিলেই যে সাপে কাটা রোগী বাঁচানো যাবে বিষয়টি এমন নয়। আর স্বাস্থ্য অধিদফতর বলছে, গত ছয় মাসে সাপে কাটার ফলে যে কয়টি মৃত্যু চিকিৎসাধীন অবস্থায় হয়েছে তার বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অ্যান্টিভেনম প্রয়োগ করা হয়েছিল। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠতে পারে, অ্যান্টিভেনম দিয়েও কেন সাপে কাটা রোগীদের বাঁচানো যাচ্ছে না কেন? এর জবাবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মূলত সাপে কাটা রোগীকে অ্যান্টিভেনম দেওয়ার পরও দেরিতে হাসপাতালে আনা কিংবা অন্যান্য শারীরিক অসুস্থতার কারণে বাঁচানো যাচ্ছে না।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের মতে, গত ছয় মাসে সাপে কাটার কারণে মৃত্যু হয়েছে ৩৮ জনের, আর সাপে কেটেছে ৬১০ জনকে। মৃত ব্যক্তিদের মধ্যে পুরুষ ৩৫ জন এবং নারী ৩ জন।
এর ওপর সম্প্রতি আতঙ্ক দেখা দিয়েছে রাসেলস ভাইপার (চন্দ্রবোড়া) সাপ নিয়ে। এই সাপের বিস্তৃতি, চিকিৎসা এবং অ্যান্টিভেনম নিয়েও জনমনে নানা প্রশ্ন আছে। প্রাথমিকভাবে রাজশাহী ও বরেন্দ্র অঞ্চলে এর প্রভাব বেশি দেখা গেলেও পরবর্তী সময়ে ধীরে ধীরে রাসেলস ভাইপারের বিস্তৃতি ২৭টি জেলায় ছড়িয়েছে বলে জানায় চট্টগ্রামের ভেনম রিসার্স সেন্টার।
রাসেলস ভাইপারে কাটা রোগীর প্রকৃত পরিসংখ্যান অজানা
রাসেলস ভাইপার সাপে কাটার এবং কাটার ফলে মৃত্যুর তথ্য শুধু রাজশাহী এবং ফরিদপুর থেকে পাওয়া গেছে। অন্যান্য জায়গা থেকে এই সাপে কাটার এবং মৃত্যুর তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদফতরের অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার লাইন ডিরেক্টর অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিন।
কেন পাওয়া যাচ্ছে না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমাদের কাছে শুধু রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজের তথ্য আছে। অন্যরা কিন্তু তথ্য সেভাবে দিতে পারছে না। কারণ, হয়তো তারা সাপ চেনার ক্ষেত্রে তেমন অভিজ্ঞ না। অন্যান্য জায়গা থেকে তাই তথ্য সেভাবে দিতে পারছে না। তাদের কাছে যে তথ্য আছে, সেগুলো কয়টা বিষধর সাপ, কিংবা কয়টা মৃত্যু হচ্ছে। মৃত্যু তো কোবরার কামড়ে হতে পারে, কেউটের কামড়েও হতে পারে, আবার রাসেলস ভাইপারের কামড়েও হতে পারে।’
১২ বছরে রাসেল ভাইপারের কামড়ে রাজশাহীতে মৃত্যু ৬৯
স্বাস্থ্য অধিদফতরের অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগের তথ্য বলছে, রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ২০১৩ সাল থেকে এই বছরের ১২ জুন পর্যন্ত ৬৯ জন রোগী রাসেলস ভাইপারের কামড়ে মারা গেছেন, আর দংশনের শিকার হয়েছেন ২৩৫ জন। আর সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে গেছেন ১৬৬ জন।
রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৩-২০২৪ এর মে মাস পর্যন্ত ২৩৫ জন রাসেল ভাইপার সাপে দংশনকৃত রোগী ভর্তি হয় এবং ৬৯ জনের মৃত্যু হয়, যা মোট আক্রান্তের ২৯ শতাংশ। এই সাপে কাটা রোগীদের ৫৩ শতাংশই চাঁপাইনবাবগঞ্জের বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতর।
এই বছরের জানুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত মোট ৪১৬ জন সাপে কাটা রোগী ভর্তি হয়েছেন। তার মধ্যে বিষধর সাপে কাটা রোগী ৭৩ জন। এদের মধ্যে ১৮ জনই রাসেল ভাইপারের দংশনের শিকার। ভর্তি হওয়া রোগীদের মধ্যে ১১ জন মারা গেছেন; যার মধ্যে রাসেলস ভাইপারের দংশনে মারা গেছেন ৫ জন।
অন্যদিকে এই বছর ফরিদপুরের ভাঙ্গা উপজেলা থেকে তিনটি সাপে কাটা রোগীর তথ্য এসেছে, যার মধ্যে একটি ছিল রাসেলস ভাইপারের কামড়ের ঘটনা। তবে সেই রোগী বর্তমানে সুস্থ আছেন বলেও জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতর।
অ্যান্টিভেনম দেওয়ার পরও সাপে কাটা রোগীকে বাঁচানো যাচ্ছে না কেন?
স্বাস্থ্য অধিদফতরের সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এম এ ফয়েজ বলেন, একজন সাপে কাটা রোগীকে অ্যান্টিভেনম দেওয়ার পরও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হতে পারে। আবার অ্যান্টিভেনম দেওয়ার আগেও রোগীর শ্বাসপ্রশ্বাস বন্ধ হয়ে মারা যেতে পারে। আমি এমন অনেক রোগী দেখেছি যে, যাদের হাসপাতালে আনার পর অ্যান্টিভেনম প্রয়োগের কিছুক্ষণের মধ্যেই মারা গেছেন। সাপে কাটা রোগীকে অ্যান্টিভেনম দেওয়ার একটি সময় আছে। সাপে কাটা রোগীদের অনেক সময় একেবারে শেষ মুহূর্তে চিকিৎসকের কাছে আনা হয়। সঠিক সময়ে অ্যান্টিভেনম না দিলে অ্যান্টিভেনম কাজ করে না।
তিনি আরও বলেন, রাসেলস ভাইপারের ক্ষেত্রে অন্যান্য বিষধর সাপের মতো শুরুতেই রোগীর শ্বাস-প্রশ্বাসে সমস্যা হয়। কাজেই প্রাথমিকভাবে সময়মতো অ্যান্টিভেনম দিয়ে তাকে অন্য হাসপাতালে রেফার করে বাকি চিকিৎসার প্রয়োজন আছে কিনা দেখতে হবে। অ্যান্টিভেনম বিষধর সাপের কামড়ের অন্যতম চিকিৎসা। ক্ষেত্রবিশেষে অ্যান্টিভেনম ছাড়াও আরও অন্যান্য চিকিৎসার প্রয়োজন হতে পারে। কোনও কোনও ক্ষেত্রে কৃত্রিম শ্বাস-প্রশ্বাস, ডায়ালাইসিস কিংবা রক্ত দেওয়ারও প্রয়োজন হতে পারে।
কোন সাপে কাটা রোগীর কখন অ্যান্টিভেনম দেওয়া জরুরি
অধ্যাপক ডা. এম এ ফয়েজ তার লেখা ‘সর্প দংশন ও এর চিকিৎসা’ নামে বইয়ে উল্লেখ করেছেন, গোখরো সাপের দংশনের গড়ে ৮ ঘণ্টা পর, কেউটে সাপের দংশনের গড়ে ১৮ ঘণ্টা পরে ও চন্দ্রবোড়া সাপের (রাসেলস ভাইপার) দংশনের গড়ে ৭২ ঘণ্টা বা তিন দিন পর রোগীর মৃত্যু হতে পারে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এই সময়ের মধ্যেই অ্যান্টিভেনম প্রয়োগ করা জরুরি। এরপর প্রয়োগ করলে তা কাজ নাও করতে পারে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সাপের কামড় বা দংশনের পরে দ্রুত অ্যান্টিভেনম ইনজেকশন দিলে এর অ্যান্টিবডিগুলো বিষকে নিষ্ক্রিয় করে। যার ফলে আক্রান্ত ব্যক্তির জীবন বা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ রক্ষা পেতে পারে। সাপ কামড়ানোর পর একজন রোগীকে ১০টি করে অ্যান্টিভেনম ইনজেকশন দিতে হয়। ১০টি ভায়াল মিলে একটি ডোজ হয়ে থাকে। বিষের পরিমাণ এবং বিষাক্ততার মাত্রা বেশি হলে সাপে কামড়ানো ব্যক্তির ওপর এক বা একাধিক ডোজ অ্যান্টিভেনম প্রয়োগ করার প্রয়োজন হতে পারে।
অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিন বলেন, ‘আমাদের কাছে যেসব সাপে কাটা রোগী আসে তাদের অনেকেরই স্নায়ুতন্ত্রে সমস্যা হয়, কারও কারও রক্তক্ষরণ হয়। তাদের মধ্যে কিন্তু নানা জটিলতা দেখা দেয়। যেমন অনেকেরই স্নায়ুতন্ত্রের জটিলতার কারণে প্যারালাইজড হয়ে শ্বাসপ্রশ্বাস বন্ধ হয়ে যেতে পারে। তখন অ্যান্টিভেনম দেওয়া হলে রক্ত প্রতিস্থাপন করতে পারবে, কিন্তু শ্বাস-প্রশ্বাস তো আর ঠিক করতে পারবে না। তখন তাদের জন্য কৃত্রিম শ্বাস প্রশ্বাসের ব্যবস্থা করার প্রয়োজন হয়। আমাদের মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে যেসব মৃত্যু হয়েছে, তার বেশিরভাগই অ্যান্টিভেনম পাওয়া। তার মানে হচ্ছে অ্যান্টিভেনম একমাত্র জিনিস না, যেটি প্রয়োগে সঙ্গে সঙ্গে সুস্থ হওয়া যাবে।
তিনি আরও বলেন, একইভাবে আমরা দেখেছি যে রাসেল ভাইপারের কামড়ে যেসব রোগী আসেন, তাদের অনেক বেশি পরিমাণে রক্তক্ষরণ হয়। অনেকের কিডনির সমস্যা দেখা দেয়। অ্যান্টিভেনম দেওয়ার পরও আমরা দেখি যে, কিডনির সমস্যা বাড়তে থাকে। সেজন্য অনেক ক্ষেত্রে অ্যান্টিভেনম দেওয়ার পরও রোগীর জটিলতা তৈরি হয়। রোগীর নিবিড় পরিচর্যার (আইসিইউ) দরকার হয় এবং পরবর্তী সময়ে আমরা রোগী মারা যেতেও দেখেছি।
সারা দেশে ১৬ হাজার ভায়াল অ্যান্টিভেনম বিতরণ
স্বাস্থ্য অধিদফতরের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, রাসেল ভাইপারে কাটা রোগীর জন্য কার্যকর অ্যান্টিভেনম আছে। চাহিদার প্রেক্ষিতে সারা দেশে ১৬ হাজার ভায়াল অ্যান্টিভেনম ইতোমধ্যে বিতরণ করা হয়েছে বলে জানিয়েছে অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিন। শিগগিরই আরও ৪ হাজার ভায়াল সরবরাহ করা হবে।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য বলছে, একটি ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানির কাছ থেকে ২০ হাজার ভায়াল অ্যান্টিভেনম কিনেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। সাধারণত প্রতি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ২০ ভায়াল, জেলা হাসপাতালে ৫০ ভায়াল ও মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ১০০ ভায়াল করে দেওয়া হয়। এছাড়া চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে সরবরাহ করা হয়। বিষধর সাপে কাটা প্রতি রোগীকে এক ডোজ অ্যান্টিভেনম প্রয়োগ করতে হয়। সাপ কামড়ানোর পর একজন রোগীকে ১০টি করে অ্যান্টিভেনম ইনজেকশন দিতে হয়। ১০টি ভায়াল মিলে একটি ডোজ হয়ে থাকে।
গত অর্থবছরে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) মাধ্যমে ১০ হাজার ভায়াল অ্যান্টিভেনম সহায়তা পাওয়া গেছে। এ বছরও ডব্লিউএইচওর কাছ থেকে ১০ হাজার ভায়াল অ্যান্টিভেনমের চাহিদাপত্র দেওয়া হয়েছে। সূত্র : বাংলা ট্রিবিউন
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।