জুমবাংলা ডেস্ক: আদম সেতু বা রাম সেতু। অনেকে সেতু বাঁধ কিংবা নল সেতুও বলেন। ‘শ্রীপদ’ বা এডাম’স পিক নামে পরিচিত পর্বতের পাদদেশ থেকে ভারতের তামিলনাড়ুর দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলে রামেশ্বরম দ্বীপ পর্যন্ত বিস্তৃত একটি প্রাচীন সেতু রয়েছে। অনেকেই এটাকে আদম সেতু বলে জানে, কিন্তু বহু মানুষের কাছে এটি রাম সেতু নামে পরিচিত। ‘রাম’ আর ‘আদম’ নাম থাকায় ধর্মীয় পরিচয় এখানে চলে আসে, আর সেই সাথে ধর্মীয় অনুভূতি। কিন্তু ইতিহাস কী বলে?
শ্রীলঙ্কার দক্ষিণ-পশ্চিম অংশের শ্রীপাড়া প্রদেশে অবস্থিত একটি পর্বতে ১.৮ মিটার বা ৫ ফুট ১১ ইঞ্চি দৈর্ঘ্যের একটি পায়ের ছাপ রয়েছে। মুসলিম ও খ্রিস্টানদের কাছে এটি পৃথিবীর আদি মানব হজরত আদম (আ) এর পায়ের ছাপ, সনাতনদের কাছে এটি তাদের দেবতা শিবের পায়ের ছাপ আর গৌতম বুদ্ধের পায়ের ছাপ হিসেবে বিশ্বাস করেন বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারীরা। ৭,৩৫৯ ফুট উচ্চতার এই ‘শ্রীপদ’ বা এডাম’স পিক নামে পরিচিত পর্বতের পাদদেশ থেকে ভারতের তামিলনাড়ুর দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলে রামেশ্বরম দ্বীপ পর্যন্ত বিস্তৃত একটি প্রাচীন সেতু রয়েছে। সেতুটি সমুদ্রের মধ্যে এক রহস্যময় উপায়ে ভাসমান। কোনো প্রযুক্তি বা কৃত্রিম ইট-কাঠ-পাথরে নয়, সেতুটি নির্মিত প্রাকৃতিক- পাথর আর বালু দিয়ে। একাধিক নাম একাধিক কাহিনি আর সমুদ্রে ভেসে থাকার একাধিক রহস্যে ঘেরা এই সেতুটি।
সমুদ্রের বুকে ভেসে থাকা অগভীর চুনাপাথরে নির্মিত সেতুটির দৈর্ঘ্য ৩০ মাইল বা ৪৮ কিলোমিটার। ভূতাত্ত্বিক প্রমাণ পাওয়া যায় যে, এটি একসময় ভারত আর শ্রীলঙ্কাকে যোগ করে রেখেছিল স্থলপথে। এখন এই সেতু দিয়ে চলাচল করা না গেলেও, পঞ্চদশ শতক পর্যন্ত একদম পায়ে হেঁটে যাবার অবস্থাই ছিল, মানুষ যেতে পারত। পর্বতের চূড়ায় অবস্থিত মন্দিরের নথি অনুযায়ী, ১৪৮০ সালে এক ঘূর্ণিঝড় হয়েছিল, যার ফলে এই সেতু ভেঙে যায়। বিভিন্ন ঝড়ের ফলেও তলিয়ে যায় সেতুটি।
মুসলিমরা যে ইতিহাসের কথা বলেন
যদিও কোনো প্রমাণিত হাদিস বা কোরআনের আয়াতে এর উল্লেখ নেই, তবুও কথিত আছে, দীর্ঘদেহী হজরত আদম (আ.) যখন দুনিয়াতে আসেন, তখন তিনি শ্রীলঙ্কায় পতিত হন। তিনি অনুতপ্ত হয়ে এই পর্বতচূড়ায় টানা এক হাজার বছর প্রার্থনা করেন এক পায়ে দাঁড়িয়ে। সেই পায়ের ছাপই এটি। আবার এরকমও বর্ণিত আছে, তিনি পতিত হওয়ার সময় যে প্রচণ্ড বল নিয়ে ভূমিতে প্রথম পায়ে আঘাত করেন, সেটির কারণেই এই পায়ের ছাপ সৃষ্টি হয়েছিল।
বলা হয়ে থাকে, তিনি এই চূড়া থেকে নেমে স্থলপথে এ সেতু অতিক্রম করে চলে যান ভারতে এবং একসময় আরাফাতের ময়দানে পৌঁছান, যেখানে জেদ্দায় পতিত বিবি হাওয়ার সঙ্গে পুনর্মিলিত হন তিনি। অন্য একটি মতবাদ অনুযায়ী, তিনি ভারত থেকে এই সেতু পেরিয়ে এই পর্বতের চূড়ায় অনুতাপ করতে গিয়েছিলেন। তবে এ কাহিনিগুলোর প্রামাণ্য বা কোনো রেফারেন্সের খোঁজ পাওয়া যায়নি।
কোথাও কোনো কাহিনীতে এর উল্লেখ নেই যে, এই সেতুটি সেখানে আগে থেকেই ছিল কি না বা কীভাবে বানানো হয়েছিল। অথবা অন্য কোনো রূপে ছিল কি না যা আদম (আ.) সমুদ্র পার হওয়ার জন্য ব্যবহার করেন। কিন্তু প্রচলিত কাহিনি থেকে এ সেতুর নাম হয়ে যায় আদম সেতু।
হিন্দুরা যা বলে থাকেন
রামায়ণের কাহিনির এক গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে এসে দেখা মেলে এই সেতুর। যে সেতু পেরিয়ে রাম-লক্ষ্মণের নেতৃত্বে বানরসেনা লঙ্কায় পৌঁছেছিল। পৌরাণিক এই সেতু নাকি সত্যিই ভারতে রয়েছে। ভারত মহাসাগরে ভাসমান এই সেতু তামিলনাড়ুর পামবান দ্বীপ (যা পরিচিত রামেশ্বরম দ্বীপ নামেও) ও শ্রীলঙ্কার মান্নার দ্বীপকে যুক্ত করে। যদিও আজ তা অবস্থান করছে সমুদ্রের তলদেশে।
সীতাকে ফিরিয়ে আনতে শ্রীলঙ্কায় প্রবেশের লক্ষ্যে এগিয়েই সমুদ্রের অনন্ত বিস্তারের সম্মুখীন হন রামচন্দ্র। সমুদ্র পেরিয়ে যাওয়ার উপায় না পেয়ে তির ছুঁড়তে প্রবৃত্ত হলেন তিনি। পরে সমুদ্রের পরামর্শেই নল শুরু করেন রামসেতু নির্মাণ। সেই সেতু নির্মাণে ক্ষুদ্র কাঠবিড়ালীও অংশ নিয়েছিল। রাজশেখর বসুর ‘বাল্মীকি রামায়ণ সারানুবাদ’ গ্রন্থে সেই বর্ণনা এরকম- ‘নল সেতু রচনা আরম্ভ করলেন।… এই শতযোজন দীর্ঘ দশযোজন বিস্তৃত নলকৃত সেতু অম্বরস্থ ছায়াপথের ন্যায় শোভা পেতে লাগল। দেব, গন্ধর্ব, সিদ্ধ মহর্ষি প্রভৃতি নলের অদ্ভুত কীর্তি দেখবার জন্য আকাশে উঠলেন। সমুদ্রের উপর সীমান্তরেখার ন্যায় শোভমান এই সেতুপথে সহস্র কোটি বানর লাফাতে লাফাতে সগর্জনে পার হতে লাগল।’ পড়তে পড়তে সত্য়িই বিস্ময় জাগে। শিগগিরি মুক্তি পেতে চলা ‘আদিপুরুষ’ ছবির ট্রেলারেও সেই দৃশ্য দেখে উচ্ছ্বসিত হয়েছেন অনেকে।
কিন্তু এ তো মহাকাব্যের দৃশ্য। রামনাম লেখা পাথর সাজিয়ে তৈরি পৌরাণিক সেই সেতুই কি ভারত মহাসাগরের তলদেশে থাকা চুনাপাথরের সেতুটি? যা জুড়ে দিয়েছে ভারত ও শ্রীলঙ্কাকে (রামায়ণে সেটাই রাবণের লঙ্কা) এই নিয়ে দ্বন্দ্ব বহুদিনের। কিন্তু বিজেপি শাসিত ভারতে সেই বিবাদ নতুন মাত্রা পেয়েছে। হালফিলে অক্ষয় কুমার তো ‘রাম সেতু’ নামে ছবিই বানিয়ে ফেলেছিলেন। সেই ছবিতে গল্পের গরু গাছে ওঠা নিয়ে যতই কথা হোক, রাম সেতু বিতর্ক যে এরপর নতুন করে আলোচনায় উঠে এসেছিল তা বলাই যায়।
সেতু ভাঙার পরিকল্পনা
ঊনবিংশ শতাব্দীতে ব্রিটিশ সরকার পরিকল্পনা করে বড় বড় জাহাজ চলাচলের পথ তৈরি করতে পক প্রণালীর এই অংশে ড্রেজিং শুরু করার। পূর্ব ও পশ্চিম উপকূলের মধ্যে কম সময়ে জাহাজ চলাচলের জন্যই ওই পরিকল্পনা। কিন্তু সেই পরিকল্পনা সফল হয়নি। স্বাধীনতা পরবর্তী ভারতে ফের মাথাচাড়া দেয় সেই প্ল্যান। প্রকল্পের নাম দেওয়া হয় ‘সেতুসমুদ্রম’। কিন্তু আজও তা করে ওঠা যায়নি।
ইউপিএ সরকারের আমলে এই প্রকল্পে বাধা দিয়েছিল বিজেপি। তাদের দাবি ছিল, এভাবে ড্রেজিং করতে গিয়ে রাম সেতুর ক্ষতি করা যাবে না। বিষয়টা গড়িয়েছিল সুপ্রিম কোর্টে। কিন্তু জট কাটেনি। ২০১৪ সালে মোদি সরকার ক্ষমতায় আসার পরে স্বাভাবিকভাবেই আর কোনো পদক্ষেপ করা হয়নি। ২০১৯ সালে কেন্দ্রীয় মানবসম্পদ উন্নয়নমন্ত্রী রমেশ পোখরিয়াল দাবি করেন, প্রাচীন ভারতের প্রযুক্তি কতটা উন্নত ছিল তার উল্লেখযোগ্য নিদর্শন রাম সেতু। এমন দাবি বিজেপি নেতারা বারবারই করেছেন।
বছর কয়েক আগেই রাম সেতুর বয়স নির্মাণ নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা শুরু হয় মোদি সরকারের উৎসাহে। ফলাফলের কথা আগেই বলা হয়েছে। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী জিতেন্দ্র দাবিও করেছেন, একটা নির্দিষ্ট ধারাবাহিকতা মেনেই ওই অংশের চুনাপাথরের কাঠামোটি রয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও এটা যে একটা সেতু, এমনটা বলা কঠিন, সেই ইঙ্গিতও তাঁর কথাতেই রয়েছে।
এমনই নানা দ্বন্দ্ব জড়িয়ে রেখেছে রাম সেতুকে। সত্যিই এই চুনাপাথরের কাঠামো একটা প্রাকৃতিক খেয়াল? নাকি তা সুদূর অতীতের বুকে রামচন্দ্র ও তার বানরসেনার কীর্তি? উত্তর মেলেনি। তবু সেই কুয়াশামাখা প্রশ্নের উত্তরের খোঁজ আজও চলছে। কোনো একদিন তা মিলে যাবে হয়তো। আপাতত সমুদ্রের গভীরে থাকা বিস্ময়কে ঘিরে নিত্যনতুন দাবির ঢেউ।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।