পুরো ঢাকা শহর আসলে অভিশপ্ত। বলতে কি, ঢাকার আকাশে অধিকাংশ চেনা নক্ষত্রই চোখে পড়ে না আলোর উত্পাতের কারণে। শহরের দিগন্তের অনেকটা জুড়ে আলোর আভা ছড়িয়ে থাকে। সেই আলোয় পুরো আকাশটাই সারা রাত ম্যাড়মেড়ে হয়ে থাকে। হাতে গোনা কয়েকটি অত্যুজ্জ্বল নক্ষত্র ছাড়া ঢাকার আকাশে খুব বেশি জ্যোতিষ্ক দেখার অবকাশ নেই।
আকাশ ভেঙে পড়ছে অজস্র নক্ষত্রে। আক্ষরিক অর্থে তারায় তারায় থিকথিক করছিল আকাশ। একটা বিন্দুও কোথাও ফাঁকা নেই। এ রকম অদ্ভুত আকাশ আমি কোনো দিন দেখিনি। গা ছমছম করে ওঠে। ঢাকা শহর ক্রমাগত আরও আলোকিত হয়ে উঠছে। আর ক্রমেই আকাশ থেকে একটি একটি করে নক্ষত্ররা বিদায় নিচ্ছে। বিদায় নিচ্ছে আমাদের নাগরিক অভিজ্ঞতার জগত্ থেকে। আমরা আর কোনো দিন তাদের দেখতে পাব না। কিংবা যখন পাব, দূর কোনো আলোকহীন শহরে গিয়ে, তখন চিনতে পারব না।
আগে ঢাকার আকাশে একে একে জেগে উঠছে এমন অনেক নক্ষত্র, যারা প্রথমবারের মতো দেখা দিয়েছে। এই শহরের আকাশ আগে কখনো তাদের দেখেনি। কিন্তু তাদের স্বাগত জানানোর অবসর কারও ছিল না। আমাদের শহরের ইতিহাসে ওই দিনটা একটা দুর্যোগের দিন হিসেবে লেখা হয়ে আছে। আমিও দিনটাকে আলাদা করে দাগ দিয়ে রেখেছি, রাতের আকাশের মতো মিশমিশে কালো কালিতে দেওয়া দাগ।
প্রায় এ রকমই একটা ঘটনা ঘটেছিল একবার আমেরিকার লস অ্যাঞ্জেলেস শহরে। ১৯৯৪ সালের এক ভোররাতে সেখানে একটা ভূমিকম্প হয়েছিল। ফলে বিদ্যুত্ চলে গিয়েছিল সারা শহরে। ভূমিকম্পে যা হয়, শহরবাসী ছুটে বেরিয়ে এসেছিল রাস্তায়। কিন্তু রাস্তায় নেমে অন্ধকার আকাশের দিকে তাকিয়ে ভড়কে গিয়েছিল তারা। কাছেই গ্রিফিথ মানমন্দিরে একের পর এক টেলিফোন। লোকে ফোন করে জানাচ্ছিল তারা অদ্ভুত এক আকাশ দেখতে পাচ্ছে। লস অ্যাঞ্জেলেসবাসী আসলে অদ্ভুত বা আলাদা কিছুই দেখেনি। আলোকদূষণহীন স্বাভাবিক আকাশ দেখেছিল তারা।
আইজ্যাক আসিমভের একটা সায়েন্স ফিকশন গল্পের কাহিনি মনে পড়ে যায় আমার। খুব বিখ্যাত গল্প। বলা হয়, সব বিচারে সর্বকালের সেরা সায়েন্স ফিকশন গল্প সেটা। গল্পের নাম ‘নাইটফল’। মানে নিশিকাল। রাত নামা। গল্পে লাগাশ নামের এমন একটা গ্রহের কথা বলা হচ্ছে, যে গ্রহে কোনো দিনই রাত নামে না। ছয়টা সূর্যকে ঘিরে ঘোরে গ্রহটা। ফলে আকাশে সব সময়ই কোনো-না-কোনো সূর্য উপস্থিত।
একটা সূর্য যখন দিগন্তে ডুবে যাই-যাই করছে, তখন আরও দুটো সূর্য হয়তো গনগন করছে মধ্যগগনে। এ জন্য একটা অনন্ত দিন বিরাজ করে লাগাশ গ্রহে। লাগাশবাসী কোনো দিনই রাতের নক্ষত্রখচিত আকাশ দেখেনি। রাত নামলে যে সারা আকাশ অন্ধকার হয়ে যায়, আর সেই অন্ধকারজুড়ে নক্ষত্ররা যে পিটপিট করে জ্বলতে থাকে, সেটা তাদের জানা নেই।
এখন ব্যাপার হয়েছে কী: অনন্ত মনে হলেও লাগাশের দিনের দৈর্ঘ্য আসলে অনন্ত নয়। গ্রহ-নক্ষত্রের ঘূর্ণনের এক জটিল যোগসাজশের কারণে বহুদিন পরপর একবার এমন হয় যে লাগাশ গ্রহের পাঁচটি সূর্য তখন দিগন্তে অস্ত যায়। আর যে একটিমাত্র সূর্য তখন মধ্যগগনে থাকে, সেটায় পূর্ণগ্রহণ হয়। অল্প সময়ের জন্য। অর্থাৎ খুব অল্প সময়ের জন্য লাগাশ গ্রহে রাত নেমে আসে। প্রতি ৩০ হাজার বছর পর পর এমনটা হয়।
রাত নেমে এলে আকাশে ফুটে ওঠে অনন্ত নক্ষত্রবীথি। এই অভিজ্ঞতা জীবিত কারও নেই। ফলে সবাই পাগলের মতো ছোটাছুটি করতে থাকে। সামনে যা পায়, তাতেই আগুন ধরিয়ে দিতে থাকে একটু আলোর জন্য। আর এভাবে পুরো লাগাশের সভ্যতা পুড়ে ছাই হয়ে যায়। এ ঘটনার কোনো স্মৃতি কারও কোথাও থাকে না। ফলে আবার গোড়া থেকে শুরু হয় সভ্যতার যাত্রা। ৩০ হাজার বছর পর আরেকটি রাত নামার দিকে, আরেকটি ধ্বংসের দিকে চক্রাকার যাত্রা।
অদ্ভুত গল্প। কিন্তু আমি ভাবি, মাত্র ২১ বছর বয়সে আসিমভ যখন এই গল্প লিখছেন, তাঁর কি ধারণা ছিল তিনি আসলে ভবিষ্যতের পৃথিবীর কথা বলছেন? লাগাশের মতোই একটা অনন্ত দিন নেমে আসছে পৃথিবীজুড়ে। একে একে নক্ষত্ররা যেভাবে বিদায় নিচ্ছে আলোকোজ্জ্বল শহর-গ্রাম-গঞ্জের আকাশ থেকে, একদিন হয়তো সারা আকাশ খটখটে বিরান হয়ে যাবে।
ইউরোপ আর উত্তর আমেরিকার ৮০ শতাংশ এলাকায় এখন কখনোই রাত নামে না। সত্যিকার অন্ধকার কী জিনিস, ৮০ শতাংশ লোকের সেই অভিজ্ঞতাই হয় না। মিল্কিওয়ে তাদের কাছে একটা কাগুজে নথিমাত্র। অথচ ছোটবেলায় শুনেছিলাম, মিল্কিওয়ের আলোয় মানুষের ছায়া পড়ে।
পৃথিবীতে অর্ধেকের বেশি লোক এখন শহরে বাস করে। একদিন দুনিয়ার সব লোক শহরে বসবাস করবে। সেই দিন হয়তো পুরো গ্রহে একটাই শহর তৈরি হবে—দেশকালহীন এবং রাত্রিহীন।
আমরা সবকিছু থেকে অন্ধকার দূর করে দিতে চাই। সেটা প্রতীকী অর্থে বলি বটে। কিন্তু সত্যিকারের যেটা অন্ধকার, মানুষের জীবনে তার দরকার আছে। তার একটা বড় ভূমিকা আছে। আমি মনে করি, নক্ষত্রখচিত রাতের আকাশ মানুষের জন্য জরুরি। আমরা যে এক অনন্ত মহাজগতের বাসিন্দা, অগণিত জ্যোতিষ্ক ছড়ানো একটা শূন্যতায় পৃথিবীটা যে ভেসে বেড়াচ্ছে, এই গূঢ় সত্যটা না জানলে আমাদের অভিজ্ঞতা পরিপূর্ণ হয় না। দিনের আকাশ কোনো দিনই সেই গূঢ় সত্য জানায় না।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।