আন্তর্জাতিক ডেস্ক : গুজরাটের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-সংক্রান্ত ২০০২ সালের একটি মামলায় ভারতের সুপরিচিত অ্যাক্টিভিস্ট ও সমাজকর্মী তিস্তা সেতালভাদকে গুজরাট হাইকোর্ট অবিলম্বে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দিলেও মাঝরাতে এজলাস বসিয়ে সুপ্রিম কোর্ট আপাতত তাকে রেহাই দিয়েছে।
হাইকোর্টের নির্দেশে তারা অবাক হয়ে গেছেন জানিয়ে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিরা আরো বলেছেন, ‘সেতালভাদ আরো কিছুদিন জামিনে থাকলে কি মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ত?’
এর আগে গত ৩০ জুন (শুক্রবার) গুজরাটের হাইকোর্টের বিচারপতি নির্ঝর দেশাই তিস্তা সেতালভাদের জামিনের আবেদন খারিজ করে তাকে অবিলম্বে আত্মসমর্পণ করতে বলেছিলেন।
সেতালভাদের আইনজীবী মিহির ঠাকোরে এ নির্দেশের বাস্তবায়ন ৩০ দিনের জন্য স্থগিত রাখারও আবেদন জানিয়েছিলেন, যেন তারা এর বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে যাওয়ার সুযোগ পান। কিন্তু হাইকোর্ট ওই আবেদনও খারিজ করে দেয়।
গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে সুপ্রিম কোর্ট তিস্তা সেতালভাদের অন্তর্বর্তীকালীন জামিন মঞ্জুর করেছিল, তার সুবাদেই এতদিন তিনি গ্রেফতার থেকে অব্যাহতি পেয়েছিলেন।
তিস্তা সেতালভাদ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সবচেয়ে কঠোর সমালোচকদের একজন, গুজরাটের দাঙ্গাপীড়িতরা যেন সুবিচার ও আইনি প্রতিকার পান তার জন্য তিনি বহু বছর ধরে লড়াই করছেন।
গত বছর সুপ্রিম কোর্টের এক রায়ের পর গুজরাটের অ্যান্টি-টেরর স্কোয়াড সেতালভাদকে তার মুম্বাইয়ের বাসভবন থেকে গ্রেফতার করেছিল। পরে তাকে প্রায় ৭০ দিন জেলে থাকতে হয়।
সুপ্রিম কোর্টের হস্তক্ষেপ
গুজরাট হাইকোর্ট তিস্তা সেতালভাদের জামিন খারিজ করে দিয়ে তাকে আত্মসমর্পণ করতে বলার পর ভারতের শীর্ষ আদালত বিষয়টি ‘কগনিজেন্সে’ নেয়, অর্থাৎ শুনানির জন্য গ্রহণ করে। সেতালভাদের আইনজীবীও অবশ্য সুপ্রিম কোর্ট আপিল করেছিলেন।
সুপ্রিম কোর্টে এখন গ্রীষ্মকালীন ছুটি চলছে। ফলে বিষয়টি যায় বিচারপতি অভয় ওকা ও বিচারপতি প্রশান্ত কুমার মিশ্রর অবসরকালীন ডিভিশন বেঞ্চে।
ভারতের আইন-আদালতবিষয়ক পোর্টাল ‘লাইভ ল’ জানিয়েছে, বিচারপতি ওকা সেতালভাদকে অন্তর্বর্তী সুরক্ষা দিতে চাইলেও বিচারপতি মিশ্র তাতে সায় দেননি।
শনিবার (১ জুলাই) দুপুরে তারা বিষয়টি নিয়ে একমত হতে পারেননি বলে মামলাটি বৃহত্তর বেঞ্চে পেশ করার নির্দেশ দেন প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড়।
ওই দিন বেশি রাতেই মামলাটি শোনেন বিচারপতি বি আর গাভাই, এ এস বোপান্না ও দীপঙ্কর দত্তকে নিয়ে গঠিত তিন সদস্যের ডিভিশন বেঞ্চ।
মধ্যরাতের ওই শুনানিতে গুজরাট সরকারের হয়ে জেরা করতে গিয়ে ভারতের সলিসিটর জেনারেল তুষার মেহতা বলেন, ‘তিস্তা সেতালবাদ একজন কমন ক্রিমিনাল (সাধারণ অপরাধী)। একজন সাধারণ মানুষের জামিন নামঞ্জুর হলে যা করা হয়ে থাকে, এক্ষেত্রেও সেটাই করা হবে বলে বিচারপতিদের কাছে আশা করব।’
ডিভিশন বেঞ্চ স্পষ্ট জানিয়ে দেয়, যে ব্যক্তি গত ১০ মাস ধরে জামিনে আছেন তিনি আরো বাড়তি কয়েকটা দিন জামিনে থাকলে হাইকোর্টের কী সমস্যা সেটাই তাদের মাথায় ঢুকছে না।
বিচারপতি গাভাই বলেন, তাকে হেফাজতে নেওয়ার কী এত তাড়া ছিল? কয়েক দিনের জন্য অন্তর্বর্তী সুরক্ষা দিলে মাথায় কি আকাশ ভেঙে পড়ত?
তিনি বলেন, ‘হাইকোর্ট যা করেছে তাতে তো আমরা স্তম্ভিত হয়ে যাচ্ছি। এত অ্যালার্মিং আর্জেন্সি কিসের এমন কমন ক্রিমিনালদেরও কিন্তু অন্তর্বর্তী জামিন মঞ্জুর করা হয়।’
এরপরই সুপ্রিম কোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ গুজরাট হাইকোর্টের একক বেঞ্চের নির্দেশের ওপর এক সপ্তাহের স্থগিতাদেশ দেয়। যার ফলে তিস্তা সেতালভাদকে এখনই আত্মসমর্পণ করতে হচ্ছে না।
মোদি সরকার বনাম তিস্তা সেতালভাদ
নিজস্ব ইউটিউব চ্যানেলে তিস্তা নিজেকে একজন শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক ও মানবাধিকার-কর্মী হিসেবে পরিচয় দিয়েছেন।
২০০২ সালের গুজরাট দাঙ্গায় স্বজন হারানো ভিক্টিমরা যেন ন্যায় বিচার পায়, তার জন্য গত দুই দশক ধরে একটানা লড়াই করছেন তিস্তা জাভেদ সেতালভাদ ও তার এনজিও সিটিজেনস ফর জাস্টিস অ্যান্ড পিস (সিজেপি)।
দাঙ্গাপীড়িতরা যেন যথাযথ আইনি সহায়তা পায় ও তাদের আর্থিকভাবে সাহায্য করা যায়, তার জন্য গুজরাট দাঙ্গার ঠিক পর পরই ওই এনজিওটি গড়ে তোলা হয়েছিল।
কিন্তু সিজেপি কোথা থেকে অর্থ পাচ্ছে, বিদেশী সংস্থাগুলোর কাছ থেকে এনজিওটি অবৈধভাবে তহবিল সংগ্রহ করছে কিনা- তা নিয়ে বিজেপি আমলে সেতালভাদকে বারে বারেই প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়েছে।
গুজরাট দাঙ্গায় রাজ্যের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির অব্যাহতিকে চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিম কোর্টে গিয়েছিলেন সেতালভাদ ও জাকিয়া জাফরি। জাকিয়ার স্বামী ও কংগ্রেস নেতা এহসান জাফরিকে দাঙ্গাকারীরা আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করেছিল।
জাকিয়া জাফরি মূল আবেদনকারী হলেও তিস্তা সেতালভাদ ছিলেন ওই মামলার কো-পিটিশনার।
গত বছরের জুন মাসে সুপ্রিম কোর্টের তিন সদস্যের বেঞ্চ ওই মামলা খারিজ করে দিয়ে মন্তব্য করেছিল, তিস্তা সেতালভাদ জাকিয়ার আবেগকে অন্যায়ভাবে কাজে লাগিয়েছেন।
বিচারপতি এ এম খানউইলকরের নেতৃত্বে তিন সদস্যের বেঞ্চ আরো বলে, ‘সেতালভাদ চাইছেন দাঙ্গা নিয়ে বিতর্কের আগুন যেন জিইয়ে রাখা যায়। অন্যভাবে বললে তাওয়া গরম রাখা যায়।’
এরপরই বার্তা সংস্থা এএনআইকে বিশেষ সাক্ষাৎকার দিয়ে সেতালভাদের বিরুদ্ধে মুখ খোলেন দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। অমিত শাহ ওই সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘বহু ভিক্টিমের হয়ে এনজিওই হলফনামায় সই করে দিত, তারা জানতও না কিছু। সবাই জানে তিস্তা সেতালভাদের এনজিও এসব করে আসছিল। আর তখন যে কংগ্রেসের নেতৃত্বে ইউপিএ সরকার ক্ষমতায় ছিল, তারা তিস্তা সেতালভাদের এনজিওকে প্রচুর সাহায্য করেছিল, এটাও ল্যুটিয়েনস দিল্লিতে সবারই জানা।’
সেতালভাদের মতো কেউ কেউ প্রধানমন্ত্রী মোদীকে কলঙ্কিত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, এমন ইঙ্গিতও করেন তিনি। দলীয়ভাবে বিজেপিও তিস্তা সেতালভাদের পুরনো সব কাজকর্ম নিয়ে তদন্তের দাবি জানায়।
এরপরই গুজরাট পুলিশের ক্রাইম ব্রাঞ্চ তিস্তা সেতালভাদের বিরুদ্ধে নথিপত্রে জালিয়াতি করাসহ বিভিন্ন অভিযোগে এফআইআর নথিভুক্ত করে।
২০২২ সালের ২৫ জুন সকালে গুজরাটের অ্যান্টি-টেররিজম স্কোয়াড (এটিএস) তিস্তা সেতালভাদের মুম্বাইয়ের বাড়িতে গিয়ে তাকে তুলে আনে। এরপর প্রায় আড়াই মাস তাকে জেলে কাটাতে হয়েছিল।
সূত্র : বিবিসি
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।