বেশির ভাগ উইকিপিডিয়া পাতার ওপরে সংক্ষিপ্ত তথ্যসহ ইনফোবক্স বা ‘তথ্যছক’ থাকে। তথ্যছক কতটা সমৃদ্ধ, তা কিছু ক্ষেত্রে সেই নিবন্ধের মান যাচাইয়ের মাপকাঠি হতে পারে। প্রতিটি উইকিপিডিয়া নিবন্ধেই ‘টেবল অব কন্টেন্ট’ বা সূচী থাকে, যেখানে একনজর তাকিয়েই নিবন্ধের গঠন সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। টেবল অব কন্টেন্ট কতটা সুগঠিত, তা নিবন্ধের মানের একটা সাধারণ ধারণা দিতে পারে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো রেফারেন্স অনুচ্ছেদ। এখানে পুরো নিবন্ধের তথ্য কোন কোন জায়গা থেকে নেওয়া হয়েছে, তার তালিকা দেওয়া থাকে।
রেফারেন্স বা তথ্যসূত্রের সংখ্যা, রেফারেন্সগুলোর মান, সেগুলো যাচাই করা যাচ্ছে কি না—এ ধরনের কিছু ক্রাইটেরিয়া নিবন্ধের মান যাচাইয়ের অন্যতম বড় উপায়। উইকিপিডিয়ার কোনো লেখা হুবহু কোনো পরিবর্তন ছাড়া ব্যবহার করলে লাইসেন্সের নিয়মানুযায়ী সেটি যে উইকিপিডিয়া থেকে নেওয়া হয়েছে, তা উল্লেখ করতে হয় এবং সঙ্গে নিবন্ধের নাম স্বীকার করতে হয়। তবে যদি হুবহু লেখা কপি না করা হয়, বরং শুধু তথ্যগুলো নেওয়া হয়, তাহলে সর্বোত্তম উপায় হলো উইকিপিডিয়াকে সূত্র হিসেবে ব্যবহার না করে উইকিপিডিয়া যেসব সূত্র উল্লেখ করেছে, সরাসরি সেগুলোই ব্যবহার করা।
তা ছাড়া কিছু ‘মেইন্টেনেন্স টেমপ্লেট’ থাকতে পারে নিবন্ধের ওপরে, মেইন্টেনেন্স টেমপ্লেটেই যেকোনো ইস্যু, যেমন নিবন্ধের নিরপেক্ষতার সমস্যা, জীবন্ত ব্যক্তির নিবন্ধ, বড় পুনর্গঠনের ভেতরে থাকা নিবন্ধ—এরকম অনেক বিষয় সরাসরি লেখা থাকে। এই মেইন্টেনেন্স টেমপ্লেট থাকলে আমরা সরাসরি সেই নিবন্ধের দুর্বলতাগুলো সম্পর্কে জানতে পারি।
ইংরেজি উইকিপিডিয়ার চমৎকার একটি ব্যাপার হলো ‘কন্টেন্ট অ্যাসেসমেন্ট’ পলিসি, যেটি ‘লেটার স্কিম’ ব্যবহার করে। ‘লেটার স্কিম’ মানে ইংরেজি অক্ষর ব্যবহার করে নিবন্ধ বা আর্টিকেলের মান নিরূপন করা। উদাহরণস্বরূপ, কোনো নিবন্ধের ওপরে FA লেখা মানে এটি ইংরেজি উইকিপিডিয়ার সবচেয়ে সেরা নিবন্ধতালিকার (ফিচার্ড আর্টিকেল) একটি।
এর পরের গ্রেড হলো A class, তারপর যথাক্রমে GA (Good article), B, C, Start, ও Stub—যেখানে পর্যায়ক্রমে কম মানের নিবন্ধ বোঝায়। এই গ্রেডিং ইংরেজি উইকিপিডিয়ার নিবন্ধের একেবারে ওপরে ছোট করে দেওয়া থাকে, যেখান থেকে সরাসরি সেই নিবন্ধের মান সম্পর্কে জানা সম্ভব। অন্যান্য ভাষার উইকিপিডিয়াগুলো এমন সুগঠিত গ্রেডিং সিস্টেম ব্যবহার নাও করতে পারে। যেমন বাংলা উইকিপিডিয়ায় শুধু ‘নির্বাচিত নিবন্ধ’ (ইংরেজি উইকিপিডিয়ার FA বা featured article-এর সমমান) এবং ‘ভালো নিবন্ধ’ (GA বা good article-এর সমমান) তালিকা রয়েছে। অন্যান্য সমমানের গ্রেডিং এখানে কার্যকর নেই।
যেকোনো ভাষার উইকিপিডিয়ায় ভালো আর দুর্বল নিবন্ধের কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য থাকে। সেগুলো হলো:
ভালো নিবন্ধের বৈশিষ্ট্য
- নির্ভরযোগ্য উৎস থেকে পর্যাপ্ত সূত্র
- স্পষ্ট ও তথ্যবহুল ভূমিকাংশ
- একটি বিষয়ের সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দিক ও দৃষ্টিভঙ্গির উল্লেখ
- ভারসাম্যপূর্ণ ও সুগঠিত
- নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি বা এনপিওভি
দুর্বল নিবন্ধের বৈশিষ্ট্য
- রেফারেন্স বা তথ্যসূত্র একেবারে নেই বা খুব কম
- মেইন্টেনেন্স টেমপ্লেটে নিবন্ধের দুবর্লতা নিয়ে কোনো ওয়ার্নিং রয়েছে
- বানান ভুল
- সাম্প্রতিক বিষয়ে পুরোনো তথ্য
- সূত্রহীন মতামতের উপস্থিতি
মোটা দাগে ভুয়া তথ্যের দুটো ধরন রয়েছে। মিসইনফরমেশন আর ডিজইনফরমেশন। অনেকে ডিজইনফরমেশনকে ‘কূতথ্য’ নামে অনুবাদ করেন। তবে তা প্রচলিত বাংলা নয়। মিসইনফরমেশন হলো সেসব ভুয়া তথ্য, যেগুলো মানুষ না জেনে সৎ উদ্দেশ্য নিয়েই প্রচার করে। আর ডিজইনফরমেশন হলো যেসব ভুয়া তথ্য নির্দিষ্ট নেতিবাচক উদ্দেশ্য সাধনের জন্য সজ্ঞানে নিয়ন্ত্রিতভাবে ছড়ানো হয়।
শুধু উইকিপিডিয়াই নয়, যেকোনো জায়গায় ডিজইনফর্মেশন চিহ্নিত করার কিছু সহজ উপায় রয়েছে।
- তথ্যের উৎস ও উৎসের মান নিয়ে ভাবা
- তথ্যটি কে লিখেছেন বা প্রচার করেছেন, তা জানা
- তারিখ ও সময় ভালোভাবে যাচাই করা
- নিজের ভেতরের পক্ষপাত জানা ও সেগুলোকে চ্যালেঞ্জ করা
- শুধু শিরোনাম না পড়ে ভেতরের পুরো তথ্য মনোযোগ দিয়ে পড়া
- তথ্যের উৎস নিরপেক্ষভাবে যাচাই করা সম্ভব কি না, তা বিবেচনা করা
- তথ্যটি প্রচারের পেছনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে গভীরভাবে ভাবা
- প্রয়োজনে বিশেষজ্ঞদের মতামত নেওয়া
- যেকোনো তথ্য কঠোরভাবে প্রতিটি সম্ভাব্য দৃষ্টিকোণ থেকে প্রশ্ন করা, প্রশ্ন করার সংস্কৃতি তৈরি করা, এমনকি সেটি নিজের পছন্দের পত্রিকা বা লেখক হলেও
সাধারণত জ্ঞান তৈরির প্রক্রিয়ায় সাধারণ মানুষের যুক্ত হওয়ার সুযোগ খুব কম থাকে। ফলে তথ্য তৈরি হওয়ার প্রক্রিয়া বাছাই করা মানুষের ভেতর সীমাবদ্ধ থাকে এবং সাধারণ মানুষ সেটি সম্পর্কে বিশদ ধারণা রাখে না। জার্মান পরিচালক লরেঞ্জা ক্যাস্টেলা এবং ইয়াশা হ্যানোভার তাঁদের জার্মান ভাষার স্বল্পদৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্র, ‘উইকিপিডিয়া অ্যান্ড দ্য ডেমোক্র্যাটাইজেশন অব নলেজ’-এ দেখিয়েছেন, কীভাবে উইকিপিডিয়ায় জ্ঞান তৈরি ও রক্ষণাবেক্ষণের প্রক্রিয়ায় সাধারণ মানুষ যুক্ত হওয়ার মাধ্যমে জ্ঞান প্রকৃত অর্থেই মানবসভ্যতার সম্পদ হয়ে ওঠে এবং সাধারণ মানুষ জ্ঞানের মালিকানা নিতে শেখে।
তাই উইকিমিডিয়া আন্দোলনে যেসব মানুষ যুক্ত থাকেন, তাঁরা জ্ঞান তৈরি, রক্ষণাবেক্ষণ ও প্রচারের প্রক্রিয়া সম্পর্কে বিশদ জ্ঞান রাখেন বলে তাঁদের মিডিয়া অ্যান্ড ইনফরমেশন লিটারেসি স্কিল অনেক বেশি হয়। বর্তমানে বাংলাদেশে ক্রমবর্ধমান ভুয়া তথ্যের বিরুদ্ধে সামষ্টিক লড়াইয়ে এই দক্ষতা অনেক বেশি সাহায্য করতে পারে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।