জুমবাংলা ডেস্ক : দেশীয় ও বৈশ্বিক প্রয়োজনীয়তা অনুসারে নার্সিং পেশার চাহিদা বাড়ছে। কিন্তু এ খাতে নীতি-নির্ধারকদের নজর কম থাকায় চাহিদা অনুপাতে পেশাটির প্রসার ঘটানো যাচ্ছে না।
উচ্চশিক্ষার ঘাটতি, গুণগত শিক্ষাদানে যোগ্য শিক্ষক সংকট, প্রাতিষ্ঠানিক অর্গানোগ্রামে প্রয়োজনীয় সংখ্যক পদ, নিয়মিত নিয়োগ ও পদোন্নতি না থাকায় নার্সদের মধ্যে অসন্তোষ বাড়ছে। যার প্রভাব পড়ছে রোগীদের সেবাদানে।সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ রাষ্ট্রীয় সীমাবদ্ধতায় নার্সিং পেশা পিছিয়ে পড়ছে। যুগান্তরের প্রতিবেদন থেকে বিস্তারিত-
এমন প্রেক্ষাপটে আধুনিক নার্সিংয়ের জনক ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেলের জন্মদিন উপলক্ষ্যে আজ সোমবার সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও পালিত হচ্ছে ‘আন্তর্জাতিক নার্স দিবস-২০২৫।’ ‘ইন্টারন্যাশনাল কাউন্সিল অব নার্সেস’ (আইসিএন) এবারের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করেছে-‘আমাদের নার্সরা। আমাদের ভবিষ্যৎ। নার্সদের প্রতি যত্ন অর্থনীতিকে শক্তিশালী করে।’ এই প্রতিপাদ্যে নার্সদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিয়ে সচেতনতা ও বিশ্বের নীতিনির্ধারকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে। নার্সরা ভালো থাকলে রোগীদের সর্বোচ্চ সেবা দিতে পারবে যা টেকসই অর্থনীতিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। সবার দৃষ্টিভঙ্গিতে নার্সিং পেশার ভবিষ্যৎকে উজ্জ্বল ও আলোকিত করবে। দিবসটি উপলক্ষ্যে নার্সিং ও মিউওয়াইফারি অধিদপ্তরের উদ্যোগে সচেতনতামূলক শোভাযাত্রা ও আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে। সরকারি-বেসরকারি নার্সিং কলেজ ও হাসপাতালে সেমিনারসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালিত হবে।
নার্সদের সুরক্ষা ও অধিকার নিয়ে কাজ করা সোসাইটি ফর নার্সেস সেফটি অ্যান্ড রাইটসের (এসএনএসআর) একটি জরিপে দেখা গেছে, দেশে সরাসরি রোগীর সেবাদানকারী প্রায় ৯২ শতাংশ নার্স কোনো না কোনো মানসিক সমস্যায় ভুগছেন। অধিক কাজের চাপ কিন্তু কম বেতনে কাজ করছেন প্রায় ৯৬ শতাংশ নার্স। ফলে রোগীরাও সঠিক সেবা থেকে বঞ্চিত হন।
এসএনএসআরের মহাসচিব সাব্বির মাহমুদ তিহান জানান, একজন চিকিৎসকের পাশাপাশি তিনজন নিবন্ধিত নার্স প্রয়োজন। বাংলাদেশে ১ লাখ ৩৪ হাজার চিকিৎসকের বিপরীতে নার্স প্রয়োজন ৪ লাখ ২ হাজার। অথচ বর্তমানে ১ লাখ ১০ হাজার নিবন্ধিত নার্স রয়েছেন। এই হিসাবে দেশে নার্স সংকট প্রায় ২ লাখ ৯২ হাজার। নার্স সংকটে রোগীরা পর্যাপ্ত সেবা পাচ্ছেন না। অন্যদিকে নার্সদের বেতন কাঠামো নিুমানের। উন্নত বিশ্বের তুলনায় এ দেশের নার্সদের বেতন প্রায় ৭০-৮০ শতাংশ কম। তাই এদেশের নার্সরা মানসিক ও শারীরিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। নার্সদের প্রতি সরকারের অবহেলা এজন্য দায়ী।
সংশ্লিষ্টরা অভিযোগ করছেন, নার্সদের চাকরিবিধিতে পদোন্নতির জন্য গ্রেড ও পদ নির্ধারণ করা থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। একজন নার্স যে পদে চাকরিতে ঢুকছেন, সেই পদেই অবসরে যাচ্ছেন। নার্সিং কলেজ ও ইনস্টিটিউট চলছে সিনিয়র স্টাফ নার্স দিয়ে। অধ্যক্ষ ও অধ্যাপক থেকে প্রভাষক পর্যন্ত সংযুক্তি হিসাবে মূল বেতনে অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করছেন সিনিয়র স্টাফ নার্সরা। গত বছর প্রভাষক পদে কিছু নার্সকে পদোন্নতি দেওয়া হয়। এখন সিনিয়র স্টাফ নার্সের পাশাপাশি এসব কলেজ ও ইনস্টিটিউট চলছে ইনস্ট্রাক্টর দিয়ে। ৯০ শতাংশ নার্সের আবাসন ব্যবস্থা নেই। এমন কি নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদপ্তরে মহাপরিচালক ও পরিচালকসহ পদের ৯১ শতাংশ পদেই নিয়োগ পাচ্ছেন প্রশাসন ক্যাডারসহ নার্সিং পেশার বাইরের লোকজন।
পদ আছে, পদোন্নতি নেই : হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে নার্সদের সাত ধরনের পদ। এর মধ্যে হাসপাতালে চারটি পদে পদোন্নতি আছে। সেগুলো হলো একজন করে নবম গ্রেডে ডেপুটি নার্সিং সুপারিনটেনডেন্ট ও নার্সিং সুপারিনটেনডেন্ট, সাত বিভাগে সাতজন বিভাগীয় সহকারী পরিচালক ও জেলায় একজন করে জেলা পাবলিক হেলথ নার্স। নার্সিং সুপারভাইজার পদে কাজ করছেন নিজ বেতনে সিনিয়র স্টাফ নার্স। বাকি দুটি পদ হলো সিনিয়র স্টাফ নার্স ও মিডওয়াইফ। অর্থাৎ হাসপাতালে ১০ জন নার্স পদোন্নতি পাচ্ছেন। বাকি ৯০ শতাংশের কোনো পদোন্নতি নেই। অধিদপ্তরের জনবল তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, হাসপাতালে পদোন্নতির জন্য ৫টি পদে ১ হাজার ৪৫৩ জন জনবল অনুমোদন করা আছে। সেখানে এখন শূন্য রয়েছে ৩২৯ জন। অর্থাৎ ২৩ শতাংশ পদই ফাঁকা।
অন্যদিকে, নার্সিং ও মিডওয়াইফারি শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানের ২২টি পদের মধ্যে শুধু প্রভাষক (নার্সিং) পদে গত বছর নবম গ্রেডে পদোন্নতি দিয়েছে সরকার। যাদের নেওয়া হয়েছে তাদের চাকরির সময়ও শেষ পর্যায়ে বলে জানিয়েছেন নার্সরা। তারা জানিয়েছেন, এই প্রভাষকদের মধ্য থেকে কাউকে কাউকে নার্সিং কলেজে অধ্যক্ষের দায়িত্ব দিয়ে সংযুক্তিতে পাঠানো হচ্ছে। তবে অধিকাংশ কলেজের অধ্যক্ষ সিনিয়র স্টাফ নার্স।
নিয়োগবিধি অনুযায়ী, শিক্ষকতার পেশায় জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে নার্সরা পদোন্নতি পেয়ে সিনিয়র স্টাফ নার্স থেকে প্রভাষক, সহকারী অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক ও অধ্যাপক হবেন। কিন্তু সরকারি ৩৬টি নার্সিং কলেজের ৩৬ জন অধ্যক্ষই সিনিয়র স্টাফ নার্স। তারা নিজ পদের বেতনের বিপরীতে অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসাবে এই পদে কাজ করছেন। এই ৩৬ কলেজে উপাধ্যক্ষ পদে একজনও নেই। এসব কলেজে শিক্ষকতার কাজ করানো হচ্ছে সিনিয়র স্টাফ নার্সদের দিয়ে, নার্সিং ইন্সট্রাক্টর নাম দিয়ে। সম্প্রতি দেশব্যাপী সব নার্সিং কলেজে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের নিয়ম অনুযায়ী শিক্ষক নিয়োগের দাবিতে আন্দোলন চলছে। আগের নিয়মে শিক্ষক নিয়োগ স্থগিত করেছে নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদপ্তর।
নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদপ্তরের সাবেক ডিপিএম এবং জাইকা প্রজেক্টের সিনিয়র কনসালট্যান্ট (সিবিএনএস) ড. মো. আব্দুল লতিফ বলেন, নার্সিং পেশার উন্নতিতে জ্যেষ্ঠতা, উচ্চশিক্ষা এবং নির্ধারিত বিষয়ে পেশাগত অভিজ্ঞতার সমন্বয় দরকার। কিন্তু সরকারি নার্সিং নিয়োগ বিধিমালা জ্যেষ্ঠতাভিত্তিক হওয়ায় এবং পেশাগত উন্নতির ক্ষেত্রে এটি কার্যকরী না থাকায় রোগীরা মানসম্মত সেবাপ্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। জ্যেষ্ঠতা, উচ্চ শিক্ষা, নির্ধারিত বিষয়ে অভিজ্ঞতার সমন্বয় করে নিয়োগবিধি প্রণয়ন অত্যন্ত জরুরি। তিনি আরও বলেন, বর্তমানে অনেক নার্স শিক্ষা এবং প্রশাসনিক দিকে বেশি ঝুঁকছে। এতে হাসপাতালে সেবাদানের ক্ষেত্রে গুণগত উন্নয়নের জায়গা সীমিত হয়ে পড়ছে। এজন্য হাসপাতালে পেশাগত উন্নয়ন প্রশিক্ষণ এবং হাসপাতালে পদসোপান ভিত্তিতে পদোন্নতির ব্যবস্থা করতে হবে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।