সজীব হোম রায় : স্বাধীনতার পর থেকে মোট ১১ বার আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছে ঋণ চেয়েছে বাংলাদেশ। প্রতিবার ঋণের ক্ষেত্রেই আইএমএফ কঠিন শর্ত জুড়ে দিয়েছে। তবে এবার সংস্থাটির কাছে শর্তের বিষয়ে ছাড় আশা করেন অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। বিশেষ করে শর্ত হিসেবে ব্যাংকের সুদের হার ৯ শতাংশ থেকে বাড়ানোর পক্ষে নয় অর্থ মন্ত্রণালয়।
জাতীয় সঞ্চয়পত্র বিক্রির অর্থ বাজেট থেকে আলাদা করার পক্ষে আইএমএফ। তারা বলছে, এটা আলাদা করলে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে ব্যয় বাড়িয়ে বেশিসংখ্যক গরিব মানুষকে সহযোগিতা করা সম্ভব হবে।
কিন্তু সরকার মনে করে, সঞ্চয়পত্র সামাজিক সুরক্ষার অংশ। নিম্ন ও মধ্যবিত্তদের জন্য এটা চালু করা হয়েছে। এ নীতিতে কোনো পরিবর্তন আনা ঠিক হবে না। আগামী মাসে অনুষ্ঠেয় সভার জন্য এভাবেই প্রস্তুতি নিচ্ছে বাংলাদেশ।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরের জুলাই মাসে আইএমএফের কাছে ৪৫০ কোটি ডলার ঋণ চায় সরকার। আগামী ১০ থেকে ১৬ অক্টোবর আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের বার্ষিক সম্মেলন হবে যুক্তরাষ্ট্রে। ওই সম্মেলনে বাংলাদেশকে ঋণ দেওয়ার বিষয়টি চূড়ান্ত করবে আইএমএফ।
আইএমএফ যদি সরকারের এ অবস্থানে সন্তুষ্ট না হয়, তাহলে ঋণ পাওয়া নিয়ে সমস্যা হতে পারে। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশ আইএমএফের রেজিলিয়ান্স অ্যান্ড সাসটেইনেবিলিটি ট্রাস্ট (আরএসএফটি) তহবিল থেকে ১৫০ কোটি ডলার ঋণ চাইবে। এ তহবিল থেকে ঋণের ব্যাপারে আইএমএফ কঠিন কোনো শর্ত দেয় না। ঋণের মেয়াদ ২০ বছর। আর গ্রেস পিরিয়ড ১০ বছর।
গত মাসে আইএমএফের এশীয় প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলের বিভাগীয় প্রধান রাহুল আনন্দের নেতৃত্বে একটি দল ঢাকা সফর করেছে। তারা ভর্তুকি কমানো, রাজস্ব খাতে সংস্কার, বাজেট থেকে সঞ্চয়পত্রকে আলাদা করা, বেঁধে দেওয়া ঋণের সুদের হার (৯ শতাংশ) তুলে দেওয়া, নগদ ও ঋণ ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা আনা, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকসহ ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ কমানো, ব্যাংক খাতে সুশাসন নিশ্চিত করা ও নজরদারি বাড়ানোসহ ব্যাংকগুলোর নিরাপত্তা সঞ্চিতি বিলম্বে সংরক্ষণের যে সুযোগ দেওয়া হচ্ছে, তা বন্ধ করার পরামর্শ দিয়েছে।
আইএমএফের জন্য প্রতিবেদন তৈরি করছে সরকার : ঋণ পেতে সরকারের প্রস্তুতি এবং অর্থনীতির স্থিতিশীল অবস্থার সার্বিক চিত্র তুলে ধরা হবে এই প্রতিবেদনে। এরই মধ্যে ভর্তুকি কমাতে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হয়েছে। কৃষির ভর্তুকি কমাতে সারের দাম বাড়ানো হয়েছে। বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর পথেও হাঁটছে সরকার।
যদিও আইএমএফের ঋণ পাওয়ার জন্য ভর্তুকি কমানো হচ্ছে—এ কথা মানতে নারাজ সরকার। বৈশ্বিক পরিস্থিতির কারণে দাম সমন্বয় করা হচ্ছে—বলে সরকার আসছে। তবে অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, আইএমএফের জন্য তৈরি করা প্রতিবেদনে ভর্তুকি কমানোর এই চিত্র থাকবে।
প্রতিবেদনে রাজস্ব আদায় বাড়াতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়েছে বলে জানানো হবে। বলা হবে, বড় করদাতাদের দিকে নজর দেওয়ার পাশাপাশি করের আওতা বাড়ানো হবে। আর মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) হারের কাঠামো সহজ করা এবং কর প্রশাসন আধুনিক করার মতো বিষয়গুলো চলতি অর্থবছরের বাজেটেই আছে। ধীরে ধীরে সেগুলো বাস্তবায়নে সরকারের যে পরিকল্পনা আছে, তা-ও বলা হবে আইএমএফকে।
ব্যাংক খাতে নজরদারি বাড়ানোসহ সার্বিক বিষয় তদারক করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ তদারকি আরো বাড়ানোসহ খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নানা উদ্যোগের কথাও বলা হবে প্রতিবেদনে। এমনটিই জানিয়েছেন অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা আশা করছেন, সরকারের এসব উদ্যোগে সংস্থাটি সন্তুষ্ট হবে। ওয়াশিংটনের আলোচনা সফল হলে সরকারের পক্ষ থেকে আইএমএফের জন্য একটি লেটার অব ইনটেন্ড বা ইচ্ছাপত্র তৈরি করা হবে। এতে কোন পরিস্থিতিতে সরকার ঋণ নিতে চায় এবং কী কী শর্ত পূরণ করতে চায়, তা বলা থাকবে। ইচ্ছাপত্রটি আইএমএফের পর্ষদে উঠবে। পর্ষদ অনুমোদন করলে মিলবে কাঙ্ক্ষিত ঋণ।
আইএমএফের সব শর্তে ‘হ্যাঁ’ নয় : আইএমএফের সব ঋণই শর্তযুক্ত হয়। বেশির ভাগ শর্ত থাকে সংস্কারমূলক। তবে কিছু শর্ত থাকে নীতিগত। অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, দেশের অর্থনীতির জন্য যেসব শর্ত ভালো, সেগুলো মেনে নিতে আপত্তি নেই। তবে এমন কোনো শর্ত মানা হবে না, যাতে অর্থনীতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। তবে যেসব শর্ত মানা হবে না সেগুলোর পক্ষে যুক্তি তুলে ধরা হবে।
সুদহার : রাহুল আনন্দের নেতৃত্বে আসা প্রতিনিধিদলটি ব্যাংকের চলমান সুদের হার (৬, ৯ শতাংশ) তুলে দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছিল। এই শর্তের ব্যাপারে একমত নয় অর্থ মন্ত্রণালয়। তারা মনে করে, সুদহার বাড়ালে বেসরকারি বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হবে। সুদহার সহনীয় থাকায় কভিডের পর দেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়িয়েছে। সম্ভাব্য অর্থনৈতিক মন্দায়ও বেঁধে দেওয়া সুদহার ভূমিকা রাখবে বলে আশা সরকারের।
২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ঋণ ও বিনিয়োগের সর্বোচ্চ সুদের হারে এক অঙ্ক কার্যকর করার ঘোষণা দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। ওই বছরের ১ এপ্রিল থেকে তা কার্যকর করা হয়।
সঞ্চয়পত্র : জাতীয় সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে সরকার যে অর্থ সংগ্রহ করে তা বাজেট থেকে আলাদা করার পক্ষে আইএমএফ। আইএমএফের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, বাজেটে এটা রাখা হয় সামাজিক নিরাপত্তা খাতের ব্যয় বড় করে দেখানোর জন্য। কিন্তু সঞ্চয়পত্র বিক্রির অর্থ আলাদা করতে পারলে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে ব্যয় বাড়িয়ে বেশিসংখ্যক গরিব মানুষকে সহযোগিতা করা সম্ভব হবে।
বাংলাদেশ সরকার মনে করে, সামাজিক সুরক্ষায় সঞ্চয়পত্র রাখার বিদ্যমান নীতি ঠিকই আছে। সঞ্চয়পত্র সামাজিক সুরক্ষার অংশ। সঞ্চয়পত্র নিম্ন ও মধ্যবিত্তদের জন্য চালু করা হয়েছে। তাই এ নীতিতে কোনো পরিবর্তন আনা ঠিক হবে না।
আর্থিক ব্যবস্থাপনার সংস্কার : আর্থিক ব্যবস্থাপনার সংস্কার চায় আইএমএফ। অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া। প্রয়োজন অনুসারে সময়ে সময়ে এতে সংস্কার আনা হয়। সুতরাং এর জন্য শর্তের প্রয়োজন নেই।
আইএমএফের সাবেক কর্মকর্তা ও পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, আইএমএফের ঋণ সব সময়ই শর্তযুক্ত হয়। আইএমএফ সব সময় চায় অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা ভালো হোক, যাতে ঋণ গ্রহণকারী দেশ ঋণ পরিশোধ করতে পারে। সে জন্য শর্ত দেয়। তবে আইএমএফের সব শর্ত মানতে সরকার বাধ্য নয়।
১১ বার ঋণ চেয়েছে বাংলাদেশ : আইএমএফের কাছ থেকে বাংলাদেশ প্রথম ঋণ নিয়েছিল ১৯৭৪ সালে। মোট ১০ বার ঋণ নিয়েছে বাংলাদেশ। ১৯৮০ থেকে ১৯৯০ সাল—এই ১০ বছরে বেশিবার ঋণ চাওয়া হয়েছে। এ সময়ে পাঁচবার ঋণ দিয়েছে আইএমএফ। প্রতিবারই ঋণ নিতে শর্ত পূরণ করতে হয়েছে। সর্বশেষ চলতি বছর আবারও সংস্থার কাছে ঋণ চেয়েছে সরকার।
১৯৯১ থেকে ২০০২ সাল পর্যন্ত ১১ বছর বাংলাদেশ আইএমএফের কাছ থেকে কোনো ঋণ নেয়নি। ২০০৩ সালে বাংলাদেশ আবার আইএমএফের কাছ থেকে ঋণ নেয়। সেবার বড় শর্ত ছিল, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোর লোকসান কমিয়ে আনতে হবে। আইএমএফের সেই শর্ত মেনে আদমজী পাটকল বন্ধ করে দিয়েছিল তখনকার সরকার।
সর্বশেষ ২০১২ সালে আইএমএফের কাছ থেকে এক বিলিয়ন ডলার ঋণ নিয়েছিল সরকার। সে সময় করনীতির কিছু সংস্কারের শর্ত দিয়েছিল সংস্থাটি। নতুন ভ্যাট আইন প্রণয়ন এরই অংশ। সূত্র : কালের কণ্ঠ
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।