জুমবাংলা ডেস্ক: মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলোর মাঝখানে ছোট্ট একটি দেশ ইসরায়েল। ১৯৪৮ সালের ১৪ই মে ফিলিস্তিন ছেড়ে যায় ব্রিটেন, আর ইহুদিরা ঘোষণা করে নিজস্ব রাষ্ট্র ইসরায়েলের। তখন থেকেই ইসরায়েল রাষ্ট্র শুধু টিকেই থাকেনি, বরং তাদের পরিধি আরো বাড়িয়েছে। গত ৭৫ বছরে ইসরায়েল রাষ্ট্র হিসেবে একদিকে যেমন শক্তিশালী হয়েছে, অন্যদিকে আরব রাষ্ট্রগুলোর মাথা ব্যথার কারণ হয়েছে।
মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলের একমাত্র পরমাণু শক্তিধর দেশ ইসরায়েল। তারাই একমাত্র দেশ যারা শুধু ধর্মের ভিত্তিতে সরাসরি নাগরিকত্ব দেয়, সেটা পৃথিবীর যে প্রান্তেরই ইহুদি হোক না কেন। ৭৫ বছরে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, অর্থনীতি বা সামরিক দিক দিয়ে বিশ্বে একটা শক্ত অবস্থান তৈরি করেছে ইসরায়েল।
দেশটির কথা উঠলেই হারানো ইতিহাসের নানা বাঁকের কথা ফুটে ওঠে। এভাবেই ইসরায়েলের ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা এক মানুষও ফিরে আসছেন আলোচনায়, যাকে জিনিয়াস বললেও হয়তো কম বলা হবে। অ্যালবার্ট আইনস্টাইন! ইসরায়েলের প্রেসিডেন্ট হওয়ার প্রস্তাব তিনি না ফেরালে ইতিহাসে লেখা থাকত নোবেলজয়ী বিজ্ঞানীর জীবনের এক অন্য অধ্যায়। হয়তো কিংবদন্তির চরিত্রের আরও অন্য কোনো দিক ঝিকিয়ে উঠত জীবনের শেষবেলায়।
কিন্তু কেন ফিরিয়ে দিয়েছিলেন তিনি এক দেশের রাষ্ট্রপ্রধান হওয়ার এমন এক মহার্ঘ প্রস্তাব? সেই উত্তর দেওয়ার আগে একটু প্রেক্ষাপটটা বোঝা যাক। আচমকাই কিন্তু তাকে এমন প্রস্তাব দেয়নি ইসরায়েল। আসলে ইসরায়েলের সঙ্গে আইনস্টাইনকে জড়িয়ে রেখেছিল তার ‘ইহুদি’ পরিচয়। নাৎসিদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সোচ্চার মন, জার্মানিতে হিটলারের ইহুদি নিধনের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠা- কোথায় যেন তার কর্মকাণ্ডের বিশ্বব্যাপী খ্যাতির সমান্তরালে ইহুদি পরিচয়টিকেও এক অন্য মাত্রা দিয়েছিল। ইসরায়েলের জেরুজালেমে হিব্রু বিশ্ববিদ্যালয় গড়ার কাজে নিজের ব্যক্তিগত সম্পত্তিও দান করে দিয়েছিলেন তিনি।
এদিকে ১৯৪৮ সালে ব্রিটিশ শাসনের হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার পরে ইসরায়েলের প্রথম প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন চেম ওয়েজম্যান। প্রসঙ্গত, ওয়েজম্যান ছিলেন আইনস্টাইনের খুব ভালো বন্ধু। ১৯২১ সালে তিনিই আইনস্টাইনকে আমেরিকায় নিয়ে আসায় বিশেষ ভূমিকা নেন। সেই শ্রদ্ধা ও ভালবাসা অটুট ছিল আজীবন। তা এহেন ওয়েজম্যান দেশের প্রেসিডেন্ট হওয়ার পরের বছরই এক বক্তৃতায় ঘোষণা করেন, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম ইহুদি ব্যক্তিত্বের নাম অ্যালবার্ট আইনস্টাইন। এই ঘোষণার আবডালেই কোথায় যেন আইনস্টাইনের ছায়া এসে পড়েছিল সেদেশের শীর্ষ পদটির উপরে। নিঃসন্দেহে পরবর্তী সময়ে দেওয়া প্রস্তাবটির পেছনে দেশের রাষ্ট্রপ্রধানের ভালোবাসা থেকে সাধারণ মানুষের অবিমিশ্রিত শ্রদ্ধা এক অনিবার্য ক্যাটালিস্ট হিসেবে কাজ করেছিল।
মাত্র চার বছর প্রেসিডেন্ট থাকার পরে ১৯৫২ সালে মারা যান ওয়েজম্যান। তার ঠিক সপ্তাহখানেকের মধ্যেই ইসরায়েলের দূতাবাস থেকে একটি চিঠি পান আইনস্টাইন। সেই চিঠিতেই ছিল ইসরায়েলের প্রেসিডেন্ট হওয়ার প্রস্তাব। সেই সময় আইনস্টাইন আমেরিকার নাগরিক। মাত্র বছর কয়েক আগে, ১৯৪০ সালে মার্কিন নাগরিকত্ব পেয়েছেন। তার আগে পর্যন্ত সুইজারল্যান্ডের নাগরিক ছিলেন বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী। কিন্তু জার্মানিতে আর ফিরে যাওয়ার কথা ভাবেননি, এমতাবস্থায় এই চিঠি।
ঠিক কী প্রস্তাব ছিল চিঠিতে? সেখানে বলাই হয়েছিল, দেশের প্রধানমন্ত্রী ডেভিড বেন-গুরিয়ন এই প্রস্তাবটি দিয়েছেন। আইনস্টাইন যদি ইসরায়েলের প্রেসিডেন্ট হন, তাহলেও তার বিজ্ঞান সাধনায় কোনো প্রতিবন্ধকতা তৈরি হবে না। এবং তার গবেষণার সমস্ত দায়ভারও ইসরায়েলই নেবে। তবে শর্ত একটাই। এজন্য আইনস্টাইনকে ইসরায়েলে এসে থাকতে হবে এবং দেশটির নাগরিকত্ব গ্রহণ করতে হবে।
এমন প্রস্তাবে কী উত্তর দেবেন তা নিয়ে কোনো সংশয় ছিল না আইনস্টাইনের মনে। প্রথম থেকেই তিনি জানতেন, ‘না’ ছাড়া আর কোনো উত্তর হতেই পারে না। নিঃসন্দেহে এমন প্রস্তাবে ভেতরে ভেতরে খুবই অস্বস্তিতে পড়েছিলেন প্রবীণ আইনস্টাইন। কেননা তার মত ছিল, এমন প্রস্তাব তার মতো ব্যক্তিত্বের জন্য নেহাতই বেমানান। একথা বন্ধুমহলে প্রকাশও করে ফেলেছিলেন তিনি। কিন্তু সেকথা তো সরাসরি বলা যায় না। এদিকে ইসরায়েল দূতাবাস একটা টেলিগ্রাম করে জানিয়ে দিয়েছে, আমেরিকায় নিযুক্ত তাদের রাষ্ট্রদূত আব্বা এবার নিজে গিয়ে গিয়ে দেখা করবেন আইনস্টাইনের সঙ্গে। ওয়াল্টার আইজ্যাকসন লিখিত ‘আইনস্টাইন: হিজ লাইফ অ্যান্ড ইউনিভার্স’ গ্রন্থে এর উল্লেখ আছে। আইনস্টাইন নাকি টেলিগ্রামটা পেয়ে বলেই ফেলেছিলেন, ‘আরে দেখা করতে এসে হবেটা কী? যখন আমি না-ই বলব?’
এরপর ফোনেও কথা হয় দু’জনের। তখন ইবান জানিয়ে দেন, ‘আমি আমার সরকারকে এটা বলতে পারব না যে আপনি ফোনেই না করে দিয়েছেন। আমাকে দেখা করে সরকারিভাবে প্রস্তাবটা আপনাকে দিতেই হবে।’ আসলে ইবান চেয়েছিলেন, দেখা করে আইনস্টাইনকে ব্যাপারটা খোলাখুলি বুঝিয়ে দিতে যে, দেশের প্রেসিডেন্ট হলেও তিনি মন দিয়ে বিজ্ঞানের কাজই করতে পারবেন। এই পদটি তাকে দেওয়ার অর্থই হল, ইসরায়েলের একজন ‘হিরো’ হিসেবে তাকে দেশের সর্বোচ্চ পদে ঠাঁই দেওয়া। এমনিতেও প্রশাসনিক দিক থেকে ওই পদের আসল গুরুত্বই হল সম্মান। আর সেটাই তার প্রতি প্রদর্শন করতে চায় ইসরায়েল।
এরপর ইবান তার সাঙ্গোপাঙ্গদের নিয়ে আইনস্টাইনের সঙ্গে দেখা করলে বিজ্ঞানী সাফ জানিয়ে দেন, এমন প্রস্তাবে গভীরভাবে আপ্লুত হয়েও তিনি অত্যন্ত দুঃখিত ও লজ্জিত যে সেটি গ্রহণ করতে পারছেন না। তিনি মনে করিয়ে দেন মানবিক বন্ধন হিসেবে তার শ্রেষ্ঠ বন্ধন ইহুদিদের সঙ্গেই। কিন্তু সেই সঙ্গে নিজের সীমাবদ্ধতার দিকটিও স্পষ্ট করে দেন আইনস্টাইন। বলেন, ‘আমি আমার সারাজীবন কাটিয়েছি বস্তুনিষ্ঠ পদার্থের সঙ্গেই। ফলে মানুষের সঙ্গে মেশার স্বাভাবিক ক্ষমতা ও অফিসিয়াল কাজকর্ম করার দক্ষতা কোনোটাই আমার নেই।’ পাশাপাশি নিজের বৃদ্ধ বয়সের কথাও তুলে ধরেন। সব মিলিয়ে বার্দ্ধক্য ও অনভিজ্ঞতাকেই প্রস্তাব ফিরিয়ে দেওয়ার পেছনে কারণ হিসেবে দেখিয়েছিলেন আইনস্টাইন।
আইনস্টাইন মারা যান ১৯৫৫ সালের এপ্রিলে। সুতরাং তিনি ওই প্রস্তাবে রাজি হলে খুব বেশি আড়াই বছর ইসরায়েলের প্রেসিডেন্টের পদ অলংকৃত করতে পারতেন। সময়টা খুব দীর্ঘ না হলেও ইতিহাসের পাতায় তার একটা আলাদা তাৎপর্য তৈরি হতো! সক্রিয় রাজনীতির প্রতি কখনোই আগ্রহ দেখাননি আইনস্টাইন। কিন্তু বহু সময়ই স্পষ্ট রাজনৈতিক অবস্থান নিতে দেখা গেছে তাকে। ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সোচ্চার হওয়া তার মধ্যে অন্যতম। সেই সঙ্গে আমেরিকায় কৃষ্ণাঙ্গদের উপরে হওয়া নির্যাতনের বিরুদ্ধেও সরব হয়েছিলেন তিনি। তবে সব মিলিয়ে রাজনীতির পাকা সড়কে কখনও হাঁটেননি। প্রেসিডেন্ট হয়ে গেলে সেটাকে আর এড়িয়ে থাকা যেত না। জীবনের শেষবেলায় বর্ণময় এক মহাজীবনের উপরে এসে পড়ত আরও নতুন কোনও বৈচিত্র্যকে আলো।
কিন্তু যেটা হয়নি, সেটা তো ইতিহাসের আলোচ্য বিষয় নয়। তার কৌতূহল যেটা হয়েছিল সেটার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। সমস্ত সম্ভাবনা শেষ হয়ে গিয়েছিল একটি ঋজু, বিনম্র ও দৃঢ় ‘না’-তেই। এবং তার পেছনে ছিল ক্ষমতার লোভের প্রতি মোহ থেকে সরে এসে নিজের অক্ষমতা ও সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে গভীর সত্যনিষ্ঠ ধারণা। তবে প্রস্তাব ফিরিয়ে দিলেও, ইসরায়েলের মানুষের তার প্রতি সম্মান একটুও কমেনি। সেদেশে রাস্তা তৈরি হয়েছে তার নামে। রয়েছে মোট চারটি স্মৃতিসৌধ। এমনকি, ১৯৬৮ সালে ইসরায়েলের নোটেও ছাপা হয়েছিল ভুবনজয়ী বিজ্ঞানীর নাম। শ্রেষ্ঠ ইহুদির যে সম্মান তাকে দিয়েছিলেন সেদেশের প্রথম প্রেসিডেন্ট, সেই শিরোপাই তাকে যুগ যুগ ধরে পরিয়ে এসেছে ইসরায়েল।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।