করোনাকালে গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ভূমিকা

মোহাম্মদ মনিরুল হায়দার: ইরানে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়লে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গুজব উঠে, অ্যালকোহল ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াই করতে পারে। যদিও দেশটিতে মদ্যপান নিষিদ্ধ। প্রাণঘাতী করোনভাইরাস থেকে বাঁচতে ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যালকোহল (বিষাক্ত মদ) পান করে ইরানে ৭ শতাধিক মানুষের মৃত্যু হয়েছে। ওই মদ খেয়ে গত ২০ ফেব্রুয়ারি থেকে ৭ এপ্রিল পর্যন্ত ৭২৮ জনের মৃত্যু হয়েছে।

দেশটির আহওয়াজ মেডিক্যাল সায়েন্সের মুখপাত্র আলী এহসানপুর বলেছেন, কিছু নাগরিক শুনেছিলেন যে অ্যালকোহল ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াই করতে পারে। তাই তারা এটিকে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা হিসেবে পান করেন।

বাংলাদেশে করোনাকালের একেবারে প্রথম দিকে প্রথম সারির একটি ইলেকট্রনিক মিডিয়া একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন গবেষকের সূত্র ধরে সংবাদ প্রচার করেছিলো ইথাইল এলকোহল বা ইথানলের ভাপ নিলে ফুসফুসে থাকা করোনা ভাইরাস মরে যায়! সংবাদটি সচিত্র প্রকাশ করা হয়েছিলো। একজন জনপ্রতিনিধির একটা ভিডিও ভাইরাল হয়েছিলো সাবান/স্যনিটাইজার দিয়ে ফুসফুস ধুয়ে করোনা মুক্ত হওয়ার! যদিও বিষয়টিকে অনেকেই ফান হিসেবে নিয়ে ট্রল করেছেন। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে গুজব রটেছিলো থানকুনি পাতা খেলে করোনা আর আক্রমণ করবে না!

দেশের প্রথম সারির একটি ইংরেজি দৈনিক ইংল্যান্ডের মেডিকেল জার্নালের রেফারেন্স উল্লেখপূর্বক সংবাদ প্রকাশ করেছিলো, “ডেক্সামেথাসন ইজ দ্য ফার্স্ট লাইফ-সেভিং করোনা ভাইরাস ড্রাগ”। আমাদের প্রথম সারির একটি ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় ব্রিটেনের মেডিকেল জার্নালের রেফারেন্স দিয়ে শিরোনাম করা হলো “এ+ ব্যক্তিদের কোভিড-১৯ আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা তুলনামূলকভাবে বেশি, ও+ ব্যক্তিদের কোভিড-১৯ আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা তুলনামূলক ভাবে কম”। এ+ রক্তের গ্রুপের ব্যক্তিগণ দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলেন ক্ষণিকের জন্য আর ও+ গ্রুপের ব্যক্তিগণ নিরাপদ বোধ করলেন!

ঐ একই ইলেকট্রনিক মিডিয়া চীনা ও আমেরিকান গবেষক দলের রেফারেন্স দিয়ে শিরোনাম করলো “কোভিড-১৯ প্রতিরোধ করার মতো ইম্যুনিটি মানব শরীরে কখনো অর্জিত হবে না”। তাহলে কোভিড থেকে সুস্থ হয়ে উঠা লোকেদের রক্তের প্লাজমা নিয়ে গুরুতর অসুস্থ লোকগুলো সুস্থ হয়ে উঠছেন কীভাবে?

করোনা সাধারণ মানুষকে এতো বেশি আতঙ্কগ্রস্ত করে ফেলেছে যে মানুষ কিছু চিন্তাভাবনা না করেই এ থেকে মুক্তির জন্য বিভিন্ন গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের খবরের উপর ভিত্তি করে বিভিন্ন ধরনের ওষুধ কিনে মজুদ করছেন। একেক সময় একেক একেক ওষুধের নাম শোনা যায় মিডিয়ায় আর আমরা ওগুলো মজুদ করছি যাচাই না করেই। হতে পারে আমরা যে ওষুধ কিনে বাসায় রাখছি সেটার জন্য হন্যে হয়ে খুঁজছে সত্যিকারের অসুস্থ কেউ যা হতে পারে ঐ মানুষটির জীবন রক্ষাকারী ওষুধগুলোর মধ্যে একটি।

মার্কেট মেকানিজমে যখন ডিমান্ড তৈরি হয় তখন পর্যাপ্ত যোগান না থাকলে পণ্যের দাম বেড়ে যায়। আর এ সুযোগটা নেয় অসাধু কিছু ব্যবসায়ী। এ ধরনের সমস্যা শুধু আমাদের মতো দেশের নয়। পৃথিবীর বিভিন্ন উন্নত দেশেও তা বিরাজমান। করোনা কালের প্রথম দিকে অস্ট্রেলিয়ার লোকজন টয়লেট টিস্যু মজুদ করেছিল।

গণমাধ্যমকে রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ বলা হয়। একটি দেশের আইন পরিষদ, বিচার বিভাগ ও নির্বাহী বিভাগের পরপরই গণমাধ্যমের অবস্থান। থমাস জেফারসন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতাদের একজন। তিনি একবার বলেছিলেন, ‘আমাকে যদি এই বিকল্পটি দেওয়া হয় যে তুমি কি সংবাদপত্রবিহীন সরকার চাও, না সরকারবিহীন সংবাদপত্র চাও? তখন আমি পরেরটা বেছে নেব।’ জেফারসন বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ ও সংবাদপত্রের কথা বলেছিলেন। ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়ন বোনাপার্ট সংবাদপত্র সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেছিলেন, চারটি আক্রমণাত্মক সংবাদপত্র হাজারটা বেয়নেটের চেয়েও ক্ষতিকর।’ অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের মতে কোনো দেশে স্বাধীন গণমাধ্যম থাকলে সে দেশে দুর্ভিক্ষ হানা দিতে পারে না।

যুগ যুগ ধরে মানুষ সংবাদ, সংবাদপত্র, গণমাধ্যমের ওপর গুরুত্ব দিয়েছে। আবার এটিও উপলব্ধি করেছে সংবাদমাধ্যম যদি বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ প্রচার না করে তা দেশ, জাতি ও সমাজের ক্ষতির কারণ হতে পারে। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে মহান মুক্তিযুদ্ধ, নব্বইয়ের স্বৈরাচার পতন আন্দোলন সবক্ষেত্রেই গণমাধ্যমের ভূমিকা ছিল অপরিসীম। পুরো বিশ্ব জুড়ে এখন যুদ্ধাবস্থা অদৃশ্য জীবাণুর বিরুদ্ধে। বাংলাদেশও এ-র ব্যতিক্রম নয়। অতীতের মতো এখনও গণমাধ্যম একেবারে ফ্রন্টলাইনে থেকেই কাজ করে যাচ্ছে। গণমাধ্যমের পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমও এখন অনেক বেশি শক্তিশালী ভূমিকা পালন করে থাকে। খুব দ্রুত বিস্তৃতি লাভ করে এ মাধ্যমে ছড়ানো কোনো সংবাদ। সেটা বস্তুনিষ্ঠ হোক বা না হোক।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এখন এতো বেশি শক্তিশালী যে প্রায় সব ধরনের ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ার নিজস্ব ফেসবুক পেজ আছে যার মাধ্যমে খুব দ্রুত বেশি সংখ্যক মানুষের কাছে পৌঁছাতে পারে। চিকিৎসার বিষয়গুলো সবসময়ই অতি সংবেদনশীল। জীবন রক্ষাকারী এ মহৎ পেশায় ব্যবহৃত চিকিৎসা সামগ্রী, ওষুধ, ইত্যাদির ব্যবহারও অতি সংবেদনশীল। সংবেদনশীল এসব জীবন রক্ষাকারী সামগ্রীর ক্রয়, মজুদ, ব্যবহার, এ সংক্রান্ত সংবাদ পরিবেশন ও সংবাদের যথার্থতা যাচাইয়ে সবারই সচেতন হওয়া প্রয়োজন। ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর বর্তমানের ন্যায় অতীতেও ব্যবস্থাপত্র ব্যতীত ওষুধ বিক্রয়ের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করছিলো।

ধরে নিলাম, সতের কোটি মানুষের দেশে দশ লাখ ওষুধের দোকান রয়েছে আর প্রিন্ট, ইলেকট্রনিক ও অনলাইন পোর্টাল মিলে মোট মিডিয়ার সংখ্যা এক হাজার। তাই দেশের মানুষ ও ওষুধ বিক্রেতাদের সচেতন করার পাশাপাশি মিডিয়াগুলোকে সামাজিক দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে অন্যান্য সময়ের ন্যায় এ ক্রান্তিকালেও উজ্জ্বল ভূমিকা পালনে উদ্বুদ্ধ করতে পারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।

লেখক কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা

Write a Comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *