জুমবাংলা ডেস্ক: বিসিএসের প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় গাণিতিক যুক্তি এবং সাধারণ বিজ্ঞানের প্রশ্ন করা হবে এসএসসি মানের। মানবিক ও বাণিজ্য বিভাগের শিক্ষার্থীদের সমান সুযোগ দেওয়ার জন্য বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি) এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। দেশ রূপান্তর-এর প্রতিবেদক আশরাফুল হক-র প্রতিবেদনে উঠে এসেছে বিস্তারিত।
সাম্প্রতিক সময়ের বিসিএসগুলোতে বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীরা বেশি সুবিধা পাচ্ছেন, এমন আলোচনা রয়েছে। পিএসসির নীতিনির্ধারকদের কানেও তা পৌঁছেছে। এরপরই বিজ্ঞান সংক্রান্ত প্রশ্নপত্র সর্বজনীন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
পিএসসির চেয়ারম্যান মো. সোহরাব হোসাইনের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা বিভিন্ন বিষয়ে সংস্কার করছি। সংস্কার এখনো শেষ হয়নি। শেষ হলে জানতে পারবেন।’
৩৫তম বিসিএস অনুষ্ঠিত হয় নতুন সিলেবাসে। পরিবর্তিত সিলেবাস অনুযায়ী, সাধারণ বিজ্ঞান, কম্পিউটার ও তথ্যপ্রযুক্তি, গণিত ও মানসিক দক্ষতা অংশে নম্বর বাড়ানো হয়। ২০০ নম্বরের প্রিলিমিনারিতে সাধারণ বিজ্ঞান ১৫, কম্পিউটার এবং তথ্যপ্রযুক্তি ১৫, গাণিতিক যুক্তি ১৫, মানসিক দক্ষতা ১৫ নম্বরের প্রশ্ন আসে। প্রিলিমিনারিতে মোট ২০০ নম্বরের প্রশ্নে ওপরের চারটি বিষয়ের নম্বর ৬০। এসব বিষয়ের প্রশ্নগুলো উচ্চতর শ্রেণির হওয়ায় বেশি ভালো করেন বিজ্ঞানের ছাত্ররা। এই ৬০ নম্বরই প্রিলিমিনারিতে পার্থক্য গড়ে দেয়। যে কারণে তারা মানবিক, সামাজিকবিজ্ঞান ও ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের শিক্ষার্থীদের চেয়ে এগিয়ে থাকেন।
৩৫তম বিসিএসের আগে ১০০ নম্বরের প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় বিষয়গুলোতে আলাদা মানবণ্টন ছিল না। মূলত সাধারণ বাংলা, সাধারণ ইংরেজি, সাধারণ জ্ঞান, সাধারণ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এবং মানসিক দক্ষতা ও গাণিতিক যুক্তি ইত্যাদি বিষয়ে প্রশ্ন করা হতো। ৩৫তম বিসিএস থেকে ২০০ নম্বরের প্রিলিমিনারি পরীক্ষা হচ্ছে। যেখানে ৬০ নম্বরে বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীরা তুলনামূলক বেশি সুবিধা পান বলে আলোচনা রয়েছে। এর কারণ হিসেবে বলা হয়, এসব বিষয়ে তাদের আগে থেকেই দক্ষতা থাকে।
পিএসসি বিভাগভিত্তিক কোনো ফল প্রকাশ করে না। তবে চারপাশে বিসিএসে চাকরিপ্রাপ্তদের মধ্যে প্রকৌশল ও মেডিকেলের শিক্ষার্থীদের সাফল্যে প্রশ্ন তুলেছেন অনেকেই। তাদের মতে, গত চারটি বিসিএসেই ভালো করেছেন বিজ্ঞানের ছাত্ররা।
মানবিকের শিক্ষার্থীদের মতে, প্রশ্ন পদ্ধতি বিজ্ঞানের ছাত্রদের এগিয়ে রাখছে। যে বিষয়গুলোতে পূর্ণ নম্বর পাওয়া সম্ভব সে বিষয়গুলোতে বিজ্ঞানের ছাত্ররা ভালো করছেন। বিশেষ করে গণিত ও মানসিক দক্ষতা, বিজ্ঞান, কম্পিউটার বিষয়ে উচ্চতর শ্রেণি থেকে প্রশ্ন হচ্ছে, যা অল্প সময়ে অন্য অনুষদের শিক্ষার্থীদের পক্ষে আয়ত্ত করা কঠিন।
জনপ্রশাসনের কর্মকর্তারা জানান, বিজ্ঞানের প্রতি আমাদের আলাদা প্রীতি রয়েছে। স্কুলে নবম শ্রেণিতে মেধাবী শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞান পড়তে বাধ্য করা হয়। অনেকে ইচ্ছা করলেও মানবিকসহ অন্য বিভাগে পড়তে পারে না। শিক্ষকরা যেমন বাধা দেন, তেমনি বাধা হয়ে দাঁড়ায় পরিবারের অভিভাবকরাও। তুলনামূলক মেধাবী শিক্ষার্র্থীরা বিজ্ঞান পড়ে। কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে সেই ধারা অব্যাহত থাকে। আগে বিজ্ঞানের বাইরে অন্যান্য অনুষদের শিক্ষার্থীরা বিসিএস বেশি দিতেন। তারাই বেশি চাকরি পেতেন। কিন্তু সম্প্রতি সরকারি চাকরিতে সুযোগ-সুবিধা অনেক বেড়েছে। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হয়ে মেধাবী শিক্ষার্থীরা যে চাকরি করে তার চেয়ে অনেক কম মেধাবীরা বিসিএস দিয়ে মর্যাদাসম্পন্ন চাকরি পাচ্ছেন। বিসিএস দিয়ে প্রশাসন ক্যাডারে চাকরি করে তারা ইউএনও, ডিসি বা সচিব হচ্ছেন। মেডিকেল বা ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে বিসিএস না দিয়ে তারা এসব মর্যাদার পেশায় আসতে পারেন না। সবকিছু মিলিয়ে মেডিকেল বা ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করার পর বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীরা এখন বিসিএস দিয়ে প্রশাসন, পুলিশ, কাস্টমস, কর, পররাষ্ট্রসহ অন্যান্য ক্যাডারে চাকরি করতে বিসিএস দিচ্ছেন। স্বাভাবিকভাবেই বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীরা অন্যান্য অনুষদের শিক্ষার্থীদের চেয়ে এগিয়ে থাকেন।
বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদেরও উল্টো মত রয়েছে। তাদের মতে, কম্পিউটার এবং তথ্যপ্রযুক্তি এখন সবার বিষয়। মানসিক দক্ষতাও বিজ্ঞানের কোনো বিষয় নয়। সাধারণ বিজ্ঞান এবং গণিতের নম্বর ৩০, যা প্রিলিমিনারির মোট নম্বরের মাত্র ১৫ শতাংশ। এসব বিষয়ের অনেক প্রশ্নও হয় নবম-দশম শ্রেণি থেকে। তাদের মতে, লিখিত পরীক্ষার ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। জেনারেল ক্যাডারের জন্য লিখিত পরীক্ষায় মোট নম্বর ৯০০। এর মধ্যে বিজ্ঞানে ১০০ আর গণিতে ৫০ নম্বর। অর্থাৎ ১৭ শতাংশ নম্বর বরাদ্দ বিজ্ঞানের। বাকি ৮৩ শতাংশ নম্বর বাংলা, ইংরেজি, বাংলাদেশ এবং আন্তর্জাতিক বিষয়াবলি, যা মানবিক বিভাগ থেকেই আসে। যদি সুবিধা পাওয়ার কথাই আসে তাহলে বিজ্ঞানের বাইরের বিষয়ের শিক্ষার্থীরাই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া বিষয়ের সুবিধা ভোগ করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগের শিক্ষার্থী আনিসুর রহমান জানান, বিজ্ঞান থেকে প্রশ্ন করা কমালে আর আর্টস থেকে বেশি প্রশ্ন করলেও বিজ্ঞানের ছাত্রছাত্রীরা এগিয়েই থাকবে। যে মাথা জটিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের থিওরি বোঝে, বায়োকেমিস্ট্রির রিঅ্যাকশন বোঝে, ফিজিক্সের কঠিন ইকুয়েশন মনে রাখে, মেডিকেল সায়ন্সের মোটা মোটা বই মুখস্থ রাখে, তারা ইতিহাস, ভূগোল আর বাংলা সাহিত্য দেখলে দৌড়ে পালাবে কেন? গ্রিক মিথোলজি থেকে প্রশ্ন করলেও তারা এগিয়ে থাকবে। বিজ্ঞান বাদ দিলেই বিসিএস থেকে বিজ্ঞানের ছাত্রছাত্রীদের দূরে রাখা যাবে না। বিজ্ঞান আর গণিত থেকে যে ১৫ শতাংশ নম্বর বরাদ্দ থাকে সেটাও যদি বাদ দেওয়া হয় তাহলে বিসিএস পরীক্ষার গুণগতমান নিয়েই টানাটানি শুরু হবে। যদি সত্যিই ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ারদের বিসিএস দেওয়া কমাতে হয় তাহলে সবার আগে দেশে তাদের উপযুক্ত পেশা ও সম্মানজনক পরিবেশ এবং কাজের ক্ষেত্র নিশ্চিত করতে হবে। কী কারণে একজন চিকিৎসক ৫ বছর অমানুষিক পরিশ্রম করে পড়াশোনা করে এমবিবিএস পাস করেন আবার বাংলা সাহিত্যের বই নিয়ে পড়তে বসতে বাধ্য হন, সেটা চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নিতে হবে। একজন ইঞ্জিনিয়ার কেন তার মেধাকে গবেষণার কাজে না লাগিয়ে গায়ে পুলিশের ইউনিফর্ম জড়িয়ে নেওয়াকে বেশি গৌরবের মনে করছেন তা খতিয়ে দেখা দারকার।
সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার বলেন, ‘ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ারদের বিসিএসে আসা নিয়ে নানা কথা হচ্ছে। যুক্তি দেখানো হচ্ছে সরকার প্রকৌশল, চিকিৎসা ও কৃষিশিক্ষার জন্য সাধারণ শিক্ষার চেয়ে অনেক বেশি ব্যয় করে। এ ধরনের বিশেষায়িত ডিগ্রি নিয়ে তাদের কেউ কেউ চলে যাচ্ছেন বিসিএসের সাধারণ ক্যাডারগুলোতে। এটা আপাতদৃষ্টে অসঙ্গত মনে হতে পারে। তবে প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করলে এর যৌক্তিকতাও খুঁজে পাওয়া যাবে। তারা এখানে স্থান নিচ্ছেন নিজেদের মেধার জোরে। সরকারও ক্যাডারগুলোতে তুলনামূলক মেধাবী কর্মকর্তাই চায়। বরং বিসিএস সাধারণ ক্যাডারে আসা ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার ও কৃষিবিদরা মেধার ছাপ রাখলে আমরা উপকৃত হব।’
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।