জুমবাংলা ডেস্ক: ভইয়াবা ট্যাবলেটের তুলনায় ৫০ গুণ বেশি শক্তিশালী নতুন মাদক ‘আইস’, যার পূর্ণ নাম ক্রিস্টাল মিথাইল অ্যামফিটামিন। এটি ১০ থেকে ১২ বার সেবনে একজন মানুষের মস্তিষ্কে বিরূপ প্রভাব পড়ে। এতে যেকোনও ব্যক্তি আত্মহত্যাও করতে পারে। ইয়াবার বিকল্প এ মাদকের বাজার তৈরিতে কাজ করছিল মালয়েশিয়া থেকে পড়াশোনা করে আসা কেমিস্ট হাসিব বিন মোয়াম্মার রশিদ। তার সঙ্গে যুক্ত ছিল নাইজেরিয়ান নাগরিক আজাহ অ্যানাওচুকওয়া ওনিয়ানুসি। দু’জন মিলে ডার্ক ওয়েবের মাধ্যমে আইস মাদকের বাজার তৈরি করছিল। শুধু ভার্চুয়াল জগতে নয়, অন্যান্য মাদক চোরাকারবারির সঙ্গেও যোগাযোগ করে আইস বিক্রির বাজার তৈরি করছিল এ দু’জন। অন্যান্য মাদকের তুলনায় আইসের দাম বেশি হওয়ায় উচ্চবিত্তরা ছিল তাদের টার্গেট।
গত ফেব্রুয়ারিতে রাজধানীর মোহাম্মদপুর থেকে ‘আইস’ মাদকসহ রাকিব নামের এক যুবককে গ্রেফতারের পর মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এ চক্রের কথা প্রথম জানতে পারে। এ ঘটনার পরই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা আইস চক্রের কয়েকজন সদস্যকে গ্রেফতার করে। তাদের গ্রেফতারের পর জানতে পারে এ মাদক সম্পর্কে চাঞ্চল্যকর তথ্য।
গত ২৬ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকা থেকে ৫ গ্রাম আইস মাদকসহ রাকিব নামের এক যুবককে গ্রেফতার করে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের কর্মকর্তারা। আইস মাদকের বাজার যাচাই ও তৈরি করতেই তাকে এই মাদক দিয়েছিল একটি চক্র। রাজধানীর ধানমন্ডির ঝিগাতলার ৭/এ নম্বর সড়কের ৬২ নম্বরের নিজ বাড়ির বেজমেন্টে ল্যাব বসিয়ে আইস তৈরি করছিল হাসিব বিন মোয়াম্মার রশিদ। বাংলাদেশে প্রথম আইস মাদকের উৎপাদন শুরু করে এ ব্যক্তি। মাদকের জগতে রশিদ একজন কেমিস্ট হিসেবে পরিচিত। রাকিবকে গ্রেফতারের পর ওইদিন রাতেই তার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী ঝিগাতলায় হাসিবের বাড়িতে অভিযান চালিয়ে আইস তৈরির ল্যাবের সন্ধান পায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর। ল্যাব থেকে আইস মাদক তৈরির বিপুল পরিমাণ কাঁচামাল উদ্ধার করা হয়। তবে সেখান থেকে হাসিব পালিয়ে যায়। পরে গত ১৬ মার্চ মিরপুর এলাকা থেকে হাসিবসহ তিন জনকে গ্রেফতার করা হয়।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের কর্মকর্তারা জানান, নিজের গ্রেফতার এড়াতে হাসিব মাথা ন্যাড়া করে ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি রেখেছিল। মালয়েশিয়ায় ৭ হাজার রিঙ্গিতে ১ গ্রাম আইস মাদক পাওয়া যায়। তবে বাংলাদেশে এই মাদকের বাজার তৈরির জন্য ৭ থেকে ১০ হাজার টাকায় ১ গ্রাম আইস মাদক বিক্রি করছিল এই চক্রটি।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের ঢাকা মেট্রো উত্তর অঞ্চলের সহকারী পরিচালক মো. খুরশিদ আলম বলেন, ‘দেশে আইস মাদক তৈরির মূল হোতা হাসিব বিন মোয়াম্মার রশিদ মালয়েশিয়ায় পড়ালেখা করতো। সেখান থেকে দেশে আসার পর মাদকাসক্ত হয়ে পড়লে তাকে মাদক নিরাময় কেন্দ্রেও ভর্তি করা হয়েছিল। কিন্তু সংশোধন হয়নি। উল্টো নিজেই বাড়ির বেজমেন্টে গড়ে তোলে আইস মাদক তৈরির ল্যাব। বিভিন্ন ওষুধ থেকে এর কাঁচামাল সংগ্রহ করে আইস মাদক তৈরি করতো। মাদকটি নতুন ও ব্যয়বহুল হওয়ায় উচ্চবিত্ত পরিবারের মাদকাসক্ত লোকজনের কাছে কম দামে সরবরাহ করতো। বাংলাদেশে এর বাজার তৈরির জন্য সে ডার্ক নেটের মাধ্যমে আইস মাদকের ক্রেতা-বিক্রেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেছিল।’
তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানান, গ্রেফতারের পর আইস মাদক তৈরি ও বিতরণ নিয়ে আদালতে হাসিব বিন মোয়াম্মার রশিদ ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়। জবানবন্দিতে রশিদ জানায়, মালয়েশিয়ার নোটিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ে কেমিক্যাল অ্যান্ড ইনভার্নমেন্টাল বিভাগে পড়াশোনা করেছেন তিনি। সেখানে পড়া অবস্থায় আইস মাদক সম্পর্কে জানতে পারে। এরপর পড়াশোনা শেষে দেশে ফিরে নিজের অর্জিত জ্ঞান এবং ইন্টারনেটে বিভিন্ন সাইট থেকে আইস মাদক সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ শুরু করে। এরপর হাসিব আইস মাদক তৈরির কৌশল রপ্ত করে। সেই সঙ্গে নিষিদ্ধ ডার্ক নেটে (নিষিদ্ধ সাইট যেখানে অপরাধীরা নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ করে থাকে) আইস মাদকের ক্রেতা-বিক্রেতার সঙ্গে যোগাযোগ করে। বাংলাদেশে আইস মাদকের বাজার তৈরির জন্য বিভিন্ন মাদক কারবারির কাছে তা সরবরাহের চেষ্টা শুরু করে।
আইস মাদকের মূল হোতা হাসিবের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত ২৭ জুন রাতে রাজধানীর বসুন্ধরা এলাকা থেকে ৫২২ গ্রাম আইস মাদকসহ আজাহ অ্যানাওচুকওয়া ওনিয়ানুসিকে গ্রেফতার করে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের কর্মকর্তারা। তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, গ্রেফতার এই নাইজেরিয়ান নাগরিক ২০১৭ সালে স্টুডেন্ট ভিসা নিয়ে বাংলাদেশে আসে। এরপর রাজধানীর আশা বিশ্ববিদ্যালয়ে বি ফার্মা বিভাগের ভর্তি হয়। কোর্স শেষ করে সে গার্মেন্টস ব্যবসা শুরু করে। ব্যবসার কাজে ব্যাংকক, মালয়েশিয়া, ভারত, উগান্ডা, কেনিয়া, সিঙ্গাপুরসহ বিভিন্ন দেশে যাতায়াত করতো অ্যানাওচুকওয়া ওনিয়ানুসি। এদিকে নাইজেরিয়ান এই নাগরিকও নিষিদ্ধ ডার্ক নেটের সদস্য। সে গার্মেন্টস ব্যবসার আড়ালে ডার্ক নেটের মাধ্যমে অন্তত ৮টি দেশে আইস মাদকের ডিলার। সেই সুবাদের মাদক জগতের কেমিস্ট হিসেবে পরিচিত হাসিব বিন মোয়াম্মার রশিদের সঙ্গে আজাহর যোগাযোগ গড়ে ওঠে। তারা দুইজন মিলে বাংলাদেশে আইস মাদকের বাজার তৈরির চেষ্টা করে।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের অতিরিক্ত পরিচালক (গোয়েন্দা শাখা) মো. মোসাদ্দেক হোসেন রেজা বলেন, আইস মাদকের কেনাবেচা ও বাজার তৈরিতে কয়েকজন বাংলাদেশি জড়িত রয়েছে বলে আমরা তথ্য পেয়েছি। তবে তদন্তের স্বার্থে তাদের বিষয়ে কিছুই বলা যাচ্ছে না। তথ্য প্রমাণের ভিত্তিতে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
আইস মাদকের ক্ষতিকর দিক
ইয়াবা ট্যাবলেটেও অ্যামফিটামিন রয়েছে, তবে আইস মাদক ইয়াবা ট্যাবলেটের চেয়ে ৫০ গুণ বেশি শক্তিশালী। আইস মাদক ১০ থেকে ১২ বার সেবনে একজন মানুষের মস্তিষ্কে বিরূপ প্রভাব পড়ে। ফলে ওই ব্যক্তি যেকোনও ঘটনা ঘটাতে দ্বিধাবোধ করে না। কোনও ব্যক্তিকে হত্যাসহ নিজেও আত্মহত্যা করে ফেলতে পারে। এর প্রভাবে মানুষের সুস্থ চিন্তাভাবনা লোপ পায়।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের চিকিৎসা ও পুনর্বাসন কেন্দ্রের পরিচালক ডা. সৈয়দ ইমামুল হাসান এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘যেকোনও মাদকদ্রব্যই শারীরিক ও মানসিকভাবে ক্ষতি করে। ইয়াবা ট্যাবলেট এবং আইস মাদকে একই ধরনের ক্ষতিকারক মেথা অ্যামফিটামিন থাকে। তবে ইয়াবা ট্যাবলেটে অ্যামফিটামিনের পরিমাণ তুলনামূলক কম রয়েছে। আর আইস মাদক পুরোটাই অ্যামফিটামিন। এ কারণে আইস মাদক সেবনে ক্ষতির পরিমাণ অনেকগুণ বেশি।’ সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।