রঞ্জু খন্দকার, গাইবান্ধা থেকে : ঘড়ির কাটায় তখন সময় দুপুর ১২টা। মাথার ওপর তপ্ত দুপুর। সূর্যটা যেন আগুন ঝরাচ্ছে। খোলা মাঠেও বাতাসের পরশ নেই। স্মার্টফোনে গুগলের ‘ওয়েদার আপডেটে’ তাপমাত্রা দেখাচ্ছে ৩৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস, অনুভূতি ৪০ ডিগ্রির। অর্থাৎ এই মুহূর্তে এই এলাকায় মৃদু তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে।
তবে এমন আগুন-গরম আবহাওয়ায়ও গাইবান্ধার কৃষকদের মনে কষ্ট নেই। বরং চোখমুখজুড়ে হাসির ঝিলিক। কণ্ঠভরা গান। দেশে ফসল আহরণের সবচেয়ে বড় মৌসুম বোরোধান মাড়াইয়ে যে এমন আবহাওয়াই চাই!
পলাশবাড়ী উপজেলার কুমারগাড়ী গ্রামের ছাতিয়ানতলা বাজারের মাঝখানটায় অনেকখানি ফাঁকা জায়গা। এই জায়গায় জাল (নেট) বিছিয়ে ধান শুকোতে দেন আশপাশের তিন গ্রামের মানুষ। পিচঢালা রাস্তায় খড় শুকোন অনেকে। পাশেই শামসুজ্জোহা মণ্ডলের চালকলে ধানও ভানেন তাঁরা।
বাজারের মাঠে ধান শুকোচ্ছিলেন কুমারগাড়ীর শাহ আলম খন্দকার। তিনি বলেন, এই রকম আবহাওয়া আরও কয়েকদিন থাকা দরকার। তাহলে কৃষকেরা শান্তিমতো ধান, চাল, খড় শুকিয়ে নিতে পারবেন। বৃষ্টি হলেই বিপদ।
পাশেই খড় শুকোতে দিয়েছিলেন একই গ্রামের শাহারুল ইসলাম। তাঁর ভাষ্য, বৈশাখের এই সময় আবহাওয়া এমন তপ্ত থাকা খুবই উপকারী। এরকম সময়ে বৃষ্টি হলে কৃষকের ক্ষতি। তখন সিদ্ধ ধান শুকোতে না পারলে তা গজিয়ে বীজ উঠতে পারে। এমন বীজধান পরে শুকোলেও এর চাল গন্ধ করে। আর খড় ঠিকমতো না শুকালে পচে নষ্ট হতে পারে।
শামসুজ্জোহার চালকলে ধান ভানতে এসেছিলেন গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার উত্তর পাটোয়া গ্রামের হায়দার আলী। তিনি বলেন, এমন খর আবহাওয়ায় কৃষক ধান কাটা থেকে শুরু করে মাড়াই, ঝাড়াই– সব করে নিতে পারেন। এমনকী ধান ভেনে চাল করে একেবারে গোলায়ও মজুত করে রাখতে পারছেন।
আবহাওয়া অফিসের তথ্য মতে, কয়েক দিন ধরে গাইবান্ধাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। তাপমাত্রা ৩৬ থেকে ৩৭ দশমিক ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত থাকলে তাকে মৃদু তাপপ্রবাহ বলা হয়। তাপমাত্রা ৩৮ থেকে ৩৯ দশমিক ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস হলে তা মাঝারি তাপপ্রবাহ। তাপমাত্রা ৪০ থেকে ৪১ দশমিক ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস হলে তীব্র তাপপ্রবাহ ধরা হয়। তাপমাত্রা ৪২-এর বেশি হলে তা অতি তীব্র তাপপ্রবাহ বলে গণ্য হয়।
দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশজুড়ে চলা এমন তাপপ্রবাহে জনজীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে শহুরেদের জীবনযাত্রা ব্যাহত হয়ে পড়ছে।
তবে গাইবন্ধার কয়েকজন কৃষক জানান, এমন তাপপ্রবাহ গ্রামের কৃষকদের জন্য বরং ‘স্বস্তি’ই বয়ে এনেছে। যারা দেশের মানুষের মুখে অন্ন জোগান, সেই কৃষকদের মুখে এমন আবহাওয়া হাসি ফুটিয়েছে। কণ্ঠ ভরেছে গানে।
জাতীয় দৈনিক প্রথম আলোর প্রতিবেদনেও এমনটা জানা যায়। সংবাদটিতে বলা হয়, বেলা তিনটার দিকে (গতকাল) গাইবান্ধা সদর উপজেলার বাড়ইপাড়া গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, গাইবান্ধা-সুন্দরগঞ্জ সড়ক ঘেঁষে ছয় থেকে সাতজন কৃষক ও কৃষিশ্রমিক ধান কাটছেন। তাঁরা কখনো গান ধরছেন, ‘ও ধান কাটো রে মাতাল মাতাত দিয়া…’, কখনো গাইছেন ‘ওকি গাড়িয়াল ভাই হাঁকাও গাড়ি মোর চিলমারী বন্দরে…’। ‘তোর বিরহে ঘুম আসে না মোর দুটি চোখে…’, ‘আহা কোন পরানে পারলিরে সরল মনে ব্যথা দিতে…’র মতো গানও শোনা গেল তাঁদের কণ্ঠে।
বাড়ইপাড়া গ্রামের ভুট্টু মিয়া বলেন, ‘আমার এক বিঘা জমিতে ধান পেকে আছে। এখন আবহাওয়া ভালো। তাই তাড়াতাড়ি কেটে নিচ্ছি। আনন্দের মাঝে থাকলে কাজে কষ্ট মনে হয় না। তাই সবাই গান গায়।’
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, এ বছর জেলার সাতটি উপজেলায় ১ লাখ ২৮ হাজার ৯৫০ হেক্টর জমিতে বোরো চাষের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়। চাষ হয়েছে ১ লাখ ২৮ হাজার ২০৫ হেক্টর। উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে চাল আকারে ৫ লাখ ৬২ হাজার ৮১৯ মেট্রিক টন। বোরো কাটার উপযুক্ত সময় এপ্রিল মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক খোরশেদ আলম বলেন, এ পর্যন্ত জেলায় শতকরা ৩৫ ভাগ ধান কাটা সম্পন্ন হয়েছে। ১৫-১৬টি কম্বাইন হারভেস্টার মেশিন দিয়েও ধান কাটা চলছে। দ্রুত ধান কর্তনে কৃষকদের পরামর্শ দিতে মাঠকর্মীদের ছুটি বাতিল করা হয়েছে। আশা করা যায়, আবহাওয়া ভালো থাকলে এ মাসেই ধান কাটা শেষ হয়ে যাবে।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে গাইবান্ধার আহম্মদ উদ্দিন শাহ শিশু নিকেতন স্কুল এন্ড কলেজের অর্থনীতি বিভাগের প্রভাষক আহসান হাবীব মণ্ডল জুমবাংলাকে বলেন, দেশে ফসল তোলার সবচেয়ে বড় মৌসুম বোরো। এখন সারা দেশেই বোরো ধান কাটা পুরোদমে চলছে। এই কাজে বৃষ্টিজনিত বিঘ্ন ঘটলে তা কৃষকের জন্য ক্ষতির কারণই হবে। এটা ঠিক, বৃষ্টি হলে শহুরে মানুষের জন্য তা সাময়িক স্বস্তি এনে দেবে। তবে আখেরে তা গোটা দেশের জন্যই অস্বস্তি বয়ে আনবে। তাই কড়া রোদেও এখানকার কৃষকের ক্লান্তি নেই। কৃষকের স্বস্তিতেই দেশেরও স্বস্তি।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।