জুমবাংলা ডেস্ক: মধ্যপ্রাচ্যে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জন, দীর্ঘমেয়াদি শান্তি প্রতিষ্ঠা এবং ইসরাইল ও আমেরিকার সাথে আরববিশ্বের বিরোধ ও দ্বন্দ্বের চিরস্থায়ী অবসানের ক্ষেত্রে ইসরাইল-ফিলিস্তিন সমস্যার চিরস্থায়ী একটা সমাধান হওয়া সে খুবই গুরুত্বপূর্ণ, তা বিশ্বের রাজনীতি সচেতন সব মানুষই বোধহয় কমবেশি জানেন। বিশেষ করে ‘ইসরাইল বনাম আরববিশ্ব’ মনোভাব বা দ্বন্দ্ব আরবি ভাষার ও আরব ভূখন্ডের গন্ডি পেরিয়ে সময়ের সাথে ক্রমে যেভাবে ‘ইসরাইল বনাম মুসলিম বিশ্ব’ মনোভাব বা দ্বন্দ্ব হিসেবে রূপ ধারণ করেছে, তা একজন বাংলাদেশি মুসলমান হিসেবে সেই রাজনৈতিক প্রাথমিক জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই সবার কাছে বেশ কৌতূহলপূর্ণ একটা বিষয়। আজ আপনাদের জন্য রয়েছে পঞ্চম পর্ব।
১৯৬৭ সালে ইসরাইল-আরব যুদ্ধের সূত্রপাত হয় মূলত ইসরায়েলের সাথে পার্শ্ববর্তী আরবদেশগুলোর রাষ্ট্র সীমানায় সংঘটিত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ও বিচ্ছিন্ন অনেকগুলো সংঘর্ষের ঘটনা ঘটার মাধ্যমে যা ইসরায়েলের সাথে প্রতিবেশী আরবদেশগুলোর এতদপূর্বে সৃষ্ট উত্তেজনাকে আরও বৃদ্ধি করে। ১৯৬৭ সালের মে মাসে সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছে থেকে সিরিয়ান বর্ডারের অনতিদূরে ইসরায়েলি সীমানায় ইসরায়েলের সৈন্য সমাবেশের মিথ্যে সংবাদ পেয়ে ঈজিপ্ট ইসলায়েলি সীমানার কাছাকাছি সিনাই ভূখন্ডে সৈন্য সমাবেশ করে এবং জর্ডানের সাথে এক সামরিক চুক্তিতে স্বাক্ষর করে।
জর্ডান ইসরায়েলি সীমানার কাছাকাছি নিজস্ব সৈন্য মোতায়েন করে এবং জর্ডানের আহ্বানে আগত একদল ইরাকি সৈন্য জর্ডানি সৈন্যদের সাথে যোগ দেয়। ইতিমধ্যে ঈজিপ্ট ১৯৫৭ সালের জাতিসংঘের নৌচুক্তি ভঙ্গ করে ইসরাইল কর্তৃক ব্রবহৃত সুয়েজ খালের নৌ চলাচলের পথ বন্ধ করে দিলে ইসরাইল ঈজিপ্টের নৌচুক্তি ভঙ্গকে যুদ্ধের বৈধতা দানের আজুহাতে ১৯৬৭ সালের ৫ জুন আকস্মিকভাবে পার্শ্ববর্তী আরবদেশেগুলোতে সামরিক স্থাপনা ও সন্নিবেশিত সৈন্যদের ওপর বিমান হামলা চালায়। ব্রিটিশ এবং বিশেষ করে মার্কিন আর্থিক ও সামরিক সাহায্যপুষ্ট, শক্তিশালী ইসরাইল মাত্র ছয়দিনব্যাপী এই যুদ্ধে সহজেই বিজয় লাভ করে।
ইসরাইল এই যুদ্ধে ঈজিপ্ট নিয়ন্ত্রিত সিনাই ভূখ, জর্ডান নিয়ন্ত্রিত ওয়েস্ট ব্যাংক ও ইস্ট জেরুজালেম এবং সিরিয়া নিয়ন্ত্রিত গোলান হাইট্স দখল করে নেয়। অবশ্য ১৯৭৯ সালে এক শান্তি চুক্তির মাধ্যমে ঈজিপ্টকে সিনাই ভূখ- ফিরিয়ে দেয় ইসরাইল। ইহুদি রাষ্ট্রপন্থি ও ইসরায়েলিদের অনেকে এই যুদ্ধকে প্রতিরক্ষামূলক যুদ্ধ বলে দাবি করলেও বিশ্বের অধিকাংশ ইতিহাসবিদ, দার্শনিক ও রাজনৈতিক বুদ্ধিজীবীদের অভিমতে প্রতিবেশী আরবদেশগুলোর ওপর ইসরায়েলের এই সামরিক হামলা ছিল সুস্পষ্ট আগ্রাসন।
ইসরায়েলিদের দখলকৃত অংশে তথা স্বভূমিতে ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের মানবেতর জীবনযাপন, আন্তর্জাতিক নির্দেশ উপেক্ষা করে ফিলিস্তিনি ভূমিতে ইসরায়েলিদের প্রক্রিয়াগতভাবে ও পর্যায়ক্রমে ইহুদি বাসস্থান স্থাপন এবং স্বল্পসংখ্যক ফিলিস্তিনি যোদ্ধার বিচ্ছিন্ন সন্ত্রাসী হামলার পরিপ্রেক্ষিতে ফিলিস্তিনি শরণার্থী শিবিরগুলোতে ইসরায়েলিদের পরিকল্পিত সামরিক অভিযান চালিয়ে অসংখ্য নিরীহ ফিলিস্তিনি নারী পুরুষ ও শিশুদের হত্যার ঘটনায় ধীরে ধীরে ইসরাইল বিরোধী মনোভাবের জন্ম হয়েছে বিশ্বব্যাপী।
এবং তারই ধারাবাহিকতায় জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে রাজনৈতিক সচেতন ও মানবতাবাদী অসংখ্য মানুষ ফিলিস্তিনিদের নিজস্ব ভূখন্ড ফিরে পাওয়ার ন্যায়সঙ্গত দাবির সমর্থনে এবং ফিলিস্তিনিদের প্রতি সহমর্মিতা প্রকাশের জন্য দেশে দেশে ইসরায়েলি সামগ্রী বর্জন করেছেন। ইসরাইল-ফিলিস্তিন সমস্যার স্থায়ী সমাধান বর্তমান বিশ্ব রাজনীতিতে ক্রমে সর্বাধিক কাক্সক্ষত রাজনৈতিক সমাধান হিসেবে পরিগণিত হয়েছে।
মজার ব্যাপার হলো ১৯৬৭ সালে প্রতিবেশী আরবদেশগুলোর ওপর অতর্কিত সামরিক হামলা চালিয়ে ইসরায়েলের আরব ভূখ- দখল করে নেওয়া আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে যেখানে সুস্পষ্ট আগ্রাসন হিসেবে বিবেচিত এবং যে কারণে ইউরোপসহ বিশ্বের অধিকাংশ দেশ ১৯৬৭ সালের ইসরাইল-আরব যুদ্ধপূর্ব মানচিত্র অনুযায়ী ইসরালেয়ের সীমানা প্রত্যাহারের পক্ষে, সেখানে জাতিসংঘের অসংখ্য সম্মেলনে আরব লীগ কর্তৃক উত্থাপিত এবং এশিয়া ও ইউরোপের অধিকাংশ দেশ কর্তৃক সমর্থিত ইসরায়েলের সীমানা প্রত্যাহারের প্রস্তাবিত বিল প্রতিবার পরাজিত হয়েছে নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য ও ভোট প্রদানের ক্ষমতাধারী আমেরিকার একমাত্র ভেটো প্রদানের কারণে।
বিভিন্ন সূত্রমতে এ যাবৎকাল দখলকৃত ফিলিস্তিনি ভূমিতে ইসরাইল কর্তৃক অসংখ্য বেসামরিক ফিলিস্তিনিকে হত্যার প্রতিবাদে নিন্দা জানিয়ে নিরাপত্তা পরিষদে উত্থাপিত চল্লিশটারও বেশি বিল আমেরিকার ভেটোর কারণে পরাজিত হয়েছে। সেই ১৯৬২ সাল থেকে অদ্যাবধি আমেরিকা ১০০ বিলিয়ন ডলারের অধিক অর্থ সাহয্য প্রেরণ করেছে ইসরায়েলে অনুদান হিসেবে।
আজ আমেরিকার জাতীয় আর্থিক ঘাটতি যেখানে প্রায় ১৪ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার, অধিকাংশ স্থানীয় ও প্রাদেশিক সরকার যেখানে নিজস্ব বাজেট ঘাটতি পূরণে অপারগ, জাতীয় বেকারত্ব যেখানে প্রায় ১০ শতাংশ সেখানে আগামী ২০১৩ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ইসরায়েলের সামরিক খাতে প্রতি বছর ৩.১৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অর্থ সাহায্য পাঠানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছে আমেরিকা। তো আমেরিকার এহেন নগ্ন, চরম পক্ষপাতপুষ্ট ও অন্ধভাবে ইসরাইলকে সমর্থন করার এবং ইসরায়েলের সামরিক খাতে প্রতিবছর বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার অর্থ সাহায্য পাঠানোর ও সর্বতোভাবে ইসরায়েলের স্বার্থ রক্ষার সুস্পষ্ট কারণ আছে যা আলোচনা করা হবে আগামী পর্বে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।