জুমবাংলা ডেস্ক : ‘আমার একটা সন্তান ছিল, আমার সন্তানকে কে বুকের থেকে ছিনাইয়া নিয়া গেল সেইটাও জানি না। আমার সন্তানকে কে হত্যা করল সেইটাও জানি না। সংসারে যে একটা বাতি জ্বালাইবো সেই লোকও নাই। একটা ছেলে আছিলো আল্লায় বুকের থেইকা ছিনাইয়া লইয়া গেছে।
আমার সংসারের বাতি জ্বালানোর আর কেউ রইল না। আমার পুতের (ছেলের) খুব মেধা ছিল পড়ার। নিজে চাকরি-বাকির করত নিজে পড়াশোনাও করত। বাপের সংসারে অভাব।
নদী ভাঙছে কিছু নাই। চাকরি কইরা ভোলা কলেজে ভর্তি হইছে। ছোটকাল থেকে রক্ত মাংস করলাম। কে ঝড়াইলো আমার পুতের রক্ত? আমি একটা ছেলে পাইয়া আল্লার কাছে বড় খুশি হইছিলাম।
কিন্তু আল্লায় বুকের থেকে ছিনায়া লইয়া গেল।’
গত বুধবার (৩১ জুলাই) দুপুরের দিকে কান্নাজড়িত কণ্ঠে এ কথাগুলো বলছিলেন কোটা সংস্কার আন্দোলনে সংঘর্ষে নিহত ভোলার বোরহানউদ্দিন উপজেলার বড় মানিকা ইউনিয়নের উত্তর মাটামারা গ্রামের নাহিদুল ইসলামের পঞ্চাশোর্ধ মা বিবি ফাতেমা। তার কান্নায় আশপাশের লোকজনও শোকে স্তব্ধ হয়ে চোখের পানি ফেলেছেন। সন্তানহারা মাকে স্বান্তনা দেওয়ার মতো কোনো ভাষা নেই কারো কাছে।
গত ১৯ জুলাই (শুক্রবার) বিকালে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র সংঘর্ষ চলাকালে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন মো. নাহিদুল ইসলাম (২১)।
নাহিদ ভোলা সরকারি কলেজের দর্শন বিভাগের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। পাশাপাশি তিনি ঢাকায় বিকাশে চাকরি করতেন ও বিকাল বেলা ফুটপাতে বাচ্চাদের পোশাক বিক্রি করতেন। নাহিদুল ইসলাম বোরহানউদ্দিন উপজেলার বড় মানিকা ইউনিয়নের ৫নম্বর ওয়ার্ডের উত্তর বাটামারা গ্রামের আব্দুল জলিলের একমাত্র ছেলে। তিন মেয়ে ও এক ছেলের মধ্যে নাহিদ ছিল সবার ছোট।
নাহিদুল ইসলাম দৌলতখান হাজিপুর মাদরাসা থেকে ২০২৩ সালে আলিম পাশ করেন। পরে ভোলা সরকারি কলেজের দর্শন বিভাগে অনার্স প্রথম বর্ষে ভর্তি হন। গত দুই বছর আগে পারিবারিক অসচ্ছলতার কারণে চাকরি খোঁজে ঢাকায় পাড়ি জমায়। ঢাকার মিরপুর-৬ নম্বরে থেকে মোবাইল ব্যাংকিং বিকাশে চাকরি করতেন। বিকাল বেলা অবসর সময়ে মিরপুর-১০ নম্বরের ফুটপাতে বাচ্চাদের পোশাক বিক্রি করতেন। নিজে আয়-রোজগার করে পড়ালেখার খরচ চালানোর পাশাপাশি বাবা-মায়ের সংসারেও খরচ দিতেন। আশা ছিল পড়ালেখা করে ভালো কোনো যায়গায় চাকরি করে দরিদ্রতা দূর করে বাবা-মার মুখে হাসি ফোটাবেন। কিন্তু সেটি আর হলো না; বুলেটের আঘাতে অকালেই নিভে গেল নাহিদের জীবন প্রদীপ। নাহিদের অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুতে বাবা-মা, আত্মীয়-স্বজনসহ সবাইকে শোকে স্তব্ধ।
নাহিদের দিনমজুর বাবা আব্দুল জলিল বেপারী জানান, তার তিন মেয়ে ও এক ছেলের মধ্যে নাহিদ সবার ছোট। মেঘনার ভাঙনে ভিটেমাটি হারিয়ে তারা এখন নিঃস্ব। ১০ শতাংশ জমি কিনে কোনো মতে বসবাস তাদের। তিন মেয়ে বিয়ে দিয়েছেন। নিজে একটি স্ব-মিলে শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন। কিন্তু বার্ধক্যজনিত কারণে ঠিকমতো কাজও করতে পারেন না। ছেলে লেখাপড়ার পাশাপাশি চাকরি ও ব্যবসা করে সংসারে সহযোগিতা করতেন। নিজের পড়ার খরচ নিজেই চালাতেন।
তিনি আরো জানান, গত শুক্রবার (১৯ জুলাই) বিকাল ৩টার দিকে মুঠোফোনে কথা হয় নাহিদের সাথে। ছেলেকে বলেছিলেন, বাহিরে ঝামেলা চলে বাসা থেকে বের হওয়ার দরকার নাই। এ কথাই ছেলের সাথে শেষ কথা। বিকেল ৫টার দিকে খবর আসে নাহিদের গায়ে গুলি লেগে মারা গেছে। এর পর তার সাথে থাকা লোকজনের কাছে জানতে পারেন বিকেলে সাথে থাকা আরো লোকজনের সাথে বাহিরে চা খেতে যান। চা খেয়ে বাসায় ফেরার পথে মিরপুর-১০ নম্বরের গোল চত্বরের কাছে সংঘর্ষ চলাকালে গুলিবিদ্ধ হয় নাহিদ। সাথে থাকা লোকজন তাকে উদ্ধার করে একটি বেসরকারি ক্লিনিকে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। পরে সাথের লোকজনই বাড়িতে খবর দিয়ে একটি লাশবাহী গাড়িতে তুলে শনিবার সকালে বাড়িতে এনে সকাল ১০টার দিকে জানাজা শেষে বাড়ির পাশের মসজিদের কাছে দাফন করা হয়।
আব্দুল জলিল আরো জানান, তিনি নিজে স্ব-মিলে শ্রমিকের কাজ করতেন ও ছেলে পাঠানো টাকায় তার সংসার চলতো। ছেলেই ছিল তাদের একমাত্র ভরসা। সেই ছেলেকে বিনা অপরাধে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। এখন আর তাদের চলার মতো কোনো উপায় নেই। তারা ছেলে হত্যার বিচার দাবি করেন।
ব্যস্ত রাজধানী এখন ফাঁকা, জরুরি প্রয়োজন ছাড়া বের হচ্ছে না মানুষ
বড় মানিকা ইউনিয়নের ৫নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য মো. জাকির হোসেন জানান, আব্দুল জলিল খুব অসহায়। মেঘনার নদীর ভাঙনে ঘরভিটাসহ সকল সম্পদ হারিয়ে নিঃস্ব। কোনো মতে নিজে দিনমজুরি করে ও ছেলের দেয়া টাকায় সংসার চলতো। ছেলের অকাল মৃত্যু হওয়ায় এখন আর তাদের চলার মতো উপায় নেই। নাহিদের পরিবারকে ইউনিয়ন পরিষদের পক্ষ থেকে সাধ্যমতো সহায়তা করা হবে। এর পর যদি সরকারের পক্ষ থেকে কিছু করা হয় সেটিও পাওয়ার ব্যবস্থা করা হবে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।