পদার্থবিজ্ঞানের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা তাঁর নাম। মহাবিশ্বের অর্ধেক কণা—সব পদার্থের কণাকে তাঁর নামে ডাকা হয় ফার্মিওন। পর্যায় সারণির একটি মৌলের নাম রাখা হয়েছে তাঁর সম্মানে—ফার্মিয়াম। অথচ এই মানুষটি কি না নোবেল পেয়েছেন ভুল গবেষণার জন্য!
অল্প যে কজন বিজ্ঞানীর নাম পদার্থবিজ্ঞানের প্রায় পুরোটাজুড়ে ছড়িয়ে আছে, তাঁদের মধ্যে এনরিকো ফার্মি অন্যতম। মূলত অ্যাটমিক পার্টিকেল বা অতিপারমাণবিক কণা নিয়ে কাজ করেছেন। পেয়েছেন নোবেল পুরস্কার (আসলে, ভুল নোবেল পুরস্কার!)। আধুনিক কণাপদার্থবিজ্ঞান ও নিউক্লিয়ার পদার্থবিজ্ঞানে তাঁর কাজের তুলনা তিনি নিজেই।
১৯২৪ সালে গাণিতিক পদার্থবিজ্ঞানের লেকচারার হিসেবে ইতালির ইউনিভার্সিটি অব ফ্লোরেন্সে যোগ দেন ফার্মি। এ সময় তিনি আপেক্ষিকতা তত্ত্ব, কোয়ান্টাম বলবিদ্যা এবং পরিসংখ্যানগত বলবিদ্যা নিয়ে কাজ শুরু করেন। গ্যাস ডিজেনারেসির সমস্যাটি তখন সবার কাছেই বেশ পরিচিত। বোস-আইনস্টাইন পরিসংখ্যান এর কিছু ঘটনার ব্যাখ্যা করতে পেরেছিল। বোসন কণাদের আচরণ কেমন হবে—এই তত্ত্ব থেকেই জানা গিয়েছিল তা।
১৯২৬-২৭ সালে ফার্মি আর পল ডিরাক মিলে নতুন একধরনের পরিসংখ্যান প্রক্রিয়া গড়ে তোলেন। এর নাম ফার্মি-ডিরাক পরিসংখ্যান। এটি প্রথম গড়ে তোলার কাজটি করেছিলেন আসলে ফার্মিই। যেসব অতিপারমাণবিক কণা পাউলির বর্জন নীতি মেনে চলে, তাদের আচরণ ব্যাখ্যা করতে পারত এটি (পাউলির বর্জন নীতি আমাদের দেশে উচ্চমাধ্যমিক রসায়নে পড়ানো হয়)। এ ধরনের কণাদের স্পিন হলো ১/২। ইলেকট্রন-প্রোটন-নিউট্রন—এগুলো সবই ফার্মিওন কণা। বলা বাহুল্য, নামটি রাখা হয়েছে এনরিকো ফার্মির নামানুসারে। কেন? সেটা তো বুঝতেই পারছেন—ফার্মি প্রথম এই পরিসংখ্যান গড়ে তুলেছিলেন, তাই।
কণাপদার্থবিজ্ঞান এবং পারমাণবিক পদার্থবিজ্ঞানের জগতে ফার্মির এই কাজের গুরুত্ব আসলে অপরিসীম। কেন, সেটা একদম সহজে ছোট্ট করে এভাবে বলা যায়: মহাবিশ্বে দুই ধরনের জিনিস আছে। পদার্থ (ও প্রতিপদার্থ) এবং শক্তি। সব শক্তির কণাকে এক নামে বলা হয় বোসন—বাঙালী সত্যেন বসুর নামে। আর সব পদার্থের কণাকে এক নামে বলা হয় ফার্মিওন। কারণটা ইতিমধ্যেই বলেছি। ফার্মির কাজ যে কতটা শক্তিশালী, তা কি এবারে একটুখানি বোঝা যাচ্ছে?
যা-ই হোক, ১৯২৭ সালে ফার্মি ইউনিভার্সিটি অব রোমে তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক হিসেবে কাজ শুরু করেন। ১৯৩৮ সাল পর্যন্ত তিনি এখানেই ছিলেন। এ সময় তিনি বিখ্যাত হয়ে ওঠেন ‘দ্য পোপ অব ফিজিকস’ নামে। প্যানিস্পারনা বয়েজ নামে একদল বিজ্ঞানীকে সঙ্গে নিয়ে আবিষ্কার করেন পর্যায় সারণির ৯৩তম মৌল। সে জন্য নোবেল পুরস্কারও পেয়ে গেলেন সে বছর।
১৯৩৮ সালে মুসোলিনির একনায়কতন্ত্রের হাত থেকে বাঁচার জন্য ইতালি থেকে পালিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে চলে আসেন এই বিজ্ঞানী। যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার জাহাজে চড়ে শুনতে পান জীবনের সবচেয়ে বড় দুঃসংবাদ। ৯৩তম মৌল বলে যেটাকে ভেবেছিলেন, সেটা আসলে নতুন কোনো মৌলই নয়! ততদিনে অবশ্য নোবেল তিনি পেয়ে গেছেন। ইতিহাসে লেখা হয়ে গেল, এনরিকো ফার্মি নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন ভুল গবেষণার জন্য
ফার্মির এই নোবেল পুরস্কার ফিরিয়ে নেওয়া হয়নি। পরে বিটা ক্ষয়বিষয়ক গবেষণা, সব মৌলের মধ্যেই যে নিউট্রনের আঘাতের ফলে পরিবর্তন ঘটে (মৌল বদলে যায়), তা; নিউট্রন থেকে কৃত্রিমভাবে তেজস্ক্রিয়তা উৎপাদন এবং স্থিতিশীল ও নিয়ন্ত্রিত নিউক্লিয়ার চেইন বিক্রিয়ার জন্য তাঁকে নোবেল দেওয়া হয়েছে বলে আনুষ্ঠিক বিবৃতিতে জানায় নোবেল কমিটি। এই গবেষণার কথা জানতে একটু পেছনে ফেরা যাক। এ জন্য আমাদের যেতে হবে ১৯৩৪ সালে।
রোম বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকাকালীন এনরিকো ফার্মি তড়িৎ-চৌম্বক তত্ত্ব এবং বর্ণালিমিতি নিয়ে কাজ করেছেন। বর্ণালি সংক্রান্ত বিভিন্ন ঘটনা অনুসন্ধান করতে গিয়ে ফার্মি ১৯৩৪ সালে ইলেকট্রন বাদ দিয়ে পরমাণুর আরও গভীরে, মানে, নিউক্লিয়াসের দিকে মনোযোগ দেন। এটা ছিল তাঁর ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বড় টার্নিং পয়েন্ট। এ সময় রেডিয়েশন থিওরি বা বিকিরণ তত্ত্ব এবং পাউলির আইডিয়া নিয়ে একসঙ্গে কাজ করতে গিয়ে ফার্মি বিটা-ক্ষয় তত্ত্ব সংক্রান্ত একটি গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার করেন। কৃত্রিমভাবে তেজস্ক্রিয়তা তৈরি করা নিয়ে এর কিছুদিন আগে মেরি কুরি আর জুলিয়েট দারুণ কাজ করেছেন। এটাও তাঁকে অনুপ্রেরণা দিয়েছিল।
সব মিলে তিনি দেখালেন, নিউক্লিয়াসের বিটা-ক্ষয় হলে এ থেকে নিউট্রিনোও বেরিয়ে আসে। সেই সঙ্গে বেরিয়ে আসতে পারে ইলেকট্রনও। এই তত্ত্ব চারটি ফার্মিওনের একসঙ্গে মিথস্ক্রিয়ার কথা বলে। যেমন একটি নিউট্রন ভেঙে একটি ইলেকট্রন, একটি নিউট্রিনো এবং একটি প্রোটন বেরিয়ে আসে।
অবশ্য, পরে জানা গিয়েছিল, বেরিয়ে আসা কণাটি নিউট্রিনো নয়, বরং প্রতিনিউট্রিনো। তবে বাইরে থেকে দেখলে সব কণা এবং তাদের প্রতিকণাকে একইরকম লাগে। সেই সময়ের প্রযুক্তির কথা ভাবলে ফার্মির এই ব্যাপারটি চোখ এড়িয়ে যাওয়াকে তাই স্বাভাবিক বলেই মেনে নিতে হয়। এই তত্ত্বটিকে এখন এককথায় ফার্মির মিথস্ক্রিয়া (Fermi’s Interaction) বা ফার্মির বিটা-ক্ষয় তত্ত্ব (Fermi theory of beta decay) বলা হয়।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।