ইতিহাসে প্রথমবার আলোর বেগ মাপার চেষ্টা করেন ইতালীয় বিজ্ঞানী গ্যালিলিও গ্যালিলি। কথিত আছে, ১৬৩০-এর দশকে সেরকম একটা চেষ্টা করেন তিনি। অবশ্য অনেকের ধারণা, পিসার হেলানো মিনার থেকে দুটি ভিন্ন ভরের বস্তু ফেলা নিয়ে গ্যালিলিওকে নিয়ে যেরকম কাল্পনিক গল্প চালু আছে, এই গল্পটাও অনেকটা সেরকম। অর্থাৎ স্রেফ গালগল্প। তবে বিষয়টা বোঝার সুবিধার্থে সেই গল্পটাই এখানে সংক্ষেপে বলছি।
কথিত আছে, সেবার এক সহকারীকে সঙ্গে নিয়ে একটা পরীক্ষা চালান গ্যালিলিও। পরীক্ষায় দুটি বিশেষ ধরনের লণ্ঠন ব্যবহার করা হয়েছিল। লণ্ঠনের ভেতর মোমবাতি ঢেকে রাখা যেত। প্রয়োজনে তা খুলে ফেলা যেত, যাতে একটা নির্দিষ্ট সময় আলোর সংকেত পাঠানো যায়।
পরীক্ষাটার জন্য এক অন্ধকার রাত বেছে নেন গ্যালিলিও। দূর থেকে ছোট্ট আলোর ঝলক যাতে সহজে দেখা যায়, সে জন্যই রাতে চালানো হয় পরীক্ষাটা। কাছাকাছি দুটি পাহাড়ের চূড়ার একটাতে ওঠেন গ্যালিলিও। আরেকটায় তাঁর সহকারী। চূড়ায় উঠে প্রথমেই নিজের লন্ঠনের ঢাকনা খুলে দেন গ্যালিলিও। মানে আলোর সংকেত পাঠান তাঁর সহাকারীকে। অন্য পাহাড়ের চূড়া থেকে তাঁর সহকারী গ্যালিলিওর লন্ঠনের আলোর ঝলক দেখতে পান। সঙ্গে সঙ্গে গ্যালিলিওর সহকারী নিজের লণ্ঠনের ঢাকনা খুলে দেন। যাতে আলোর ঝলক দেখতে পান গ্যালিলিও।
এবার নিজে আলোর সংকেত পাঠানোর মুহূর্ত এবং সহকারীর আলোর ঝলক দেখার মুহূর্তের মধ্যবর্তী সময় মেপে ফেলেন গ্যালিলিও। সেদিন পরীক্ষাটি করা হলো বেশ কয়েকবার। পরে দুই ঝলক দেখার মধ্যবর্তী সময়গুলো গড় করা হলো। কিন্তু ফলাফল যা পাওয়া গেল, তা মোটেও সন্তোষজনক নয়।
এখানে একটা বিষয় মাথায় রাখতে হবে, এক পাহাড়ের চূড়া থেকে আরেক চূড়ায় আলো যেতে এবং ফিরে আসতে যে সময় লেগেছিল, অন্তত তার কিছু অংশ লেগেছিল দুজনের প্রতিক্রিয়ার কারণে। অর্থাৎ গ্যালিলিওর পাঠানো সংকেত দেখে তাঁর সহকারীর লন্ঠনের ঢাকনা খুলতে এবং সেই সংকেত দেখে সময় গণনা করতে কিছুটা সময় লেগেছিল। সেটুকু আসলে বাড়তি সময়।
নিজেদের প্রতিক্রিয়ার এই সময়টুকু বাদ দিতে এরপর আবারও পরীক্ষাটি করেন গ্যালিলিও। এবার এমন দুটি পাহাড়ের চূড়া বেছে নেন, যেগুলো আগের দুটোর চেয়ে বেশ দূরে অবস্থিত। গ্যালিলিও ধারণা করলেন, তাঁর সহকারীর প্রতিক্রিয়া আগের মতোই হতে পারে। কিন্তু এবার আলোকে আগের চেয়ে বেশি দূরত্ব পাড়ি দিতে হবে। তাই আশা করলেন, বাড়তি যে সময়টুকু লাগবে, তার মধ্যেই আলো ওই বাড়তি দূরত্বটুকু অতিক্রম করবে।
কিন্তু ফলাফল পাওয়া গেল বিস্ময়কর। দেখা গেল, আলোর কোনো বাড়তি সময় লাগছে না। প্রথমবার কাছাকাছি দুটো পাহাড়চূড়ায় চালানো পরীক্ষায় আলোর জন্য যে সময় পাওয়া গিয়েছিল, পাহাড়চূড়া দুটো দূরে হলেও মধ্যবর্তী দূরত্ব পাড়ি দিতে আলোর বাড়তি কোনো সময় লাগছে না। দুক্ষেত্রেই সময় লাগছে একই পরিমাণ। পরীক্ষায় যে অতিরিক্ত সময় লাগছে, সেটা আসলে দুজনের প্রতিক্রিয়ার সময়, আর কিছু নয়। আসলে আলো এত দ্রুত চলাচল করে যে লম্বা দূরত্বের জন্য যেটুকু বাড়তি সময় লাগে, তা এত ছোট যে গ্যালিলিওর পক্ষে সে যুগে তা মাপা অসম্ভব ছিল।
কারণ ভগ্নাংশ সময় মাপার মতো প্রযুক্তি গ্যালিলিওর যুগে ছিল না। এমনকি সম্ভব ছিল না সঠিকভাবে সময় মাপাও। কারণ তখনও ভালো ঘড়ি উদ্ভাবিত হয়নি। কাজেই পরীক্ষা শেষে গ্যালিলিও শুধু এটুকুই বলতে পারলেন যে আলো খুব খুবই দ্রুত চলাচল করে।
বিজ্ঞানের ইতিহাসবিদদের ধারণা, গ্যালিলিও সশরীরে এমন কোনো পরীক্ষা কখনও করেননি। তবে এরকম একটা পরীক্ষার কথা তিনি সত্যি সত্যিই ভেবেছিলেন। ১৬৩৮ সালে আলোর বেগ মেপে দেখার একটা উপায় প্রস্তাব করেন গ্যালিলিও। পরীক্ষাটা এরকম: বাতি নিয়ে দুই পর্যবেক্ষক পরস্পর থেকে বেশ কিছুটা দূরে দাঁড়াবে।
প্রথম পর্যবেক্ষক বাতির আলো ব্যবহার করে দ্বিতীয় জনের কাছে একটা সংকেত পাঠাবে। সংকেত পেয়ে দ্বিতীয় পর্যবেক্ষক আলোর একটা ফিরতি সংকেত পাঠাবে। প্রথম পর্যবেক্ষক তার পাঠানো সংকেত এবং ফিরতি সংকেত পাওয়ার মধ্যবর্তী সময় মেপে আলোর গতি নির্ণয় করতে পারবে। এতক্ষণ যে পরীক্ষার কথা বললাম, সেটাই আরকি।
কিন্তু গ্যালিলিও নিজে কখনও এ পরীক্ষা করে দেখতে পারেননি। কারণ তিনি তখন গৃহবন্ধী। প্রায় অন্ধ। চোখে ঝাপসা দেখেন। আসলে গ্যালিলিওর মৃত্যুর প্রায় ২৫ বছর পর, ১৬৬৭ সালে পরীক্ষাটি করে দেখেন ইতালির ফ্লোরেন্সের বিখ্যাত সায়েন্টিফিক সোসাইটি অ্যাকাডেমিয়া দেল কিমেন্টো।
এ পরীক্ষায় রাতের অন্ধকারে প্রায় এক মাইল দূরে দুজন পর্যবেক্ষক রাখা হয়, যাঁদের হাতে ছিল দুটি বাতি। তবে এতে আলোর চলাচলে কোনো বিলম্ব খুঁজে পাননি পর্যবেক্ষকেরা। তবে এ পরীক্ষা থেকে সিদ্ধান্ত টানা হয়, আলোর গতি ঘন্টায় ১০ হাজার কিলোমিটার থেকে অসীমের মাঝখানের কোনো একটা সংখ্যা।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।