জুমবাংলা ডেস্ক : তথ্যপ্রযুক্তি খাতে কর অব্যাহতির বিষয়ে ধোঁয়াশা কাটলেও আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সসহ (এআই) সব খাতে প্রযুক্তির ব্যবহার দেখতে চান সংশ্লিষ্টরা।
আগামী জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট দিচ্ছন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। বাজেটের আকার হতে পারে ৭ লাখ ৯৬ হাজার ৯০০ কোটি টাকা। এতে রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হতে পারে ৫ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকা।
বাজেটে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) থেকে রাজস্ব আদায় হবে ৪ লাখ ৭৬ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। মোট ঘাটতি থাকার আশঙ্কা আছে ২ লাখ ৫০ হাজার ৪০০ কোটি টাকা, যা পূরণ করতে আবারও হয়তো বিদেশি ঋণের ওপরই নির্ভর করতে হবে সরকারকে।
তবে প্রযুক্তিখাতের কোন কোন বিষয়ের ওপর সরকারের বেশি দৃষ্টি দেয়া উচিত, তা নিয়ে রয়েছে নানান আলোচনা। এসব আলোচনার মধ্যে যুক্তি মেলানোর চেষ্টা করেছেন দেশের নীতিনির্ধারক পর্যায়ের প্রযুক্তিবিদ ও অর্থনীতি বিশ্লেষকসহ সাধারণ মানুষ।
কর অব্যাহতি ও পলিসি সহায়তা প্রসঙ্গ
বেশ কয়েক মাস ধরে আলোচনা চলছিল তথ্যপ্রযুক্তি খাতের কর অব্যাহতি প্রসঙ্গ নিয়ে। এ খাতের ২৭ ধরনের সেবার ওপর দীর্ঘদিন ধরে দিয়ে আসা কর অব্যাহতি ২০২৪-২৫ বাজেট থেকে প্রত্যাহার করার পরিকল্পনা করেছিল জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। তবে এসব খাতের কর অব্যাহতি তুলে নিলে প্রযুক্তিখাত বিশ্ববাজারে হোঁচট খেতে পারে এমন দাবি করে আসছিলেন খাত সংশ্লিষ্টরা।
দেশের তথ্যপ্রযুক্তি ও সফটওয়্যার খাতের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস (বেসিস)-সহ একাধিক সংগঠন বিভিন্ন আলোচনা এবং সম্মেলনে বারবার দাবি রেখে আসছিল কর অব্যাহতি বহাল রাখার ব্যাপারে।
এ প্রসঙ্গে সংগঠনটির সভাপতি রাসেল টি আহমেদ সোমবার (২০ মে) এক আলোচনায় বলেন, এ খাতে ৫ হাজার কোটি টাকা ইন্ডাস্ট্রি লাভ করে বলে এনবিআর দাবি করে। তবে তাদের দেখানো এ অংকের মধ্যে অসামাঞ্জস্য রয়েছে। পাশের দেশ ভারতও বিভিন্ন প্রণোদনা দিয়ে এ খাতকে এগিয়ে নিয়ে চলেছে। তাছাড়া এখাতে যেসব দেশীয় প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা রয়েছে, তাদেরকে বিদেশি প্রতিষ্ঠানের চাইতে বেশি প্রাধান্য দেয়ার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।
তার এ বক্তব্যের সঙ্গে একই দিনে একাত্মতা প্রকাশ করেন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশনের (এফবিসিসিআই) সভাপতি মাহবুবুল আলম। তিনি কর অব্যাহতি এবং খাতসংশ্লিষ্ট দেশীয় ব্যবসায়িক শ্রেণিকে বিশেষ সুবিধা দেয়ার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।
ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্য প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক এ বিষয়ে এক আয়োজনে বলেন, দেশের সফটওয়্যার খাত এখন বিশ্বমঞ্চে মাত্র নিজেদের মেলে ধরছে। এক্ষেত্রে কর অব্যাহতি উঠিয়ে নিলে সম্ভাবনাময় এ খাত সংকটের মুখে পড়বে। তাই অন্তত আরও ৫ বছর এ খাতে কর অব্যাহতি থাকা প্রয়োজন।
এক সময় এ প্রযুক্তিখাতের রফতানি আয় ছিল ২৬ মিলিয়ন ডলার। সেই রফতানি আয় এখন ২ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। আরও ৫ বছর কর অব্যাহতি থাকলে এ খাত থেকে ৫ বিলিয়ন ডলার আয় সম্ভব বলে দাবি করেন জুনাইদ আহমেদ পলক।
তবে এই আলোচনার ইতি টেনেছেন প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান। আগামী বাজেটে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে করারোপ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন তিনি। তিনি বলেন, ২০২৪-২৫ বাজেটেও এ খাতে কর অব্যাহতি সুবিধা বহাল থাকবে। তবে এবারের বাজেট ঘোষণায়, কোন অর্থবছর থেকে এ খাতে কর বসবে তা স্পষ্টভাবে ঘোষণা দেয়া হতে পারে।
তবে কর অব্যাহতি বিষয়ে বিশেষভাবে এত দৃষ্টিপাত না করে, এ খাতের ব্যবসায়ীদের আরও বড় পরিসরে মনোযোগ দেয়া উচিত বলে মনে করেন প্রধানমন্ত্রীর এই উপদেষ্টা। পাশাপাশি, দেশের এই খাতের উন্নয়নে কী কী পলিসি ও সহযোগিতা সরকারের পক্ষ থেকে দেয়া যেতে পারে, তা নিয়ে ভাবতে হবে। সে জায়গায় সরকার সহায়তা দিতে পুরোপুরি প্রস্তুত বলেও উল্লেখ করেন তিনি। না হলে তৈরি পোশাক খাতের মতো সম্ভাবনাময় হওয়া সত্ত্বেও প্রযুক্তিখাত বিশ্ব বাজারের বড় মার্কেট ধরতে ব্যর্থ হবে মন্তব্য করেন তিনি।
এআই, দেশীয় মেধা সংরক্ষণ ও প্রযুক্তিবিদদের প্রত্যাশা
দেশের প্রযুক্তিবিদরা বিশদ আকারে দেশের মেধা পাচারের কথা বলে আসছেন বিভিন্ন সময়ে। দেশের মেধাবীদের ব্যবহার করতে ব্যর্থ হওয়ার কারণেই তারা দেশের বাইরে আরও ভালো ভালো কাজ করছেন বলে জানান প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা। পাশাপাশি দেশের আইটি খাতের উন্নয়নে প্রয়োজন দূরদর্শী এবং টেকসই পরিকল্পনা।
তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ জাকারিয়া স্বপন বলেন, দেশে এখনও সেই পরিমাণ তথ্য উপাত্ত নেই, যা দিয়ে এ খাতের সঠিক বিচার-বিশ্লেষণ সম্ভব। এ খাতের সর্বোপরি উন্নয়নের জন্য প্রথমে প্রয়োজন সঠিক পরিকল্পনা। প্রধানমন্ত্রী সঠিক বলেছিলেন যে, সারা জীবন একটি খাতকে কর অব্যাহতি দিয়ে চালানো সম্ভব নয়। যদি সারা জীবন কর অব্যাহতিই থাকে, তাহলে এ খাতের আসলে কোনো অগ্রগতি নেই। তাই খাতকে সঠিকভাবে উন্নয়নের জন্য আগে আন্তর্জাতিক বাজারের বড় মার্কেটগুলোর চাহিদা বুঝতে হবে এবং সেই অনুযায়ী উৎপাদন ও ইনোভেশনে এগিয়ে যেতে হবে। আর এজন্য প্রয়োজন দেশীয় মেধার ব্যবহার নিশ্চিত করা, যেখানে বরাবরই ব্যর্থ দেশ।
তিনি আরও বলেন, এআই নিয়ে বিশেষভাবে ভাবতে হবে এখন। সারা দুনিয়া এখন এআই ব্যবহার করে প্রযুক্তিখাতের ব্যাপক সম্প্রসারণ করছে। পাশের দেশ ভারতও এআই-কে বিশেষভাবে মূল্যায়ন করে তাদের পরিকল্পনা সাজিয়ে চলছে।
দেশের ২০২৪-২৫ বাজেটে এআই-এর উপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে। কারণ এর মাধ্যমে দেশের স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বাণিজ্যসহ প্রতিটি খাতে অভূতপূর্ব অগ্রগতি সম্ভব। পাশাপাশি প্রয়োজন পলিসির পরিবর্তন এবং নির্দিষ্ট কাঠামোর মাধ্যমে দূরদর্শী পরিকল্পনা করা। বাজেটে এসব কিছুর প্রতিচ্ছবি দেখা যাবে বলে আশাবাদ প্রকাশ করেন এই প্রযুক্তিবিদ।
স্টার্টআপ ফান্ড
দেশে গত ৫ বছরে টেকনোলজি স্টার্টআপ সেক্টরে প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার বিদেশী বিনিয়োগ এসেছে বলে এক আয়োজনে উল্লেখ করেন খাত সংশ্লিষ্টরা। তাই এই খাতকে আরও এগিয়ে নিতে স্টার্টআপের দিকে প্রয়োজন বিশেষ নজর দেয়া। আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক নিজেও এখাতের ব্যাপারে সরকারের বিশেষ আগ্রহ ও পরিকল্পনার কথা বেশ কয়েকবার উল্লেখ করেছেন। সবশেষ বেসিসের এক আয়োজনে স্টার্টআপ বাংলাদেশ লিমিটেডের অধীনে ২ হাজার কোটি টাকার ফান্ড তৈরির কাজ চলছে বলেও জানান।
প্রতিমন্ত্রী বলেন, স্টার্টআপদের আরও উৎসাহিত করতে ফান্ড তৈরি করা হচ্ছে। এরইমধ্যে ১০০ কোটি টাকা এ খাতে বিনিয়োগ হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর কাছে আরও ৫০০ কোটি টাকা আবেদন করা হয়েছে। ভবিষ্যতে এ খাতে স্টার্টআপ বাংলাদেশ লিমিটেডের অধীনে ২ হাজার কোটি টাকার ফান্ড থাকবে এবং এ বিষয়ে পরিকল্পনা করা হচ্ছে।
সুতরাং আসছে বাজেটেও তার এই ঘোষণার প্রতিচ্ছবি দেখা যাবে বলে আশা করছেন এই খাতের সংশ্লিষ্টরা। এর আগে ১৭ মে এক আয়োজনে ই-কমার্সের নারী উদ্যোক্তাদের জন্য এক ডিজিটাল ব্যাংকের মাধ্যমে বিশেষ ঋণ ব্যবস্থার কথাও জানিয়েছিলেন প্রতিমন্ত্রী।
স্মার্ট বাংলাদেশ ও অর্থনীতি বিশ্লেষকদের অভিমত
শুধুমাত্র কাগজে-কলমে নয়, বরং দেশীয় প্রযুক্তিখাতের অগ্রগতির প্রতিচ্ছবি থাকতে হবে বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতা করার মতো। এজন্য নির্দিষ্ট সময়ের জন্য কর অব্যাহতি থাকলেও গুরুত্ব দেয়া উচিত স্থানীয় ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তা রক্ষার ক্ষেত্রে। পাশাপাশি স্মার্ট বাংলাদেশ বাস্তবায়নে তথ্যপ্রযুক্তি খাতের বাজেটে বিশেষ দৃষ্টি দেয়া ছাড়া কোনো বিকল্প নেই সরকারের হাতে- এমন অভিমত বিশ্লেষকদের।
অর্থনীতি বিশ্লেষক মামুন রশীদ বলেন, এই সরকারের সময়ে সবচাইতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতির খাত হলো তথ্যপ্রযুক্তি। এই খাতের ওপর ভর করেই ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন পূরণ, সেই সঙ্গে স্মার্ট বাংলাদেশের প্রতিশ্রুতি। তাই এই খাতের উদ্যোক্তাদের উৎসাহ তৈরিতে এবং ব্যবসায়িক শ্রেণিকে বাঁচাতে বাজেটে আশানুরূপ প্রতিচ্ছবি রাখতে হবে। তাছাড়া দেশের যত খাত আছে, সেগুলোকে তথ্য প্রযুক্তির যথাযথ ব্যবহার উপযোগী করে তোলা গেলে অর্থনৈতিকভাবেও লাভবান হওয়া সম্ভব।
এক্ষেত্রে দেশের তরুণ মেধাবি প্রজন্মকে দেশেই কাজে লাগানোর ব্যাপারে আরও মনোযোগী হতে হবে। ভারতের মতো এত দ্রুত ফলাফল পাওয়া না গেলেও, সুষ্ঠু পরিকল্পনায় দেশকে স্মার্ট বাংলাদেশে রুপান্তর করা সম্ভব।
মোবাইল-ইন্টারনেট খরচ ও সাধারণের চিন্তা
ফেসবুক ব্রাউজিং থেকে পড়াশোনা, কেনাকাটা, দাফতরিক কার্জকর্ম- সব ক্ষেত্রেই বেড়েছে ইন্টারনেটের ব্যবহার। বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) বলছে, ১৯ কোটি ২২ লাখ সিমকার্ডধারীর মধ্যে ইন্টারনেট ব্যবহার করেন ১২ কোটির বেশি গ্রাহক। বর্তমানে মোবাইলে কথা বলায় ১০০ টাকার রিচার্জে ৩৩ টাকার বেশি কর দেন গ্রাহকরা। একই পরিমাণ কর দিতে হয় ইন্টারনেটেও।
এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, আসছে বাজেটে উভয় ক্ষেত্রে সম্পূরক শুল্ক ৫ শতাংশ বাড়িয়ে ২০ শতাংশ করার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। এতে অতিরিক্ত ৫ দশমিক ৭৫ টাকা কর বাড়বে। ফলে ১০০ টাকার মোবাইল সেবায় সর্বমোট কর দিতে হবে ৩৯ টাকা, যা হবে দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বোচ্চ। পাশাপাশি বর্তমানে হ্যান্ডসেট উৎপাদনে ৩ থেকে সাড়ে ৭ শতাংশ পর্যন্ত ভ্যাট দিতে হয় ১৭টি প্রতিষ্ঠানকে। বিক্রয় পর্যায়ে রয়েছে আরও ৫ শতাংশ ভ্যাট।
এসব কিছু মাথায় রেখে গত ১৯ মে সময় সংবাদকে দেওয়া এক সাক্ষাতকারে আইসিটি প্রতিমন্ত্রী বলেন, মোবাইল সেবায় এবং হ্যান্ডসেট সংযোজনে করভার কমাতে অর্থমন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যানের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রস্তাব দেয়া হয়েছে।
বর্তমানে ব্রডব্যান্ড সেবায় ৫ শতাংশ করে তিনস্তরে ১৫ শতাংশ ভ্যাটের বোঝা বহন করতে হচ্ছে ১ কোটি ৩৪ লাখ গ্রাহককে। এসব বিবেচনায় প্রযুক্তি খাতে কী ধরনের বাজেট তৈরি হচ্ছে, এবং কোথায়-কীভাবে সেই বাজেট বাস্তবায়ন করা হবে, তা দেখতেই মুখিয়ে আছেন খাত সংশ্লিষ্টরা।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।