ইবি প্রতিনিধি: ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে (ইবি) দেশরত্ন শেখ হাসিনা হলে ছাত্রী নির্যাতনের ঘটনায় অভিযুক্ত ছাত্রলীগ নেত্রীর বিরুদ্ধে মুখ খুলছেন হলের আবাসিক শিক্ষার্থীরা। দেশরত্ন শেখ হাসিনা হলের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায় যে অন্তরাই হলের নীতি নীর্ধারক। অন্তরা মানেই এক মূর্তীয়মান আতঙ্ক। তিনি হলে বেপরোয়া ভাবে একক আধিপত্য চালিয়ে জুনিয়র ছাত্রীদের উপর বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কায়দায় নির্যাতন চালায়। তাঁর কথার বাহিরে গেলে নেমে আসে নির্যাতনের খড়ক।
ঘটনার সময় পাশের গণরুমে থাকা কয়েকজন ছাত্রী ভুক্তভোগীর উপর নির্যাতনের বর্ণনা দিয়েছে। তাঁদের সবার কথা কমবেশি একইরকম। তাঁদের ভাষ্য অনুযায়ী, অন্তরারা নির্দেশে ভুক্তভোগীকে গনরুম দোয়েল ১ এ নিয়ে আসা হয়। আসা মাত্রই চারদিক থেকে এলোপাতাড়ি মারধর শুরু হয়। কেউ বলে ওর মুখে মার ওর চেহারা ইয়ে করে দে। মেয়েটা তখন কান্না করছিলো।
নির্যাতনকারীরা বলতেছিলো, তুই এ সাহস কী করে পাশ। আমাদের নামে র্যাগিংয়ের অভিযোগ দিশ। র্যাগিং কী এখন দেখাচ্ছি তোকে, এখন র্যাগিং সত্যি সত্যি তোকে দেখাবো। উর্মী, মীমকে বলে ওর মুখে মারিস না। মুখে দাগ লেগে যাবে। শরীরে মার। কেউ কেউ বলছিলো যে মারিস না। বাচ্চা মেয়ে ভুল করে ফেলেছে। যারা বলছিলো মারিস না, তাঁদের বলে যে তোঁদের যদি এত মায়া দয়া হয়, তাহলে তোঁরা রুম থেকে বের হয়ে যা।
একপর্যায়ে তাঁরা ওই ছাত্রীকে প্রভোস্টের বিরুদ্ধে গালাগালি দিতে বলে এবং ভিডিও করে। এমন নির্যাতন রাত সাড়ে তিনটা পর্যন্ত চলতে থাকে। পরে বাংলা বিভাগের এক শিক্ষার্থীর পরীক্ষা থাকায় সে চেচিয়ে বললে নির্যাতনকারীরা ভূক্তভোগীকে হলের ডাইনিংয়ে নিয়ে যায়। সেখানে তাকে গ্লাস চেটে পরিস্কার করানো হয়।
চাঞ্চল্যকর এ ঘটনা গণমাধ্যমে আসায় ভুক্তভোগী ছাত্রীর বিচার দাবিতে আন্দোলন করেন অভিযুক্ত ওই ছাত্রলীগ নেত্রী ও তাঁর অনুসারীরা। অভিযুক্ত নেত্রী ও পাল্টা লিখিত অভিযোগ দেন প্রক্টর, ছাত্র-উপদেষ্টা ও হল প্রভোস্ট বরাবর।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এ রকম ঘটনা এর আগেও ঘটছিলো অন্যদের সাথে। হলের সিনিয়র এক শিক্ষার্থীকে জোর করে সিট থেকে নামিয়ে অন্য রুমে দিয়ে দেন। তাকে অন্তরা সরাসরি মেরে ফেলার হুমকি দেন। শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করেন অই শিক্ষার্থীকে। কিছু হলেই বাড়িতে কল দেওয়ার হুমকিতে রাখেন অই শিক্ষার্থীকে।
শিক্ষার্থীরা আরও বলেন, আমাদের উপর জোর করে ওনার ইচ্ছামত যেকোনো কিছু চাপিয়ে দিতো। সম্প্রতি বন্ধন ৩২ এর কনসার্ট প্রোগ্রামে সবাইকে বাধ্যতামূলক টি-শার্ট নেওয়ার নির্দেশ দেন। আমরা সবাই বললাম আপু আমাদের আর্থিক সমস্যা চলছে ৪০০ টাকা দিয়ে টি শার্ট নেওয়া সম্ভব না। আপু বলে টি-শার্ট নিতেই হবে। না হলে রুম থেকে বের করে দিবো। মিটিংয়ে না গেলে ভয়ভীতি দেখায়। জোর করেই নিয়ে যেতো। আপুর ভয়ে আমরা মুখ খুলতে পারি না। হল থেকে বের করে দিবে এ ভয়ে আমরা সবসময় তটস্থ থাকি। ক্ষমতা পাওয়ার পর আপু সবকিছু বেশি বেশি করছে। হলে যে কেউ অন্য কোনো ভুল করলে সব দোষ জুনিয়রদের চাপিয়ে দিতো। বেসিনে ময়লা ফেলে জ্যাম করছে অন্য কেউ। দোষ দিতো জুনিয়রদের।
ইতিমধ্যে চাঞ্চল্যকর এ ঘটনায় জড়িত মোট পাঁচ জন শিক্ষার্থীর নাম জানা গেছে। তারা হলেন- পরিসংখ্যান বিভাগের শিক্ষার্থী শাখা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি সানজিদা চৌধুরী অন্তরা, ফাইন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগের তাবাসসুম, আইন বিভাগের ইসরাত জাহান মীম, ফাইন আর্টস বিভাগের হালিমা খাতুন উর্মী ও ফিন্যান্স এন্ড ব্যাংকিং বিভাগের মাওয়াবিয়া। এরা চারজনই ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী।
বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের কয়েকজন কর্মী ও সাধারণ শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, গত বছরের জুলাই মাসের ৩১ তারিখ রাতে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটি ঘোষিত একটি কমিটিতে সানজিদা চৌধুরী অন্তরা সহ-সভাপতি হিসেবে মনোনীত হয়। সিভি না পাঠিয়েও তিনি ছাত্রলীগের সহ-সভাপতির পদ পেয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি ফয়সাল সিদ্দিকী আরাফাতের অনুসারী হওয়ায় সহজেই পদ পেয়ে যান সানজিদা চৌধুরী অন্তরা।
আরো জানা যায়, এই পদে মনোনীত হওয়ার আগে ছাত্রলীগের কোন কর্মসূচীতে দেখা না গেলেও পদ পেয়েই গণরুমসহ দেশরত্ন শেখ হাসিনা হলে একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন অন্তরা। তাঁর ১৫/২০ অনুসারী নিয়েই হলের নিয়ন্ত্রণ নেন। আবাসিক হলটির গণরুমে থাকা ছাত্রীদের কাছে তার নামই যেন আতঙ্ক । এছাড়া তার মাফিয়া বাহিনী হিসেবে কাজ করে গণরুমে থাকা তার কয়েকজন জুনিয়র সহযোগীরা। অন্তরার বিরুদ্ধে একাধিক ছাত্রী বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
এছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নাসিম আহমেদ জয়ের সাথেও তার গভীর সখ্যতা রয়েছে। যার কারণে হলজুড়ে খুব দ্রুতই আধিপত্য বিস্তার করে ফেলেছিলো অন্তরা। তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় জোরপুর্বক ছাত্রীদের মিছিলে নিয়ে আসার অভিযোগ রয়েছে। মিছিলে না আসলে তাদের ওপর নির্যাতন চালানো হয় বলে হলের একাধিক শিক্ষার্থী জানিয়েছেন। প্রায়ই জুনিয়র ও হলের অন্য মেয়েদের নানা ভাবে হেনস্থা করার অভিযোগ করেছেন ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতা। শীর্ষ নেতাদের প্রশ্রয় থাকার কারণে সে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে বলে সবার ধারণা। হলের ছাত্রীরা ফুলপরীর সাথে যে ঘটনা ঘটেছে তাতে সানজিদার উপযুক্ত বিচারও চান। এমনকি সংবাদ প্রকাশ হওয়ার পরে মধ্যরাতে প্রথম বর্ষ ও দ্বিতীয় বর্ষের গণরুমে থাকা ছাত্রীদের জোরপূর্বক আন্দোলনে নামানোর অভিযোগ রয়েছে অভিযুক্ত ছাত্রলীগ নেত্রীর বিরুদ্ধে। এছাড়াও তিনি নিজ বিভাগের পরীক্ষায় বিভিন্ন অনৈতিক পন্থা অবলম্বনের দায়ে শাস্তি পেয়েছিলেন।
এদিকে ঘটনার তদন্তের সহায়ক হিসেবে থাকা ঘটনাস্থলের সিসিটিভি ফুটেজ গায়েব হওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে। সেদিন রাতে কি ঘটেছিল, সেটার তথ্য সিসিটিভি ফুটেজে পাওয়ার সম্ভাবনা থাকলেও সে ফুটেজ মিলছে না। তদন্ত কমিটি ফুটেজ দেখতে গিয়ে সেখানে ১৯৭০ সালের ফুটেজ দেখতে পায়। সিসিটিভির যন্ত্রের বায়োসের ব্যাটারি নষ্ট হয়ে যাওয়ায় ফুটেজে এতো পুরাতন তারিখ শো করছে বলে জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের আইসিটি সেলের পরিচালক ড. আহসানুল আম্বিয়া।
ড. আহসানুল আম্বিয়া বলেন, ওই ব্যাটারির মাধ্যমে সিসি ফুটেজে তারিখ ও সময় দেখা যায়। সেটি নষ্ট থাকায় ইনিশিয়াল ডেট এ চলে গেছে। ফুটেজ হার্ডডিস্কে থাকার কথা। সেখান থেকে রিকভারি করার চেষ্টা চলছে।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে দেশরত্ন শেখ হাসিনা হলের প্রভোস্ট ড. শামসুল আলম বলেন, আমরা হলে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে অন্তরার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ থাকলে সাধারণ শিক্ষার্থীদের জানাতে আহ্বান করেছি। এতদিন কেউ কিছু বলেনি। তাই এ অবস্থা। আশা করি সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে।
ফুটেজ গায়েবের বিষয়ে প্রভোস্ট বলেন, টেকনিক্যাল ত্রুটির কারণে আমরা এখনো ফুটেজ পাইনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সেন্টারকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। হার্ডডিস্কে ট্রাবল হওয়ায় ফুটেজ শো করছে না। দুই-একদিনের মধ্যে সব পাওয়া যাবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে মুঠোফোনে কয়েকবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও এ বিষয়ে তাঁর সাথে কথা বলা সম্ভব হয়নি।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।