বাংলাদেশ আজ লজ্জিত। পুরো দেশ যেন মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে অবুঝ শিশু আছিয়ার সামনে। আমাদের নিষ্ঠুর সমাজ, ধ্বংসপ্রাপ্ত বিচারব্যবস্থা, বিকৃত লালসার শিকার হয়ে চলে গেল আরেকটি নিষ্পাপ প্রাণ। আট বছরের শিশু আছিয়া, যার এখনো স্কুলের খাতার পাতায় লেখা হতো স্বপ্নের গল্প, যে মা-বাবার কোলজুড়ে ছিল অমূল্য রত্ন, সে আজ ধর্ষকের পাশবিকতার শিকার হয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নিলো।
গত ৫ মার্চ মাগুরায় বেড়াতে গিয়ে যে ভয়াবহ অভিশাপের মুখে পড়তে হয়েছে তাকে, তা শুধু অকল্পনীয় নয়, মানবতার প্রতি চরম কলঙ্কও। একটি শিশু, যে বুঝতেও শেখেনি এই পৃথিবীর নিষ্ঠুরতা, তাকেই পৈশাচিক লালসার শিকার হতে হলো। ৮ মার্চ যখন শিশুটিকে রাজধানীর সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) ভর্তি করা হয়, তখনও পুরো দেশ আশায় বুক বেঁধেছিল, হয়তো সে ফিরে আসবে। কিন্তু না, ১৩ মার্চ দুপুর ১টায় হাসপাতালের বিছানায় পড়ে থাকল শুধু একটি নিথর দেহ।
মায়ের কান্নায় ভারী আকাশ
শিশুটির মৃত্যু সংবাদ পাওয়ার পর মা একটানা কাঁদছেন। শোকের ভারে যেন পৃথিবীও স্তব্ধ হয়ে গেছে। মায়ের আর্তনাদ— ‘আমার মণিকে বেলেট দিয়ে ক্যামবা কাটিছে রে! আমার মণির পুরো গলায় ঘা হইয়্যা গেছে রে!’— এ শব্দ শুধু তার নিজের নয়, গোটা জাতির এক অপ্রকাশ্য কান্না। মা জানিয়ে দিয়েছেন, মেয়েকে তার নিজ গ্রাম মাগুরায় দাফন করা হবে। কিন্তু প্রশ্ন রয়ে যায়, এই নিষ্পাপ প্রাণের বিদায়ের দায় কে নেবে?
বিচারের দাবিতে গর্জে উঠেছে দেশ
আছিয়ার নির্মম পরিণতি দেশের মানুষের হৃদয়ে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আবদুল্লাহ বলেছেন, ‘পুরো বাংলাদেশ আছিয়ার কাছে ক্ষমাপ্রার্থী, লজ্জিত।’
জাতীয় নাগরিক পার্টির নেতা হাসনাত আবদুল্লাহ ও সারজিস আলমও একই সুরে কষ্ট প্রকাশ করে বলেছেন, ‘আছিয়ার ধর্ষণের বিচারের মাধ্যমে ধর্ষকদের শাস্তির এক দৃষ্টান্ত স্থাপন হোক। বিচারহীনতা, বিচারে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ এবং দীর্ঘসূত্রতা বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থাকে ধ্বংস করেছে। আছিয়ার ধর্ষকদের মৃত্যুদণ্ডের মাধ্যমে সেই বিচারব্যবস্থা আবার জেগে উঠুক।’
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস শিশুটির মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন এবং দ্রুত বিচারের নির্দেশ দিয়েছেন। আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল ঘোষণা করেছেন, আগামী সাত দিনের মধ্যে মামলার বিচার প্রক্রিয়া শুরু হবে। তবে, এই প্রতিশ্রুতি কতটা বাস্তবায়িত হবে, সেটাই বড় প্রশ্ন।
পুরো বাংলাদেশ বোন আছিয়ার কাছে ক্ষমাপ্রার্থী, লজ্জিত : হাসনাত
একটি কলঙ্কিত সমাজের প্রতিচ্ছবি
আছিয়া চলে গেছে, কিন্তু তার মৃত্যু আমাদের সামনে রেখে গেছে এক নির্মম বাস্তবতা। এই দেশ, যেখানে প্রতিনিয়ত শিশুরা শিকার হচ্ছে পাশবিকতার, যেখানে বিচারহীনতার সংস্কৃতি ধর্ষকদের উৎসাহিত করছে, সেই দেশে আছিয়ার মতো নিষ্পাপ প্রাণ কতদিন নিরাপদ থাকবে? আমরা কি সত্যিই একটা ন্যায়বিচারের সমাজ গড়তে পারবো? নাকি এই নিষ্ঠুর পৃথিবী আবারও কোনো শিশুর স্বপ্ন হত্যা করবে?
২০১৬ সালের ২০ মার্চ কুমিল্লার তনু হত্যার পরও এই জাতি একইভাবে প্রতিবাদে ফুঁসে উঠেছিল। কিন্তু বিচার এখনো হয়নি। তাহলে আছিয়ার জন্য কি ভিন্ন কিছু হবে? নাকি সেই একই পরিণতি তার পরিবারকেও বয়ে বেড়াতে হবে?
জাতি কি সত্যিই লজ্জিত?
আজ যদি সত্যিই আমরা লজ্জিত হই, তবে এই অপরাধের দৃষ্টান্তমূলক বিচার হোক। আছিয়ার খুনিরা, যারা তার ফুলের মতো জীবনকে পিষে দিলো, তাদের জন্য যেন কোনো রকম দয়া না দেখানো হয়। তাদের ফাঁসি নিশ্চিত করা হোক। বিচারব্যবস্থা, প্রশাসন, এবং রাজনৈতিক নেতৃত্বের কাছে এটাই আমাদের দাবি।
আছিয়া আর নেই। কিন্তু তার নিঃশব্দ আর্তনাদ, তার শেষ যন্ত্রণাময় শ্বাস আমাদের বিবেককে জাগিয়ে তুলুক। যে সমাজ তার নিরাপত্তা দিতে পারেনি, সেই সমাজের প্রতিটি মানুষ যেন আজ একবার আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেদের বিবেকের প্রশ্নের উত্তর দেয়। জাতি আজ লজ্জিত, কিন্তু এই লজ্জার দায় কি আমরা নিতে পারবো? নাকি কিছুদিন পর আবার সব ভুলে যাবো?
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।