বিশালাকার সব ডাইনোসর ঘুরে বেড়াচ্ছে শিকারের খোঁজে। তবে মূল উদ্দেশ্য তা নয়। পার্কের নিরাপত্তাবেষ্টনী ভেঙে বেরিয়ে এসেছে দৈত্যগুলো। ওরা বেরোতে চায়। মুক্তি চায়। মানুষ পালিয়ে বেড়াচ্ছে প্রাণ হাতে নিয়ে। ডাইনোসরই শুধু নয়, আছে প্রাগৈতিহাসিক আরও বিভিন্ন দৈত্যাকার প্রাণী। প্রতিটাই হিংস্র। শিকারি। হয় মারো, নয় মরো—এই আপ্তবাক্য মেনেই ওদের জীবন যাপন। এদের হাত থেকে কি মানুষ বাঁচতে পারবে?
বলছিলাম জুরাসিক পার্ক মুভির কথা। স্টিফেন স্পিলবার্গের জগদ্বিখ্যাত এই মুভির কল্যাণে ডাইনোসর আজ জীবাশ্মবিজ্ঞানের সীমানা ছাড়িয়ে ছড়িয়ে পড়েছে সবার মাঝে। ‘জুরাসিক পার্ক’ নিয়ে এরপর একাধিক চলচ্চিত্র বানানো হয়েছে, নির্মিত হয়েছে অ্যানিমেশন সিরিজ। প্রথম ধাপের তিন কিস্তি রীতিমতো চলচ্চিত্রের জগৎ কাঁপিয়ে দেওয়ার পর ফের বানানো হয়েছে জুরাসিক ওয়ার্ল্ড ট্রিলজি।
ডাইনোসর নিয়ে অনেক লেখা হয়েছে, হয়েছে গবেষণা। বিজ্ঞানীরা ফসিল বা জীবাশ্ম গবেষণা করে দেখিয়েছেন, সব ডাইনোসর আসলে এত ভয়ংকরও ছিল না। তবে আজকের এ লেখা ডাইনোসর নিয়ে নয়। প্রাচীন পৃথিবীতে স্থলে যেমন ডাইনোসর ছিল, তেমনি পানিতেও ছিল ভয়ংকর সব জলদানো। তেমনি এক জলদানোর নাম মোসাসরাস। হ্যাঁ, এই প্রাণীটিকেও দেখা গেছে জুরাসিক ওয়ার্ল্ড-এ।
জুরাসিক ওয়ার্ল্ড মুভির কথা ভাবুন। গ্রে ও জ্যাক—দুই ভাই যখন প্রথম জুরাসিক ওয়ার্ল্ডে পৌঁছায়, তারা সেখানে দেখে ভয়ংকর এক জলদানোর খাওয়ার দৃশ্য। ভয়ংকর সেই দৃশ্য উপভোগ করে দর্শকেরা।
আন্ডারওয়াটার, অর্থাৎ পানি ছাওয়া কাচের চিড়িয়াখানা। বিশাল এক জলদানো মাথা তোলে পানির ওপরে। খাবার দেওয়া হয় ওটাকে ওপর থেকে। এক কামড়ে বিশাল একটি মাছের অর্ধেক গিলে নেয় ওটা, বাকিটা খানিকক্ষণ ভেসে থাকে পানিতে। কাচের মধ্য দিয়ে দেখা যায় ওটার আরেক কামড়ে বাকি সবটা মাছ গিলে নেওয়ার দৃশ্য।
যদি বলি, সেই জলদানোটি সত্যিই ছিল পৃথিবীতে এককালে, বিশ্বাস করবেন? হ্যাঁ, সত্যিই এককালে পৃথিবীতে ছিল এই ভয়ংকর জলদানো। মোসাসরাস। নামটির ইংরেজি অর্থ ‘লিজার্ড অব দ্য মিউজ রিভার’। বাংলা করলে দাঁড়ায়, ‘মিউজ নদীর সরীসৃপ’। জানেন হয়তো, ডাইনোসর কথাটির মানেও সরীসৃপ। অর্থাৎ, এটিকে চাইলে জলের ডাইনোসরও বলতে পারেন। তবে জলজ সরীসৃপ বললে আরও সঠিক হবে। এই মোসাসোরাস পৃথিবীতে বাস করত আজ থেকে ৮২ থেকে ৬৬ মিলিয়ন বছর আগে। সে কালের নাম লেট ক্রিটেশয়াস যুগ।
প্রথম এই মোসাসরাসের ফসিল পাওয়া যায় ১৭৬৪ সালে নেদারল্যান্ডসের ম্যাসট্রিক্টের কাছে চক কুয়েরিতে। এখানে ফসিল মানে, খুলির হাড়। এটিই প্রথম পাওয়া মেরিন বা সামুদ্রিক সরীসৃপের ফসিল। তবে সে কালে প্রথমে মনে করা হয়েছিল এটি তিমির কঙ্কাল। বর্তমানে এই ফসিলটি নেদারল্যান্ডসের হারলেমে টাইলারস মিউজিয়ামের প্রদর্শনীতে রয়েছে।
কিছুদিন পরেই, ১৭৮০ সালের দিকে আরেকটি একই রকম খুলির হাড় পাওয়া যায় একই জায়গায়। সেটা জোহান লিওনার্ড হফম্যানের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ভদ্রলোক ডাচ্, পেশায় সার্জন। শখের ভূতাত্ত্বিক। তিনি ভেবেছিলেন, এটা কুমিরের খুলি। তিনি তখন ডাচ্ জীববিজ্ঞানী পেটরাস ক্যাম্পারের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। ক্যাম্পার এটিকে তিমির কঙ্কাল হিসেবে শনাক্ত করে একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করলে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলের দৃষ্টি আকর্ষিত হয়।
এ গবেষণাপত্র চোখে পড়ে ফরাসি বিপ্লবীদের। ১৭৯৪ সালের ফরাসি বিপ্লবী যুদ্ধে তারা যখন ম্যাসস্ট্রিক্ট দখল করে নেয়, তখন তারা এ ফসিল লুট করে নিয়ে আসে। ফরাসি বা ফ্রেঞ্চ ভূতাত্ত্বিক বার্থেলেমি ফাউজা দে সেইন্ট-ফন্ড পরে দাবি করেছেন, বারোজন সৈনিকের একটি দল থেকে ৬০০ বোতল ওয়াইনের বিনিময়ে এটি সংগ্রহ করা হয়। তবে ঐতিহাসিকরা এ দাবিকে অতিরঞ্জিত বলে মনে করেন।
এই গবেষণার সূত্র ধরে আজ আমরা জানি, এদের দেহ ছিল মসৃণ। বিস্তৃত লেজ এবং ফিন বা পাখনা ছিল। সবচেয়ে বড় মোসাসরাসগুলো ৫৬ ফিটের মতো বড় হতো। অনেক বিজ্ঞানী অবশ্য একে অতিরঞ্জন বলেন। তাঁদের হিসেবে, এর দৈর্ঘ্য ছিল ৪৩ ফুটের মতো। সাধারণত গড়পড়তা মানুষের উচ্চতা হয় প্রায় ৬ ফিট। অর্থাৎ মানুষের ৭-সাড়ে ৯ গুণ বড় ছিল এগুলো লম্বায়। ওজন (আসলে ভর) ছিল প্রায় ১০ হাজার কেজি! এদের একেকটা দাঁতই হতো ১ ফুটের মতো! মাছ, হাঙর, পাখি কিংবা অন্যান্য মোসাসরাসদেরও ধরে খেত এসব জলদানব।
ফসিল অনুসন্ধানে দেখা গেছে, আটলান্টিক মহাসাগরের বিভিন্ন জায়গায় ছিল এর বাস। বর্তমান যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ইউরোপ, তুরস্ক, রাশিয়া, মরোক্কোর আফ্রিকান উপকূলসহ বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিল এগুলো। এ ছাড়াও আর্কটিক সাগরের বর্তমান মেক্সিকো উপকূলে এদের বাস ছিল। এসব জলদানবের ফসিল পাওয়া গেছে অ্যান্টার্কটিকাতেও।
তা, কীভাবে বিলুপ্ত হয়ে গেল এসব জলদানব? প্রায় সাড়ে ছয় কোটি বছর আগে বিশাল এক গ্রহাণু যখন পৃথিবীকে আঘাত করে, এলোমেলো হয়ে যায় পুরো পৃথিবীর বাস্তুসংস্থান ও জলবায়ু, তখন মারা পড়ে অনেক প্রজাতির ডাইনোসর ও বিভিন্ন প্রাণী। এই গ্রহাণুকে বলা হয় চিক্সুলুব গ্রহাণু। এরই ফলস্রুতিতে ক্রিটেশিয়াস যুগের শেষে বিশ্বের সামগ্রিক সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা কমে যায়, অনেকটা নেমে যায় পানির স্তর। সমুদ্রে খাদ্য ও পুষ্টির অভাব দেখা দেয়। এভাবে ধীরে ধীরে মারা যেতে থাকে মোসারসাররা।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।