জুমবাংলা ডেস্ক : হাসিখুশি মেয়েটার সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল টগবগে তরুণটির। তারপর প্রেম। একদিন জানা গেল মেয়েটির শরীরে ক্যান্সার বাসা বেঁধেছে। চিকিৎসার ত্রুটি করেনি পরিবার। চট্টগ্রাম ও ঢাকায় চিকিৎসা, পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর নিয়ে যান প্রতিবেশী দেশ ভারতে। সেখানে দীর্ঘ চিকিৎসা চলে। ক্যান্সারের চিকিৎসার চতুর্থ ধাপে বন্ধ করে দেওয়া হয় ওষুধপত্র। কারণ চিকিৎসার ধকল সহ্য করার মতো জীবনীশক্তি তার আর নেই।
তারপর চট্টগ্রামের মেডিক্যাল সেন্টারের শয্যায় অপেক্ষার প্রহর গুনতে থাকে মেয়েটি। কিন্তু প্রেমিক তরুণ হাল ছাড়েননি। গত ৯ মার্চ রাতে হাসপাতালের শয্যাতেই বেনারসি পরিয়ে, বউ সাজিয়ে ১ টাকা কাবিনে বিয়ের আয়োজন করেছেন। হাসির রেখা ফুটে উঠে অক্সিজেনের নল লাগানো কনের মুখে। দুই পরিবারের সম্মতিতে হয় সেই বিয়ে। এভাবে সিনেমার প্রেম কাহিনীকেও হার মানাল মাহমুদুল হাসান ও ফাহমিদা কামাল।
ফাহমিদা কামাল ব্যবসায়ী কামাল উদ্দিন ও শিউলি আকতারের মেজ সন্তান। তারা দুই বোন, এক ভাই। বড় বোন থাকে চীনে। ছোট ভাইটি বিবিএ পড়ে। ফাহমিদা চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সাবেক কর্মকর্তা সাইফুদ্দিন সাকীর নাতিনি।
সাইফুদ্দিন সাকী জানান, চকরিয়ার ছেলে মাহমুদুল হাসান নর্থ সাউথ থেকে এমবিএ আর চট্টগ্রাম নগরের দক্ষিণ বাকলিয়াতে জন্ম নেওয়া ফাহমিদা কামাল আইইউবি থেকে বিবিএ ও এমবিএ শেষ করেছে। শিক্ষাজীবনে দুজনের পরিচয়। লাবণ্যময়ী স্মার্ট সুন্দরী তরুণী ফাহমিদাকে ভালো লাগতে শুরু করে হাসানের। এরপর আস্তে আস্তে দুজন প্রেমে জড়িয়ে পড়ে। ভালোবাসার মায়াবী বন্ধনে হয়ে উঠে দুজন দুজনার। হাতে হাত ধরে স্বপ্নেবিভোর রঙিন ভুবনে উড়তে থাকে অচেনা হাজারো পথ। সুখ আনন্দ সবই যেন ভরপুর। বিয়ে সংসার কত না মধুর সুখ চোখের কোণে।
কিন্তু একি এমন স্বপ্ন সুখের রঙিন উঠোনে ঘনকালো অন্ধকার। সফেদ আকাশ মেঘে ঢাকা, বৈরী ঝড়ো হাওয়া সব তছনছ করে দিতে উদ্যত। ফাহমিদার স্বপ্নরাঙা মায়াবী শরীরে বাসা বাঁধে মরণঘাতী ক্যান্সার। রেক্টাম ক্যান্সার। ২০২১ সালের জানুয়ারিতে রোগ ধরা পরার পর সঙ্গে সঙ্গে তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকা এভারকেয়ার এবং পরবর্তীতে ভারতের টাটা মেমোরিয়াল হসপিটালে নেওয়া হয়। সেখানে দীর্ঘ একবছর চিকিৎসার পর ডাক্তাররা সাফ জানিয়ে দেন- ফাহমিদার চিকিৎসা আর সম্ভব নয়, ইঙ্গিত দেয় বেঁচে থাকার সম্ভাবনা নেই। পাথর চাপা কষ্ট নিয়ে পরিবারের লোকজন ২৫ বছর বয়সী ফাহমিদাকে চট্টগ্রামে নিয়ে এসে মেডিক্যাল সেন্টারে ভর্তি করান। সেখানে ডা. সাজ্জাদ বিন ইউসুফের তত্ত্বাবধানে চলতে থাকে চিকিৎসা। কিন্তু ক্রমাগত ফাহমিদার শারীরিক অবস্থায় অবনতি হতে থাকে।
প্রেয়সী ফাহমিদার অসহ্য কষ্ট ও বুকভাঙা যন্ত্রণা প্রেমিক হাসানের সহ্য হয় না। ফাহমিদার কষ্ট হাসান ভাগ করে নিতে চায়। চোখের জল মুছে দিতে চায়, কপালে হাত রেখে বলতে চায় আমি আগের মতো এখনো তোমার পাশে আছি। হাতে হাত রেখে বলতে চায় আমি তোমাকে বড্ড ভালোবাসি মিদা, বড্ড ভালোবাসি। তুমিই আমার জীবন তুমিই আমার সব। মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পারাতে চায়। বুকে জড়িয়ে নিয়ে কষ্টগুলো নিজের করে নিতে চায়। কিন্তু তা কি করে সম্ভব! হাসান ফাহমিদার প্রেমিক হলেও সমাজের চোখে পরপুরুষ। মৃত্যুযন্ত্রণায় ফাহমিদা নিঃশেষ হতে চলেছে।
এবার হাসান কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে। ফাহমিদাকে যদি মরতে হয়, তাহলে তার বুকে মাথা রেখেই মরতে হবে। নিজের পরিবারকে নিয়ে এসে প্রস্তাব দিল সে সহসা ফাহমিদাকে বিয়ে করতে চায়। মৃত্যুপথযাত্রী ফাহমিদাকে হাসানের বিয়ে করার প্রস্তাবে সবাই হতবিহ্বল। হাসানকে বোঝানোর সব ধরনের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু হাসান তার অনঢ় সিদ্ধান্তে অটল। অবশেষে উভয় পরিবার সম্মত হয়। বিষয়টি জানানো হয় জীবনমৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে থাকা ফাহমিদাকে। অবিশ্বাস্য প্রস্তাব শুনে অপলক তাকিয়ে থাকে প্রিয় হাসানের দিকে। ফাহমিদার চোখেমুখে ফুটে উঠে নির্মল স্বর্গীয় হাসি। আনন্দ অশ্রুতে দুজনের পৃথিবী দোল খেতে থাকে। বাতাসে নাচতে থাকে রঙিন প্রজাপতি।
অবশেষে বিয়ের প্রস্তুতি নেওয়া হয়। গত ৯ মার্চ এশার নামাজের পর মেডিক্যাল সেন্টারে তাদের বিয়ের আয়োজন হয়। কনে ফাহমিদাকে পরানো হয় লাল বেনারসি শাড়ি, গালায় সোনার হার। বর হাসান পায়জামা-পাঞ্জাবি। কামিননামায় ১ টাকার দেনমোহরে আকদ সম্পন্ন হয়। দুজন মিলে কেক কাটে, মালা বদল হয়। খেজুর মিষ্টি খাওয়ানো হয়।
ক্ষণিকের জন্য মরণঘাতী ক্যান্সারকে জয় করে ফাহমিদা হয়ে উঠে অন্য এক পৃথিবীর বাসিন্দা। সব স্বর্গীয় সুখ তাকে ঘিরে রাখে। হারিয়ে যাওয়া সোনালি দিনগুলো আবার যেন ফিরে পায়। আনন্দে আত্মহারা ফাহমিদার আরো বাঁচতে ইচ্ছে করে। ইচ্ছে করে হাসানের বুকে মাথা রেখে হাজার বছর বাঁচতে। হাসান আর ফাহমিদার এ অমর প্রেমকাব্যে প্রেমেরই জয় হলো। জীবন ক্ষণিকের, জীবনের কাছে প্রেম অবিনশ্বর।
ফাহমিদা ইউসুফ সালামের ভাতিজি। ইউসুফ বলেন, ক্যান্সারের লাস্ট স্টেজে আছে ভাতিজি। এখন ক্যান্সারের চিকিৎসা বন্ধ। শুধু ব্যথা, যন্ত্রণা, রক্তচাপ, শ্বাসকষ্টসহ নানা উপসর্গ দেখা দিলে সাময়িক কষ্টলাঘবের জন্য মেডিক্যাল সেন্টারে ভর্তি করা হয়। আমরা সবার দোয়া চাই, যাতে ভাতিজি বেশি দিন বাঁচতে পারে।
সর্বশেষ রোববার (১৩ মার্চ) থেকে ফাহমিদা আর হাসপাতালে থাকতে চাইছে না। অস্থির উঠেছে তার মন। বাসায় নিয়ে যাওয়ার জন্য পীড়াপীড়ি করতে থাকেন। তাই সোমবার (১৪ মার্চ) রাতে তাকে হাসপাতাল থেকে দক্ষিণ বাকলিয়ায় তার বাসায় নেওয়া হয়েছে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।