জুমবাংলা ডেস্ক: কর্মের ফল মানুষের ভোগ করতে হয়। গত শতাব্দীর নয়ের দশকের দিকে ভারতের নাগপুরের কস্তুরবানগর বস্তি ‘এলাকার ত্রাস’ হয়ে উঠেছিল আককু যাদব। তখন হয়তো সে ভাবতেও পারেননি তার জীবনের শেষ অধ্যায়ের প্রধান কুশীলব হয়ে উঠবেন সেই নারীরাই। যারা তার লালসার ‘শিকার’। এমন নজিরের কথা জানা যায় না, ঘটনাটি হচ্ছে আদালত কক্ষের ভেতরেই ধর্ষণে অভিযুক্তকে পিটিয়ে মেরেছিলেন এলাকার অসংখ্য নারী! স্রেফ গণপিটুনিই নয়। ছুরির কোপে ফালাফালা করে দেওয়া হয় তাকে।
২০০৪ সালের ১৩ আগস্টের সেই দিনটার কথা বলার আগে ভালো করে আককুকে চিনিয়ে দেওয়া দরকার। রাক্ষস যে কেবল রূপকথাতেই নেই, বাস্তবের পৃথিবীতেও আছে তার সাক্ষাৎ প্রমাণ এ মানুষটি। ভারতের মতো দেশে নারী নির্যাতন এক পুরনো ও কালান্তক ব্যাধি। আর এর পেছনে রয়েছে অসংখ্য আককুর উপস্থিতি। কিন্তু আককুর যেন এই ভিড়ের মধ্যেও আলাদা। তার ঘৃণ্য আচরণের সীমা-পরিসীমা নির্ধারণ করাই যেন কঠিন। হয়তো অসম্ভবও।
শুরু থেকে বলা যাক। সাতের দশকের শুরুতে জন্ম ভারত কালীচরণের। হ্যাঁ, এটাই আককুর ভালো নাম। নাগপুরের বহিরাঞ্চলে অবস্থিত কস্তুরবানগর বস্তিতে। এ এমন এক অঞ্চল, যেখানে প্রায় ঘরে ঘরে খুচরা অপরাধী। তার ওপর আছে দুই গ্যাং। তাদের মধ্যে চলতে থাকা নিত্য সংঘাতে এলাকার আকাশ-বাতাসে সব সময়ই যেন বারুদ আর রক্তের গন্ধ।
ছোটবেলা থেকেই এমন পরিবেশ আককুর মগজে বুনে দিয়েছিল শয়তানির বীজ। একটু বড় হতেই তিনি যুক্ত হন একটা গ্যাংয়ে। মোটামুটি বছর উনিশ বয়সেই তার নাম উঠে আসে এক গণধর্ষণের ঘটনায়। সেই শুরু। ৩২ বছরের জীবনেই চল্লিশের বেশি ধর্ষণ ও তিনটি খুনের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এছাড়া ছোটখাটো ছিনতাই কিংবা অপহরণের মতো অসংখ্য অপরাধ তো আছেই।
আককু সত্য়িই হয়ে উঠেছিলেন এক জীবন্ত দুঃস্বপ্ন। আর নিজের সব অপরাধকে ঢাকতে তিনি নাকি টাকাপয়সা, এমনকি মদের বোতল ঘুষ দিয়ে মুখ বন্ধ রাখতেন স্থানীয় পুলিশের। এমনটাই অভিযোগ ছিল এলাকার বাসিন্দাদের। কার্যতই সবাই অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলেন তার অত্যাচারে। কস্তুরবানগরে নাকি এমন একটিও বাড়ি নেই, যার কোনো একজন নারী সদস্যও আককুর লালসার শিকার হননি! মধ্যবয়সী নারী থেকে ১০ বছরের বালিকা- বাদ পড়েনি কেউই। পাশাপাশি, আরো একটা বিষয়ও ছিল। তার এই যৌন অপরাধের ক্ষেত্রে জাতপাতের একটা ব্যাপারও ছিল। দেখা গেছে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দলিত নারীদের প্রতিই নির্যাতন চালিয়েছেন তিনি।
এমন নয় আককু গ্রেফতার হননি। সবমিলিয়ে ১৪ বার গ্রেফতার হয়েছিলেন তিনি। কিন্তু বারবারই ছাড়া পেয়ে গিয়েছেন। কীভাবে কস্তুরবা বস্তির মানুষের জীবনকে নরক করে তুলেছিলেন তিনি, তা পরিষ্কার হয়ে যায় তার মৃত্যুর পরে। অনেক অজানা ঘটনা সামনে আসতে থাকে। পুলিশ কীভাবে আককুকে মদত দিয়ে গেছে তা ক্রমেই পরিষ্কার হয়ে যায়। ২২ বছরের এক যুবতীর দাবি, তাকে ধর্ষণ করেছিল আককু। কিন্তু থানায় গেলে উল্টা পুলিশ বলে, তার সঙ্গে আককুর প্রেম ছিল। খারিজ করে দেয় সব অভিযোগ। এমন উদাহরণ অজস্র। যা থেকে পরিষ্কার, পুলিশের মদতে আককু অপরাধ প্রবৃত্তির ছায়া এক স্থায়ী গ্রহণ তৈরি করেছিল কস্তুরবার নগরে। সেই কালো ছায়া থেকে বেরিয়ে আসতে একদিন মরিয়া হয়েই তাই চরম পথ বেছে নিয়েছিল নির্যাতিতার দল। যে দৃশ্য হার মানিয়েছিল সিনেমাকেও।
কিন্তু কীভাবে এই অদম্য শয়তানের বিরুদ্ধে শুরু হলো বিরুদ্ধে দাঁড়ানো? সে কথা বলতে গেলে প্রথমেই আসবে উষা নারায়ণের নাম। রত্না নাম্নী এক নারীর বাড়ি ভাঙচুর করেছিল আককুর দল। উষা তাকে অভিযোগ জানাতে বলেন। রত্না ভয় পেলে শেষ পর্যন্ত উষা নিজেই গিয়ে অভিযোগ দায়ের করেন। খবর পেয়েই তার বাড়ি ঘিরে ফেলে প্রায় চল্লিশজন। আক্কুর হাতে অ্যাসিডের বোতল। উষার দরজায় ধাক্কা দিতে থাকে সে। কিন্তু সবার অবাক করে উষা জানায়, তার দরজা ভাঙার চেষ্টা হলে সে গ্যাস সিলিন্ডার খুলে বাড়িই উড়িয়ে দেবে! তাতে তিনি মারা যাবেন ঠিকই। কিন্তু সেই সঙ্গে আককু ও তার দলবলেরও অগ্নিসমাধি হবে।
এ একটা ঘটনা যেন এলাকার মানুষকে রাতারাতি একটা বার্তা দিয়ে দেয়। সেদিন উষার হুঁশিয়ারিতে ধাক্কা খেয়ে ফিরে যাওয়ার সময় আককু যতই শাসাক, সেও যে পিছু হটতে পারে, সেটা সেই প্রথম দেখল সবাই। এরপরই ২০০৪ সালের ৬ আগস্ট আককুর বাড়ি পুড়িয়ে দেয় ক্ষিপ্ত জনতা। ততদিনে সবার মধ্যেই এসে গিয়েছে মরিয়া ভাব। শোষিত হতে হতে এবার মরণকামড় দিতে প্রস্তুত হয়ে পড়ে সবাই। ভয় পেয়ে আককু ও তার সহকারীরা পুলিশি সুরক্ষা চায়। কিন্তু তার ধারণাও ছিল না, আদালত কক্ষেই তাকে কী ভয়ংকর পরিস্থিতিতে পড়তে হবে।
এর ঠিক সাতদিন পর। ১৩ আগস্ট। বিদর্ভের নাগপুর জেলা আদালত ৭ নম্বর কোর্টরুম। সেখানেই আককুর ওপর চড়াও হন এলাকার দুইশোরও বেশি নারী (মতান্তরে সংখ্যাটা চারশোরও বেশি)। সেদিন ঠিক কী কী হয়েছিল, তা সাক্ষী অনুযায়ী আলাদা আলাদা হতে পারে। কিন্তু পরিণতিটা সকলেরই জানা। আদালত কক্ষের মধ্যে রক্তাক্ত ও ক্ষতবিক্ষত দেহ উদ্ধার হয়েছিল আককুর।
শোনা যায়, আককু যে এদিনও জামিন পেয়ে যাবে এমন খবর ক্রমশই ছড়িয়ে পড়ছিল। আর তাতেই জনবিস্ফোরণ ঘটে যায়। আককুকে নিয়ে যখন পুলিশের গাড়ি আদালত চত্বরে প্রবেশ করছিল, তখনই সেখানে উপস্থিত ছিল কস্তুরবানগর বস্তির অনেক বাসিন্দা। গাড়ির জানলা দিয়ে সেদিকে তাকিয়েই আককু বুঝতে পেরেছিল আজ পরিত্রাণ পাওয়া কঠিন।
তবুও তার মতো ভয়ংকর শয়তান তাতেও সতর্ক হয়নি। বরং গাড়ি থেকে নেমে পুলিশের ঘেরাটোপে আদালত কক্ষে যাওয়ার সময় সেখানে উপস্থিত এক নারীকে দেখে শাসাতে থাকে সে। এই নারীও তার লালসার শিকার হয়েছিলেন একসময়। আক্কু বলে ওঠে, ‘একবার বেরোই। তোকে ফের ধর্ষণ করব!’ এতেই ধৈর্যের বাঁধ হুড়মুড়িয়ে ভেঙে যায় উপস্থিত সবার। ঐ নারী আক্কুর দিকে নিজের জুতা ছুঁড়ে দিয়ে বলে ওঠেন, ‘এই পৃথিবীতে হয় তুই থাকবি নয় আমি।’
এরপরই আককুর ওপর চড়াও হন উপস্থিত নারীরা। আদালত কক্ষে চলতে থাকে লাথি, ঘুষি। সেই সঙ্গে ছুরিতেও ফালা ফালা করে দেওয়া হয় তাকে। তার লিঙ্গটাও কেটে নেয় একজন। সর্বত্র তখন ভেসে যাচ্ছে রক্তে। অন্তত ৭০টা কোপের চিহ্ন মিলেছিল আককুর শরীরে। ১৫ মিনিটের মধ্যেই মারা যায় আক্কু। ততক্ষণে ঐ ঘর ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছেন প্রহরারত পুলিশকর্মীরা।
আককুর মৃত্যুসংবাদে কস্তুরবানগরে শুরু হয়ে যায় উৎসব। পুলিশ পরে সেখান থেকে পাঁচজন নারীকে গ্রেফতার করলে থানার সামনে শুরু হয় গণবিক্ষোভ প্রদর্শন। এই পাঁচ নারীর মধ্যে আছে উষা নারায়ণও। পরে গ্রেফতার করা হয় আরো ২১ জনকে। কিন্তু উপযুক্ত সাক্ষ্যপ্রমাণের অভাবে ২০১২ সালে জামিন পেয়ে যান উষা। ২০১৪ সালের মধ্যে রেহাই পান সব অভিযুক্তই। ঘটনার প্রায় এক দশক পরে হাই কোর্টের এক অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি প্রকাশ্যে আককুর হত্যাকে কার্যত সমর্থন করেন। এ ধরনের ঘটনার নজির যে ভারতীয় ইতিহাসে আর নেই।
সূত্র: সংবাদ প্রতিদিন
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।