জুমবাংলা ডেস্ক : আগ্রা গেলে কেউ নাকি তাজমহল না দেখে ফেরে না! নানা দেশের পর্যটকের ঢল দেখে আমারও তা-ই মনে হলো। বিদেশি পর্যটকদের পাশাপাশি ভারতীয়রাও আসে এই আশ্চর্য স্থাপনা দেখতে। কিন্তু এদের সিকি ভাগও আকবরের সমাধিস্থলে যায় না। কোলাহলমুক্ত শান্ত, স্নিগ্ধ এই সমাধি আগ্রার শহরতলি সিকান্দ্রাবাদে। মোগল সাম্রাজ্যের সবচেয়ে প্রতাপশালী সম্রাট ছিলেন জালালুদ্দিন মোহাম্মদ আকবর (১৫৫৬-১৬০৫ সাল)। সাম্রাজ্য বিস্তৃত ছিল আসাম থেকে কাবুল এবং কাশ্মীর থেকে আহমেদনগর পর্যন্ত। তিনি ৪৯ বছর ভারতবর্ষ শাসন করেন। শাসনকালের শেষ দিকে আগ্রার লালকেল্লা, ফতেহপুর সিক্রি, লাহোরের লালকেল্লা, এলাহাবাদের লালকেল্লা ছাড়াও তৈরি করেন সিকান্দ্রাবাদের সমাধি ভবন।
আগ্রা শহর থেকে আধাঘণ্টায় যাওয়া যায় সিকান্দ্রাবাদের সমাধি ভবনে। গাড়ি থেকে নেমেই একটি গেট চোখে পড়ল। তবে সেটা দিয়ে ঢোকা গেল না। একটু হেঁটে দক্ষিণ দিকের গেটে পৌঁছতে হলো। সমাধিস্থলের চারদিকে চারটি গেট আছে। গেটগুলো সব একই আদলে তৈরি। তবে ঢোকা যায় শুধু দক্ষিণের গেট দিয়ে।
এই সেই অন্ধকার সুড়ঙ্গ
ভেতরে ঢুকেই মনটা শান্ত হয়ে গেল। হেঁটে যাওয়ার মূল পথটা অনেক বড়। ওটার দুই ধারে মাঠ আর চারপাশে সারি সারি গাছ। এই পথ শেষ হলো প্রকাণ্ড এক তোরণের সামনে গিয়ে। বিকেলের আলোতে লাল এই তোরণের দিকেই অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকা যায়। গেটটি যেমন বিশাল তেমন সুন্দর! তোরণের ভেতরে ঢুকে দেখলাম আরেকটি রাস্তা চলে গেছে পাঁচতলাবিশিষ্ট সমাধিক্ষেত্রের দিকে। যেতে যেতে অনেক হরিণ চোখে পড়ল। দল বেঁধে বিশ্রাম নিচ্ছিল ওরা। সমাধিস্থলের কাছে গিয়ে জুতা খুলতে হলো দারোয়ানের অনুরোধে। পা রাখলাম ঠাণ্ডা মেঝেতে। মাথার ওপরে উড়ে গেল একঝাঁক পায়রা।
বিশাল একটি ঘর পার হয়ে এক অন্ধকার সুড়ঙ্গের সামনে চলে এলাম। ওপরে বাতি থাকলেও সব পরিষ্কার দেখা যায় না। সুড়ঙ্গের শেষে একটি হলরুমের মতো জায়গা। সেখানেই সম্রাটের কবর। আকবর চেয়েছিলেন তার পরবর্তী প্রজন্মের কবরও সিকান্দ্রার সমাধি ভবনে হবে।
তাজমহলে শাহজাহানের সমাধির রূপ ও জৌলুসের তুলনায় আকবরের কবর নিতান্তই সাদামাটা। আকারে ছোট, কারুকাজও কম। সমাধি দেখা শেষে বাইরে এসে বেঞ্চে বসলাম। আশপাশে তাকাতেই চোখে পড়ল বানরের দল। ওদের দেখে একটু ঈর্ষা হলো। সমাধি ভবনের এই বাসিন্দারা চাইলেই সমাধি ভবনের সর্বত্র ঘুরে বেড়াতে পারে, ওপরের তলাগুলোতেও উঠতে পারে। পর্যটকদের সেই সুযোগ নেই। কবর দেখেই ফিরে আসতে হয়। আফসোস কি বাত!
বিকেলের শান্ত পরিবেশ উপভোগ করতে করতে বুঝলাম, আকবর কেন এমন একটি জায়গা খুঁজেছিলেন। চিরনিদ্রায় শায়িত হওয়ার জন্য হয়তো শান্ত নিরিবিলি সিকান্দ্রাবাদ তার মনে ধরেছিল। তাই মৃত্যুর আগেই সমাধিস্থল বানানোর কাজ শুরু করেন।
কিন্তু নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার আগেই আকবর মারা যান। এরপর তার পুত্র সম্রাট জাহাঙ্গীরের তত্ত্বাবধানে নির্মাণকাজ শেষ হয় ১৬১২ সালে।
স্থানীয় গাইডদের ভাষ্য, সিকান্দ্রার সমাধি ভবনে ৪০টি সমাধির জায়গা ঠিক করা হলেও আছে চারজনের—আকবর, আকবরের বোন, শাহজাহানের ছেলে ও মেয়ের। কথিত আছে, এখানে আকবরের সমাধি থাকলেও তার দেহাবশেষ নেই। ১৬৯১ সালে আকবরের সমাধিতে হামলা চালায় জাঠ বিদ্রোহে অংশ নেওয়া সৈন্যরা। রাজা রাম সিংহের নেতৃত্বে তারা আকবরের কবর থেকে হাড়গোড় বের করে আগুনে পুড়িয়ে ফেলে। পরে সম্রাট আওরঙ্গজেব সমন জারি করেন। শাস্তিস্বরূপ এককালের কাশ্মীরের শাসক রাজা রাম সিংহকে মথুরার আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীতে নিয়োগ দেন তিনি। যাহোক, সমাধিতে আকবরের দেহাবশেষ না থাকলেও এখানে বেড়াতে আসা বেশির ভাগ দর্শনার্থী বিশ্বাস করে, সমাধিতে আকবর শায়িত আছেন।
তোরণ পার হয়ে আসার সময় দেখলাম সিঁড়ির কাছে ছোট একটি দরজা। হাতি, ঘোড়া ও বিশাল সৈন্যবাহিনী নিয়ে এখানে যাতে কেউ ঢুকতে না পারে তা নিশ্চিতেই দরজা ছোট করে বানানো হয়। সাধারণ মানুষ খুব সহজেই এটা পার হতে পারে।
ফিরে আসতে আসতে পথের দুই পাশে হরেক রকম ফুলগাছ দেখছিলাম। হঠাৎ দেখলাম মাঠের মধ্যে দুটি ময়ূর। একটিকে পেখম মেলে নাচতেও দেখলাম। তবে কাছে যাওয়ার সুযোগ নেই। মানুষ যাতে বিরক্ত না করতে পারে তা নিশ্চিতে ‘এই জায়গায় প্রবেশ নিষিদ্ধ’ লেখা প্ল্যাকার্ড ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। হরিণ, বানর, কাঠবিড়ালি ও ময়ূরের বিচরণক্ষেত্র পেরিয়ে চোখ গেল ঢালাই মেশিনের দিকে। প্রতিনিয়তই এখানে মেরামতের কাজ চলে। নইলে ৪০৯ বছর আগের এই স্থাপনা বহু আগেই ধ্বংসাবশেষে রূপ নিত।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।