হিলিয়াম গ্রিক শব্দ। সূর্যের গ্রিক নাম হেলিওস থেকে তিনি এ মৌলটির এমন নাম দেন। কারণ মৌলটি পৃথিবীতে আদৌ আছে বলে তখনো জানা ছিল না। এর অস্তিত্ব তখনো শুধু সূর্যের বুকে। যুক্তরাজ্যের রয়্যাল সোসাইটি অব কেমিস্ট্রির তথ্য অনুসারে, ইতালীয় পদার্থবিদ লুইস পালমিরি ১৮৮২ সালে মাউন্ট ভিসুভিয়াস থেকে নির্গত গ্যাসের তরঙ্গদৈর্ঘ্য মাপেন ৫৮৭ দশমিক ৪৯ ন্যানোমিটার। পৃথিবীতে হিলিয়াম শনাক্তের এটাই প্রথম রেকর্ড। কিন্তু তখনও হিলিয়ামের উপস্থিতি কেউ নিশ্চিত করতে পারেননি। এজন্য ১৮৯৫ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে।
স্কটিশ রসায়নবিদ উইলিয়াম রামসে ১৮৯৫ সালে হিলিয়াম আলাদা করেন। তখন সব সন্দেহ দূর হয়ে যায়। ওই বছরই রামসে আর্গন আবিষ্কার করেছিলেন। এটিই ছিল প্রথম আবিষ্কৃত নিষ্ক্রিয় গ্যাস। এই আবিষ্কারের পেছনে আরেকটু রহস্য আছে। হিলিয়াম আলাদা করার বছরখানেক আগে রামসে জার্মান পদার্থবিদ ইউলিয়াম হিলব্রান্ডের একটি গবেষণাপত্র পড়েছিলেন।
সেখান থেকে তিনি জানতে পারেন, ইউরেনিয়ামের আকরিকের সঙ্গে অ্যাসিড মেশালে ইউরেনাইট উৎপন্ন হয়। একই সঙ্গে উৎপন্ন হয় একটি গ্যাসও। হিলব্রান্ড ভেবেছিলেন, গ্যাসটি আসলে নাইট্রোজেন। তবে আমরা এখন জানি, তেজস্ক্রিয় ক্ষয়ের সময় ইউরেনিয়াম থেকে হিলিয়াম নির্গত হয়। এ কথা তখনকার বিজ্ঞানীরা জানতেন না। আরও অনেক পরে জানা গেছে। ১৮৯৬ সালে হেনরি বেকেরেলের কাজ প্রকাশিত হওয়ার আগ পর্যন্ত তেজস্ক্রিয়তার অস্তিত্বের স্বীকৃতি ছিল না।
যাইহোক, রামসের কথায় ফিরি। তিনি বিশ্বাস করতেন, হিলব্রান্ডের দেখা গ্যাসটি হয়তো আর্গন। তিনি আরেকটি ইউরেনিয়ামের আকরিক ‘ক্লেভাইট’ ব্যবহার করে আবারও পরীক্ষাটি করেন। এ সময় তিনি একটি গ্যাস পান। সেটা সংগ্রহ করে রাখেন আরও গবেষণার জন্য। বর্ণালিবীক্ষণ যন্ত্রে ওই গ্যাস নিয়ে তিনি দেখতে পান, নাইট্রোজেন ও আর্গনের পাশাপাশি আরও একটি মৌলের চিহ্ন রয়েছে এতে। প্রায় তিন যুগ আগে পাওয়া নরম্যান লকইয়ারের সেই হলুদ রেখাটি। তখন তিনি ধারণা করেন, গ্যাসটি হয়তো হিলিয়াম।
রামসে জানতেন, উইলিয়াম ক্রুকস ও নরম্যান লকইয়ারের কাছে তাঁর চেয়েও ভালো বর্ণালিবীক্ষণ যন্ত্র আছে। রামসে তাঁদের কাছে ওই গ্যসের কিছু নমুনা পাঠান আবার পরীক্ষা করে দেখার জন্য। দুর্ভাগ্যবশত নমুনাটি ভালো ছিল না। ফলে লকইয়ার পরীক্ষা করে ইউরেনাইটের একটি নমুনা পেয়েছিলেন মাত্র।
তবে রামসে হাল ছেড়ে দেননি। আবার পরীক্ষা করেন। বারবার পরীক্ষা করেও তিনি দেখেন, নাইট্রোজেন ও আর্গনের পাশাপাশি আরেকটি মৌলের চিহ্ন এতে আসলেই আছে। তিনি বুঝতে পারেন, এটাই হিলিয়াম। একই বছর সুইডিশ বিজ্ঞানী পার টিওডর ক্লিভ ও আব্রাহাম ল্যাংলেট আলাদাভাবে হিলিয়ামের পারমাণবিক ভর বের করেন। তখন সবার কাছে এই গ্যাসটি পরিচিতি পায়। জায়গা মেলে পর্যায় সারণিতে।
আগেই বলেছি, পারমাণবিক ভরের হিসেবে হিলিয়াম দ্বিতীয় সর্বোচ্চ হালকা গ্যাস। হাইড্রোজেনের তুলনায় প্রায় চার গুণ ভারী। বায়ুমণ্ডলে এর পরিমাণ মাত্র ০.০০০৫ শতাংশ। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে যে হিলিয়াম আছে, তা প্রথম জানা যায় ১৯০৩ সালে।
সাধারণত গ্যাস হিসেবেই পাওয়া যায় হিলিয়াম। তবে তাপমাত্রা কমালে কঠিন বা তরলেও পরিণত হতে পারে। এর স্ফুটনাঙ্ক এবং গলনাঙ্ক অন্য যেকোনো মৌলের চেয়ে কম। তাপমাত্রা মাইনাস ২৭১ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে নামলে পরিণত হয় সুপার ফ্লুইডে। তখন এর ওপর ঘর্ষণ বল আর কাজ করে না। হিলিয়াম অতিপরিবাহী হয়ে যায়। ফলে এর মধ্য দিয়ে তাপ বা বিদ্যুৎ চলতে কোনো বাধা পায় না।
হিলিয়াম বিষাক্ত নয়। এটি পরম শূন্যের কাছাকাছি তাপমাত্রায়ও দ্বিপরমাণুক অণু গঠন করতে পারে। অর্থাৎ এর অণুতে হিলিয়ামের দুটি পরমাণু একসঙ্গে থাকে। নিষ্ক্রিয় গ্যাসগুলো সাধারণ চাপ ও তাপে অল্প কিছু বিক্রিয়ায় অংশ নিলেও হিলিয়ামের সে বালাই নেই। অনেক বছর ধরে হিলিয়াম ফ্লোরাইড বানানোর চেষ্টা করেও বারবার ব্যর্থ হয়েছেন বিজ্ঞানীরা। তবে হিলিয়ামকে আয়নিত করলে বা চাপ প্রয়োগ করলে যৌগ গঠন করে। যেমন উচ্চ চাপে ডাইসোডিয়াম হ্যালাইড (HeNa2) যৌগ গঠন করে।
এবার হিলিয়ামের ব্যবহার সম্পর্কে একটু জানা যাক। হিলিয়াম সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় এমআরআই মেশিনে। এ যন্ত্রটিকে সব সময় ঠান্ডা রাখতে হয়। সেজন্য ব্যবহার করা হয় মাইনাস ২৬৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার হিলিয়াম। এ মৌলটি না থাকলে এমআরআই মেশিনে মারাত্মক বিস্ফোরণ ঘটত।
এ ছাড়া বেলুনে হিলিয়াম ভরে বাতাসে ওড়ানো যায়। হাইড্রোজেন দিয়েও এ কাজ চালানো যায়। কিন্তু হাইড্রোজেন অত্যন্ত দাহ্য পদার্থ। তাই এটি বেলুনে বেশি ব্যবহৃত হয় না। এর বদলে হিলিয়াম ব্যবহৃত হয়। তবে হাইড্রোজেনের তুলনায় হিলিয়ামের দাম বেশি।
রকেটের জ্বালানী হিসেবেও ব্যবহৃত হয় তরল হিলিয়াম। ডুবুরিদের সিলিন্ডারেও অক্সিজেনের পাশাপাশি ব্যবহৃত হয়। পানির তলায় মূল সমস্যা হলো নিঃশ্বাস নেওয়া। এ জন্য ডুবুরিরা সিলিন্ডারে করে বাতাস নিয়ে যান। বাতাসে ২১ শতাংশ অক্সিজেন, বাকি প্রায় পুরোটা নাইট্রোজেন। অক্সিজেনের চেয়ে এর পরিমাণ বেড়ে গেলে সমস্যা হয়। আবার সিলিন্ডারে শুধু অক্সিজেন নেওয়া সম্ভব নয়। কারণ, তখন শ্বসনপ্রক্রিয়া অনেক বেড়ে যাবে। নাইট্রোজেনের বদলে অন্য কোনো ছোট অণুর গ্যাস ব্যবহার করা যেতে পারে। কিন্তু সেটা দেহের ভেতরে ঢুকে কোনো বিক্রিয়ায় অংশ নিতে পারবে না। সেজন্যই এ ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয় হিলিয়াম।
২০১১ সালে এক পরীক্ষা থেকে পাওয়া গেছে অ্যান্টিহিলিয়াম। অর্থাৎ, হিলিয়ামের প্রতিকণা। মহাবিশ্বের সবচেয়ে বড় প্রতিকণাকে পেতে প্রায় আলোর গতিতে আয়নিত স্বর্ণকণাদের সংঘর্ষ ঘটাতে হয়। ফলে বেরিয়ে আসে ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন কণা। তার মধ্যেই পাওয়া গেছে হিলিয়ামের প্রতিকণা। ভবিষ্যতে হয়তো হিলিয়াম নিয়ে আরও নানারকম গবেষণা হবে। তখন হয়তো আরও বেড়ে যাবে হিলিয়ামের ব্যবহার।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।