লাইফস্টাইল ডেস্ক : এলন মাস্ককে সরিয়ে বিশ্বের ধনীশ্রেষ্ঠের আসনটি দখল করেছেন বার্নার্ড আর্নল্ট (Bernard Arnault)। বিলাসদ্রব্যের ব্যবসায়ী বার্নার্ড সত্তরোর্ধ্ব। তবে এলনের সাথে তার বয়সের অনেক তফাত হলেও কাজে বেশ মিল।
বার্নার্ডও কড়া ধাঁচের ব্যবসায়ী। ব্যবসার উন্নতি করার ক্ষেত্রে কোনো রকম আবেগকে পাত্তা দেন না। উল্টে এ ব্যাপারে এলনের সাথে প্রতিযোগিতায় তিনিই জিতবেন। বয়সে না হোক, ২০ বছরের ছোট এলনকে গুনে গুনে দশ গোল দেবেন।
টুইটারের মালিকানা দখল করার পর দু’দফায় ৫০ শতাংশেরও বেশি কর্মীকে ছাঁটাই করেছিলেন এলন। বার্নার্ডের ইতিহাস বলছে, তিনিও এলনের মতোই দখলনীতিতে সাম্রাজ্য বিস্তার করেছেন। এবং দখল নেয়ার পর যথেচ্ছ কর্মীছাঁটাই করেছেন।
বস্তুত কর্মীদের নির্বিচারে টার্মিনেট বা বরখাস্ত করার জন্য একটি ‘ডাক’ নামও জুটিয়েছিলেন বার্নার্ড— ‘দ্য টার্মিনেটর’। একটি সংস্থার দখল নিয়ে তার ৯০ শতাংশ কর্মীকেই চাকরি থেকে ছাঁটাই করার পর শিল্পমহল তাকে চিনতে শুরু করে ওই নতুন নামে।
বার্নার্ড যদিও তার ডাকনাম নিয়ে মাথা ঘামাননি বিশেষ, তার একমাত্র লক্ষ্য ছিল নামডাক। আর সেটি তিনি সফলভাবেই করতে পেরেছেন।
আন্তর্জাতিক মানের বিলাসবহুল এবং ফ্যাশন-দ্রব্যের সবচেয়ে বড় ব্র্যান্ড ‘মোয়েত এনেসি লুই ভিতোঁ’(এলভিএমএইচ)-এর চেয়ারম্যান এবং সিইও বার্নার্ড। শৌখিনী মহলে এই সংস্থার পণ্য বেশ জনপ্রিয়।
ব্যাগ, পোশাক-আশাক, রূপটান সামগ্রী, ঘড়ি, অলঙ্কার, সুগন্ধি প্রস্তুত করে এই ব্র্যান্ড। এ ছাড়াও ওয়াইন এবং বিভিন্ন রকম সুরা তৈরির ব্যবসাও রয়েছে লুই ভিতোঁর।
কতটা জনপ্রিয় এই সমস্ত বিলাসদ্রব্য? এই সে দিনও প্যারিসে আয়োজিত ফ্যাশন সপ্তাহের রেড কার্পেটে বলিউডের অভিনেত্রী দীপিকা পাড়ুকোন হাজির হয়েছিলেন ‘লুই ভিতোঁ’ নিয়ে। পোশাক পরেছিলেন ধূসর বর্ণের। বিশেষ কোনো অলঙ্কারও পরেননি। শুধু হাতে ছিল একটি ঝকমকে লুই ভিতোঁ ব্যাগ। যেন ওটিই একমাত্র অলঙ্কার।
কিছু দিন আগে ভারতীয় লোকসভা এমপি মহুয়া মৈত্রের হাতেও দেখা গিয়েছিল এই সংস্থার ব্যাগ। আবার ব্রিটেনের রাজপরিবারের দুই ফ্যাশনদুরস্ত বৌমা কেট মিডলটন এবং মেগান মর্কেলকেও প্রায়ই ব্যবহার করতে দেখা যায় বার্নার্ডের সংস্থার তৈরি বিলাসদ্রব্য। এমনকি, বাদ যাননি ডায়নাও। তার হাতেও বহুবার দেখা গিয়েছে এই সংস্থার ব্যাগ।
এ তো গেল জনপ্রিয়তার কথা। বার্নার্ডের নেতৃত্বে লুই ভিতোঁর সাম্রাজ্যও ছড়িয়েছে বহু দূর। আন্তর্জাতিক স্তরের নামীদামি বহু ফ্যাশন ব্র্যান্ডের দখল নিয়েছেন তিনি। এর মধ্যে ক্রিশ্চিয়ান ডায়র, ফেন্দি, জিঁভসি, মার্ক জেকবস, স্টেলা, ম্যাককার্টনি, ট্যাগ হোইয়র, বুলগরি, টিফনি অ্যান্ড কো-র মতো সংস্থা রয়েছে। এমন মোট ৭৫টি সংস্থার মালিকানা এখন বার্নার্ডের হাতে। তবে কোনোটিই বার্নার্ড নিজের হাতে গড়ে তোলেননি। শুধুই দখল করেছেন।
১৯৪৯ সালের ৫ মার্চ ফ্রান্সের রুবঁ-এ জন্ম বার্নার্ডের। এলনের মতোই তিনিও ধনী পরিবারেরই সন্তান। মা ছিলেন ব্যবসায়ী পরিবারের কন্যা এবং শৌখিনী। বাবা ওই ব্যবসাই পেয়েছিলেন বিবাহসূত্রে যৌতুক হিসেবে। ফেরেট স্যাভিনেল নামে একটি ইঞ্জিনিয়ারিং সংস্থাই ছিল বার্নার্ডের পারিবারিক ব্যবসা। তিনিও ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়াশোনা করে ওই ব্যবসাতেই যোগ দেন।
ব্যবসায়ী হিসেবে বার্নার্ডের পাকা মাথার প্রমাণ পাওয়া যায় তখন থেকেই। প্রথমে পারিবারিক ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যবসাকে রিয়েল এস্টেটের ব্যবসায় বদলে নেন তিনি। তার পর আচমকাই কিনে নেন প্যারিসের একটি বিলাসদ্রব্যের ব্র্যান্ড।
১৯৮৪ সালে ফ্রান্সের সরকার তখন বুজ্যাঁক সঁ ফ্রেরেস নামে একটি বহুজাতিক বস্ত্র সংস্থাকে বিক্রি করার তোড়জোড় করছে। বার্নার্ডের কাছে ওই খবর যায়। বিলাসদ্রব্যের ব্র্যান্ড কিনে সেই ব্র্যান্ডের হয়েই ওই সংস্থাটি নিলামে কিনে নেন বার্নার্ড।
বহুজাতিক বস্ত্র প্রতিষ্ঠান হলেও তখন বুজ্যাঁকের মালিকানায় ছিল জনপ্রিয় ফ্যাশন ব্র্যান্ড ‘ক্রিশ্চিয়ান ডায়র’। বার্নার্ড-ঘনিষ্ঠরা বলেন, ডায়রের জন্যই বুজ্যাঁক কিনেছিলেন বার্নার্ড। কারণ বার্নার্ডের মায়ের পছন্দের ব্র্যান্ড ছিল ডায়র। কারণ বুজ্যাঁক তার হাতে আসার পরই তিনি একসাথে প্রায় ৯০০০ কর্মীকে কাজ থেকে বিদায় দেন। ডায়র এবং একটি ডিপার্টমেন্টাল স্টোর ছাড়া বুজ্যাঁকের যাবতীয় সম্পত্তি বিক্রি করে দেন। ওই সময়েই শিল্পমহলে টার্মিনেটর শিরোপা পান বার্নার্ড। তবে দু’বছরের মধ্যেই লাভের মুখ দেখতে শুরু করে ডায়র।
এর পর কোম্পানির দখল নেয়াটা এক রকম নেশার মতোই হয়ে দাঁড়ায় বার্নার্ডের। এখন যে লুই ভিতোঁর প্রধান তিনি, সেই সংস্থাটিকেও তার চতুর বুদ্ধিতে দখল করেছিলেন বার্নার্ড। মোয়েথ এনেসি লুই ভিতোঁ এখন একটি সংস্থা হলেও তখন ছিল আদতে দু’টি সংস্থা- লুই ভিতোঁ এবং মোয়েথ এনেসি। দুই সংস্থার প্রধানের সাথে কথা বলে একটি বিলাসদ্রব্যের বড় ব্র্যান্ড তৈরির করার পরিকল্পনা করেন বার্নার্ড। তখন লুই ভিতোঁর প্রধান ছিলেন হেনরি রিক্যামিয়ার।
মোয়েথ এনেসি এবং লুই ভিতোঁ একসঙ্গে একটি ব্র্যান্ড হওয়ার পর বার্নার্ড অতি সন্তর্পণে শেয়ার কিনতে শুরু করেন। এবং শেষ পর্যন্ত পুরনো প্রধান রিক্যামিয়ারকে সরিয়ে নিজে বসেন তার জায়গায়।
‘ধূর্ত’ বার্নার্ডের পরিচিতি এই সময়েই ছড়িয়ে পড়ে শিল্পমহলে। বার্নার্ড কোনো সংস্থার শেয়ার কিনতে শুরু করেছেন মানে সেই সংস্থা বুঝে যেত, দখল খুব দূরে নেই। এ ভাবে একের পর এক ব্র্যান্ডের দখল নেওয়া বার্নার্ড ধাক্কা খান জনপ্রিয় আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড ‘গুচি’ কিনতে গিয়ে। শুরুতেই সতর্ক হয়ে বার্নার্ডকে রুখে দেয় গুচি। যদিও সহজে ছাড়েননি বার্নার্ডও। ফলে আইনি লড়াই শুরু হয়। শেষে কোর্টের নির্দেশে হাল ছাড়তে হয় বার্নার্ডকেই।
দু’বার বিয়ে করেছেন বার্নার্ড। প্রথম বিয়ে বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। তবে দ্বিতীয় স্ত্রীর সাথে এখনো রয়েছেন তিনি। দুই পক্ষের পাঁচ সন্তানের বাবা বার্নার্ড। ছেলেমেয়েরাও যোগ দিয়েছেন তারই সংস্থায়।
ধনীতালিকায় বার্নাড এবং তার পরিবারের মোট সম্পত্তিকেই প্রথম স্থান দেয়া হয়েছে। বার্নার্ড এবং তার পরিবারের মোট সম্পত্তির পরিমাণ এখন ১৮ হাজার ৮৬০ কোটি ডলার। যার মধ্যে শুধু বার্নার্ডের সম্পত্তি ১৭ হাজার ১০০ কোটি ডলার।
অন্য দিকে, আগের ধনীশ্রেষ্ঠ এলনের সম্পত্তি হঠাৎই কমে গেছে টেসলার শেয়ারের দাম হঠাৎ করে পড়ে যাওয়ায়। এলনের সম্পত্তির মূল্য কমে দাঁড়িয়েছে ১৬ হাজার ৪০০ কোটি ডলারে।
তবে বার্নার্ড বরাবরই ধনীতালিকার প্রথম দশে নিজের স্থান বজায় রেখেছেন। ২০২১ সালে কিছু দিনের জন্য বিশ্বের ধনীদের মধ্যে শীর্ষ আসন দখল করেছিলেন বার্নার্ড। তার এবং তার পরিবারের মোট সম্পত্তির পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ১৯ হাজার ৮০০ কোটি ডলারে। তবে পরে সেখান থেকে আবার পিছিয়ে পড়েন তিনি।
সেবার তিনি টেক্কা দিয়েছিলেন অ্যামাজন প্রতিষ্ঠাতা জেফ বেজোসকে। আর এ বার টেসলা এবং টুইটারের প্রধান এলনকে পিছনে ফেলে দিলেন বিশ্ববাণিজ্যের ‘টার্মিনেটর’।
সূত্র : আনন্দবাজার পত্রিকা
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।