জুমবাংলা ডেস্ক : পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে দেখেছি, কি চিকিৎসক কি রোগী, সব ধরনের মানুষের মাঝেই অহেতুক আতঙ্ক এখনও বিরাজ করছে। গণমাধ্যম বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের আধেয় বিশ্লেষণ করলেও দেখা যায়, মানুষ আতঙ্ক নিয়েই বাস করছে। রাস্তায় বের হলেও দেখা যায়, এখনও স্বাভাবিক কর্মছন্দ ও গতি ফিরে আসে নি। অথচ আতঙ্কিত না হয়ে সতর্কতা ও সচেতনতা অবলম্বন করে কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়া জরুরি এখন।
কেন আতঙ্কিত হবেন না? অনেকভাবে প্রশ্নটির ব্যাখ্যা করা যায়। আপাতত মৃত্যু বিষয়ক কিছু পরিসংখ্যান দিয়ে বিষয়টিকে একটু ব্যাখ্যা করি। বাংলাদেশে প্রত্যেকদিন গড়ে আড়াই হাজার মানুষ মারা যান। এবং এই মৃত্যুর মধ্যে ৬৫ থেকে ৭০ শতাংশ মৃত্যু হয় অসংক্রমিত রোগের কারণে। তারপর সড়ক দুর্ঘটনা, মাতৃত্বজনিত ও শিশুমৃত্যু। আর ২৪ শতাংশ বার্ধক্যজনিত নানা ধরনের সমস্যার কারণে। এই গড় মৃত্যুর হার আড়াই হাজারের জায়গায় তিন/চার হাজার মানুষ কি মারা যাচ্ছে প্রতিদিন? না, এরকম পরিস্থিতি বাংলাদেশে তৈরি হয়নি। এটা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কথা। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুসারে দেশে গড়ে প্রতিদিন মারা যায় প্রায় আড়াই হাজার মানুষ।
সে হিসেবে দেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হওয়ার তারিখ ৮ই মার্চ থেকে ৬ জুলাই; এই ১২১ দিনে নানা কারণে মারা গেছে তিন লক্ষ দুই হাজার ৫০০ জন। এমন ভাবার কোন কারণ নেই যে, করোনা ভাইরাসের কারণে যারা মারা যাচ্ছেন তারা ছাড়া আর কেউ মারা যাচ্ছে না। এমন ভাবার কোন কারণ নেই যে, অন্যান্য মৃত্যুর কারণগুলো নিজ নিজ নখ-দন্ত লুকিয়ে নিয়ে বসে গেছে। অন্যান্য কারণেও মারা যাচ্ছে মানুষ। বরং ওই কারণগুলোতেই অনেক বেশি মানুষ মারা যাচ্ছে। বিভিন্ন উৎস থেকে প্রাপ্ত তথ্য থেকে আমরা দেখি এই ১২১ দিনে শুধু যক্ষ্মায় (যেটা কোভিড-১৯ এর মতই একটি সংক্রামক রোগ) মারা গেছেন প্রায় ১৯ হাজার ৮৯০ জন, ক্যান্সারে মারা গেছেন ৪৯ হাজার ৭২৬ জন, নিউমোনিয়ায় মারা গেছেন ১৬ হাজার ৫৭৭ জন, হৃদরোগে মারা গেছেন ৮৪ হাজার ৮৬৫ জন, স্ট্রোকে মারা গেছেন ৪২ হাজার ৪৯৫ জন, ফুসফুসজনিত রোগে ২২ হাজার ৬৯৫ জন, ডায়াবেটিসে ১৩ হাজার ৩০৫ জন, ডায়রিয়াজনিত অসুখে নয় হাজার ৬৮০ জন। আর বার্ধক্যজনিত কারণে ৭২হাজার ৬০০জন। সেখানে এই সময়ে করোনায় মৃতের সংখ্যা দুই হাজার ৯৬ জন!
শুধু যক্ষ্ণার সাথে যদি তুলনা করি (যেহেতু দুটোই সংক্রামক ব্যধি) তাহলেই দেখব যে একই সময়ের ভেতর যক্ষ্ণায় কত গুণ বেশি মানুষ মারা গেছে। কিন্তু সেটার খবর আমরা জানি না বলে আমরা আতঙ্কিত নই। আর এটার খবর আমাদের জানানো হয় বলে আমরা আতঙ্কিত হই। অর্থাৎ তুলনামূলক চিত্র দেখে প্রকৃত বাস্তবতা বুঝে আমরা আতঙ্কিত হচ্ছি না। বরং খন্ডিত চিত্র দেখে আতঙ্কিত হচ্ছি। হয়ে নিজেদের শারীরিক, মানসিক, আর্থিক, পারিবারিক, সামাজিক নানা ক্ষতি করছি। মানবিকতার বদলে তৈরি করছি অমানবিকতার নানা উদাহরণ। তাই পুরো চিত্র দেখা জরুরি। তাহলে বোঝা যাবে আসলেই কতটা বিপদের মধ্যে রয়েছি আমরা। যে সংখ্যা আমাদের আতঙ্কে অস্থির করে তুলছে, পাগল বানিয়ে ফেলছে সেই সংখ্যার চেয়েও বড় সংখ্যা দেখেও তো আমরা দিব্যি নির্বিকার আছি। এটাই কি প্রমাণ করে না যে আমরা আমাদের স্বাভাবিক বিচার বুদ্ধি হারিয়ে ফেলেছি?
একটি জাতীয় দৈনিকে গত মে মাসে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানা যায়, করোনায় অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে যারা ভর্তি হন, তাদের ৮৪ শতাংশের লক্ষণ হচ্ছে মৃদু। মারাত্মক অসুস্থতা নিয়ে ভর্তি হয়েছেন ৪.৩ শতাংশ রোগী। এই মৃদু লক্ষণযুক্ত রোগীরা দ্রুত সুস্থ হয়ে ফিরে গেছেন। বিজ্ঞানী বিজন কুমার শীল বলেছেন, আমাদের দেশের মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তুলনামূলকভাবে ইউরোপ আমেরিকার মানুষের চেয়ে বেশি। এ কারণেই তাদের তুলনায় আমরা সংক্রমিত হয়েছি কম, মারাও যাচ্ছি কম।
আমাদের এখন রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে সুস্থ থাকতে হবে। আসলে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নাই। প্রয়োজনীয় সতর্কতা অবলম্বন করা এবং আমাদের ইমিউন সিস্টেম বাড়ানোর জন্যে যে বিষয়গুলো প্রয়োজন, সে নিয়মগুলো অনুসরণ করলেই হবে। সঠিক খাদ্যাভ্যাস অর্থাৎ ভিটামিন সি সমৃদ্ধ খাবার, পুষ্টিকর সহজপাচ্য খাবার, মৌসুমী ফল এসব খেতে হবে। মনের প্রশান্তির জন্য মেডিটেশন বা ধ্যান করতে হবে। করতে হবে ইতিবাচক চিন্তা। শরীরের সুস্থতা ও কর্মক্ষমতার জন্য যোগ ব্যায়াম, হাঁটা বা দৌঁড়ানো নিয়মিত প্রতিদিন করতে হবে। এ বিষয়গুলো নিয়ে ইতোমধ্যে অনেকেই অনেকভাবে বলেছেন। তাই এই লেখার শেষে এসে শুধু আতঙ্ক কাটানোর একটি সহজ পরীক্ষিত উপায় নিয়ে বলতে চাই।
আতঙ্ক বিষন্নতা দুশ্চিন্তা থেকে মুক্ত থাকার একটি সহজ সূত্র হল কাজে ব্যস্ত থাকা। কাজে ব্যস্ত থাকলে এসব নেতিবাচক আবেগ তো কমবেই পাশাপাশি দৈহিক সুস্থতাও বাড়বে। যুক্তরাষ্ট্রের নর্থওয়েস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নায়ুবিদদের মতে, কর্মব্যস্ত দিন কাটান যারা তারা অনিদ্রা ও ঘুম সংক্রান্ত জটিলতায় ভোগেন কম। এছাড়াও অনেক উপকার রয়েছে কর্মব্যস্ততার যা নিয়ে বিভিন্ন দেশে বিভ্ন্নি সময়ে গবেষনা হয়েছে। এসব গবেষনা থেকে উঠে আসছে যে, সুস্থতার সাথে কর্মব্যস্ততার সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে। তাই সুস্থ থাকতে হলে বসে না থেকে কাজে নামা জরুরি। পেশাগত কাজের পাশাপাশি স্বেচ্ছাশ্রমে অংশ নেয়াটাও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে সুস্থতার জন্য।
করোনার কারণে অনেক দিন আমরা কাজ করতে পারিনি। এখন আমাদের কাজের সময়। আগের সময়কে পুষিয়ে নিতে এখন আমাদের সুস্থ থেকে কাজে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। যারা দিন আনেন দিন খান, তাদের জন্যে কর্মহীন দিন মানে অন্নহীন দিন। আমরা অন্নহীন দিন কাটাতে চাই না। আমরা কর্মে পরিপূর্ণ এবং অন্নে পরিপূর্ণ দিন চাই। নিজের কাজের সাথে সাথে অন্যের কাজেও সহযোগিতা করতে পারা জরুরি এখন। করোনাকালে আমরা দেখেছি চিকিৎসা সেবা, ত্রাণ বিতরণ, মৃত ব্যক্তিকে দাফন বা সৎকার, ধান কেটে দেয়া, অসুস্থ ব্যক্তিকে হাসপাতালে আনা নেয়া করা ইত্যাদি নানা কাজে স্বেচ্ছাসেবকরা এগিয়ে এসেছেন। স্বেচ্ছাশ্রমের এই মানবিক চর্চাটাকেও ধরে রাখা খুব দরকার, নিজেদের ভালর জন্যই।
ডা. আয়েশা হান্না
সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান
প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগ, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতাল
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।