জুমবাংলা ডেস্ক : বিভিন্ন দেশে একের পর প্রবল তাপপ্রবাহ ও প্রাণঘাতি ঝড়ের সাক্ষী হয়েছে ২০২৪ সাল। এ বছরের বেশ কয়েকটি মাসই উষ্ণতায় রেকর্ড গড়েছে। বিজ্ঞানীদের গবেষণা বলছে, কেবল আলাদা করে মাস নয়, বছর হিসেবেই ২০২৪ সাল উষ্ণতায় নতুন রেকর্ড গড়বে।
ইউরোপিয়ান ক্লাইমেট সার্ভিসের এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে আরও ভয়ংকর পূর্বাভাস, এ বছরের গড় তাপমাত্রা প্রাক-শিল্প যুগের তাপমাত্রার তুলনায় ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়ে যাবে। এখন পর্যন্ত বছর হিসেবে এমন ঘটনা আর কখনো ঘটেনি। এর আগে ২০২৩ সালের গড় তাপমাত্রা ছিল প্রাক-শিল্প যুগের চেয়ে ১ দশমিক ৪৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি। ২০২৪ সাল সে রেকর্ডকেও ছাড়িয়ে যাবে।
প্রাক-শিল্প যুগ বলতে ১৮৫০ সাল থেকে ১৯০০ সাল পর্যন্ত সময়কালকে বোঝানো হয়। ওই সময় জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার এত ব্যাপক ছিল না। জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা বারবারই বলে আসছেন, জলবায়ু বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা করতে হলে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা ওই সময়কার গড় তাপমাত্রার চেয়ে ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশির মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখতে হবে।
বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্বনেতারা আন্তর্জাতিক বিভিন্ন জলবায়ু সম্মেলনে বিজ্ঞানীদের দেওয়া সেই লক্ষ্যমাত্রা পূরণে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমানো, কার্বন নিঃসরণ নিয়ন্ত্রণসহ নানা প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। সেগুলো ঠিকঠাকভাবে বাস্তবায়ন না হলেও এতদিন পর্যন্ত বিজ্ঞানীদের দেওয়া সেই লক্ষ্যমাত্রা পেরোয়নি কখনো। ২০২৪ সাল সেই সীমাকেও ছাড়িয়ে যাচ্ছে।
বৈশ্বিক উষ্ণতার ক্রমবর্ধমান প্রবণতার পেছনে মূল কারণ হিসেবে কাজ করছে মানবসৃষ্ট বিভিন্ন ঘটনা, যেগুলো জলবায়ুর পরিবর্তনে ভূমিকা রাখছে। পাশাপাশি এল নিনো, লা নিনার মতো প্রাকৃতিক বিভিন্ন ঘটনাও নিয়ামক হিসেবে কাজ করছে।
এল-নিনো সাউদার্ন অসিলেশন (ইএনএসও) আবহাওয়াগত একটি বিশেষ ঘটনা, যেটি যা ক্রান্তীয় পূর্ব প্রশান্ত মহাসাগরের ওপর বাতাসের ধরন ও সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রার একটি অনিয়মিত কিন্তু পর্যায়ক্রমিক পরিবর্তন। এর মধ্যে এল নিনো পর্যায়ে সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা বেড়ে যায়, যা বায়ুমণ্ডলে বাড়তি উষ্ণতার জোগান দেয়। এল নিনোর বছরগুলোতে তাপমাত্রা প্রায় শূন্য দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে থাকে। সবশেষ এল নিনো পর্যায়টি শুরু হয় গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে, যা এ বছরের এপ্রিল পর্যন্ত চলেছে।
রয়্যাল মিটিওরোলজিক্যাল সোসাইটির প্রধান নির্বাহী লিজ বেন্টলি বলেন, ‘সবশেষ যেসব তথ্য পাওয়া যাচ্ছে, সেগুলো বিশ্বনেতাদের কঠোর সতর্কবার্তা দিচ্ছে যেন তারা কপ২৯ (১১ নভেম্বর থেকে ২২ নভেম্বর পর্যন্ত আজারবাইজানের বাবুকে অনুষ্ঠেয়) থেকে এই প্রভাব সীমিত করার জন্য জরুরি পদক্ষেপ নেন।’
২০২৪ সালের প্রথম ১০ মাসেই বৈশ্বিক তাপমাত্রা ছিল অনেক বেশি। এখন শেষ দুই মাসে তাপমাত্রা আচমকা তীব্রভাবে কমে না গেলে বছর হিসেবেই ২০২৪ সাল সর্বোচ্চ তাপমাত্রার রেকর্ড গড়বে। শুধু তাই নয়, ইউরোপিয়ান কোপারনিকাস ক্লাইমেট চেঞ্জ সার্ভিসের তথ্য বলছে, প্রাক-শিল্প যুগের চেয়ে ১ দশমিক ৫৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়তি থেকে শেষ হবে এই বছরটি।
কোপারনিকাসের উপপরিচালক সামান্থা বার্জেস বলেন, ‘এটি বৈশ্বিক তাপমাত্রার রেকর্ডের ক্ষেত্রে একটি নতুন মাইলফলক।’
প্রাক-শিল্প যুগের চেয়ে ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি তাপমাত্রার মধ্যে বৈশ্বিক তাপমাত্রা সীমাবদ্ধ রাখার প্রতিশ্রুতি বিশ্বনেতারা প্রথম দিয়েছিলেন ২০১৫ সালে। প্রায় ২০০টি দেশ প্যারিসে সেই লক্ষ্য নির্ধারণ করেই জলবায়ু চুক্তিতে সই করেছিলেন। এটি করতে পারলে অনেক ধরনের জলবায়ু বিপর্যয় ঠেকানো সম্ভব বলে জানিয়েছিলেন বিজ্ঞানীরা।
২০২৪ সাল সেই লক্ষ্য ধরে রাখতে ব্যর্থ হলেই অবশ্য প্যারিস চুক্তির লঙ্ঘন হচ্ছে, এটা বলা যাবে না। কারণ ২০ বছর মেয়াদি গড় তাপমাত্রার ক্ষেত্রে ওই ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের লক্ষ্যমাত্রা প্রযোজ্য ছিল। তবে এভাবে একের পর এক বছর এই সীমা অতিক্রম করলে তা সেই লক্ষ্যমাত্রাকে আরও বেশি ঝুঁকির মুখে ফেলবে।
এদিকে গত মাসেই জাতিসংঘ সতর্কবার্তা দিয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে বিভিন্ন দেশ যে নীতি অনুসরণ করছে তাতে এ শতাব্দীতে পৃথিবীর তাপমাত্রা ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বেড়ে হয়ে যেতে পারে। অন্যদিকে, কোপারনিকাসের তথ্য অনুযায়ী, গত সপ্তাহের প্রতিদিনই বৈশ্বিক গড় তাপমাত্রায় নতুন রেকর্ড হয়েছে।
অনেক বিজ্ঞানী অবশ্য আশা করছেন, এল নিনোর বিপরীত আবহাওয়াগত ঘটনা শীতল পর্যায়ের ‘লা নিনা’ শিগগিরই দেখা দেবে। এর প্রভাবে আগামী বছরের তাপমাত্রা সাময়িকভাবে কিছুটা কমতে পারে। তবে তা ঠিক কীভাবে হবে, সেটি নিশ্চিত নয়।
রিডিং বিশ্ববিদ্যালয়ের জলবায়ু বিজ্ঞানের অধ্যাপক এড হকিন্স বলেন, ‘২০২৫ সাল ও এরপর কী ঘটবে, তা আমরা খুব আগ্রহ নিয়ে পর্যবেক্ষণ করব।’
তবে বায়ুমণ্ডলে গ্রিনহাউজ গ্যাসের স্তর দ্রুত বাড়তে থাকায় বিজ্ঞানীরা সতর্ক করছেন, তাপমাত্রায় নতুন রেকর্ড স্থাপন এখন সময়ের অপেক্ষামাত্র।
অধ্যাপক হকিন্স আরও বলেন, ‘উষ্ণ তাপমাত্রা ঝড়কে আরও তীব্র, তাপপ্রবাহকে আরও প্রবল এবং ভারী বৃষ্টিপাতকে আরও চরম করে তুলছে, যা পৃথিবীজুড়ে মানুষকে প্রভাবিত করছে। এই মুহূর্তে নেট-জিরো বা শূন্য নির্গমনের মাধ্যমে বৈশ্বিক তাপমাত্রা স্থিতিশীল করাই এই বিপর্যয় থামানোর একমাত্র উপায়।’
নেট জিরো বলতে বোঝায় বায়ুমণ্ডলে নির্গত কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ ও অপসারিত কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ সমান হওয়াকে, যেন বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই অক্সাইডের মোট পরিমাণে কোনো হেরফের না হয়।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।