রাতের ‘রঙিন’ শহর বলে পরিচিত নেদারর্যান্ডের রাজধানী আমস্টারডাম। করোনা আতঙ্কে থেমে গেছে শহরের সব কোলাহোল। আমস্টারডামে লকডাউনের পাঁচ সপ্তাহ হতে চললো। আমি করোনার জেরে আমস্টার়ডামে ঘরবন্দি বাঙালি, আলু আর ডিমের সংখ্যা দিয়ে বাকি দিনগুলোকে ভাগ করতে করতে বিষন্ন মনে কর্ণফ্লেকের কৌটোটার দিকে তাকিয়ে থাকি। আজ ভাগ্যের ফেরে, চোখের সামনে ব্রেকফাস্ট বলতে, চামচ দিয়ে মেপে তোলা কর্নফ্লেক্স আর পানিতে গুলানো কনডেন্সড মিল্ক। অবশ্য কত লোকে তো খেতেই পাচ্ছে না সেই হিসেবটাও জানি! আর হ্যাঁ আমাদের স্বেচ্ছাবন্দিত্বই আমাদের জিয়নকাঠি, এত দিনে এটুকু বুঝে গিয়েছি। কাজেই খাবারের বিলাসিতাটাও আস্তে আস্তে চলে যাচ্ছে।
সকালে আফিসের হাজিরা মিটিং শেষ হয়েছে কিছুক্ষণ। আমার ম্যানেজার দু’দিন হলো মিটিংয়ে আসছে না। বলেছে শরীরটা ভালো নয় – জ্বর জ্বর। জানি না কী হবে! কর্নফ্লেক্সটা গিলে নিয়ে কাজে বসলাম। আমাদের টিমখানা আবার একটু বেশিই ছড়ানো- আমস্টারডাম, অক্সফোর্ড আর চেন্নাই। শূন্য-দশকের প্রযুক্তির ম্যাজিকে, রিমোট ওর্য়াকিং এখন পানিভাত। অথচ, কী অদ্ভুত, এত কিছু প্রযুক্তি, বিজ্ঞান, হেড্রন কোলাইডার, গুগুল এআই এতকিছুর পরও – আমরা একটা পুঁচকে ভাইরাসের সাথে যুদ্ধে জিততে পারছি না। আটকে থাকতে হচ্ছে ঘরে। কারণ এবার ক্যারিয়ার – রোডেন্টস নয়, মাছি নয়, মশা নয় – মানুষ।
নেদারল্যান্ডসে করোনার গল্পটা খুব সুবিধের নয়। এ লেখা যখন লিখছি তখন পর্যন্ত মোট আক্রান্ত ২০ হাজার ৫৪৯ জন। মৃত অন্তত ২২৫০জন। সরকারি হিসেবে সংখ্যাটা, আপামর জনতার হিসাবে এটা বেশ খানিকটা বেশি। প্রথম দেড়-দু’সপ্তাহ অবহেলা করার খেসারত দিচ্ছে ওলন্দাজরা। মোবাইলে করোনার অ্যালার্ট আসছে। জ্বর গলা ব্যথার সিম্পটম হলেই নির্দেশ আছে, জিপি-কে (আপনি যেই ডাক্তারের কাছে নথিভুক্ত) ফোন করার। কিন্তু যাওয়ার দরকার নেই। ওরা রাস্তায় নেমে দাঁড়িয়ে আছে আমাদের বাঁচাতে। ডিপার্টমেন্টাল স্টোরগুলোতে – পাঁচ হাত ফাঁকা দিয়ে লোকেরা দাঁড়িয়ে। জিনিসপত্রের আকাল এখনও হয়নি। তবে, রাস্তাঘাটের এই নির্বাক শূন্যতা মেনে নিতে কষ্ট হয়।
এখন যারা ঈশ্বর চুপ, বিজ্ঞান জেগে বলে কলার তুলছেন, তাদের যদি ডারউইন থেকে কোট করি – দিস ইজ ন্যাচারাল সিলেকশান। একেকটা অ্যাম্বুলেন্স যায় আর আমি ভাবি এর পরেরটা কি আমার ঘরে! হাতটা ফোনে চলে যায় – ডায়ালিং – মা।
সময়টা অদ্ভুত। ঘরবন্দি কতগুলো মানুষ আবার সব কিছু ঠিক হয়ে যাবার আশায়। আর এদিকে, কিছুক্ষণ পরপর অ্যাম্বুলেন্সের শব্দ। জানি না কী হবে! কিন্তু আশায় বাঁচি, একদিন এই বিপদ কেটে যাবে, আবার সব স্বাভাবিক হয়ে যাবে । আর সে দিন উৎসবে মেতে উঠলে একবার ভেবে দেখবেন এত দিন, এত সাবধানতা, এত ভয় আর সব ঠিক হবার আনন্দ এসব কি জন্যে ছিল? একটা পুঁচকে ভাইরাসের জন্য না-কি আপনার, আমার, আর সবার ভেতর ধুকপুক করে চলতে থাকা একটা অদ্ভুত ছন্দ, তার নাম জীবন। উত্তরটা যদি দ্বিতীয়টা হয় তাহলে আরেকবার মারামারি কাটাকাটি করার আগে ভেবে দেখবেন।
সূত্র- আমস্টারডামে বন্দি বাঙালি বিজ্ঞানী উৎসব বর্মনের ডায়েরি থেকে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।