সকালবেলা পাখির কাকলি, প্রিয়জনের স্নেহমাখা ডাক, প্রাণের গান কিংবা নাতি-নাতনির হাসির শব্দ – এই শব্দগুলোই তো জীবনকে রাঙিয়ে দেয়। কিন্তু ভাবুন তো, হঠাৎ করেই যদি এই সুন্দর শব্দজগৎ থেকে আপনি বিচ্ছিন্ন হয়ে যান? ধীরে ধীরে চারপাশের কথোপকথন অস্পষ্ট হতে থাকে, টেলিভিশনের ভলিউম বাড়াতে বাড়াতে সর্বোচ্চ সীমায় চলে যায়, প্রিয়জনের ডাকে সাড়া দিতে দেরি হয়। এটাই কানে শোনার সমস্যার নির্মম বাস্তবতা, যা কেড়ে নিতে পারে জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান অনুভূতিগুলো। বাংলাদেশের মতো দেশে, যেখানে জনবহুলতা, শব্দদূষণ এবং স্বাস্থ্যসেবার অপ্রতুলতা প্রকট, সেখানে এই সমস্যা ক্রমাগত বাড়ছে, অথচ সচেতনতা ও সঠিক চিকিৎসার অভাবে অনেকেই নীরবেই ভোগেন। কিন্তু জানেন কি? সময়মতো সচেতনতা আর পদক্ষেপই পারে আপনার শ্রবণশক্তিকে রক্ষা করতে, ফিরিয়ে দিতে জীবনের সুরেলা আওয়াজ। এই গভীর সমস্যা ও তার সহজ সমাধান নিয়েই আজকের আলোচনা।
Table of Contents
কানে শোনার সমস্যা ও প্রতিকার: সমস্যাকে চিনে নিন, ধরনের ভিত্তিতে
কানে শোনার সমস্যা শুধু কম শোনা নয়, এর বহুমুখী রূপ ও তীব্রতা রয়েছে। সমস্যার ধরন বুঝতে পারলেই প্রতিকারের পথও স্পষ্ট হয়। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে দেখা যায় বেশ কয়েকটি প্রধান ধরন:
-
কন্ডাকটিভ হিয়ারিং লস (Conductive Hearing Loss): এই সমস্যার মূল কারণ কানের বাইরের অংশ (কানপাটা বা বহিঃকর্ণ) বা মধ্যভাগে (মিডিল ইয়ার)। শব্দ তরঙ্গ কানের পর্দা বা অস্থিসন্ধিগুলোতে (অসিকলস) ঠিকমতো পৌঁছাতে বা কম্পন করতে পারে না। বাংলাদেশের গ্রামীণ ও শহুরে উভয় পরিবেশেই এর কিছু সাধারণ কারণ দেখা যায়:
- কানের খোল বা ময়লা জমে যাওয়া (Earwax Impaction): খুবই সাধারণ সমস্যা, বিশেষ করে যারা নিয়মিত কান পরিষ্কার করেন না বা ভুলভাবে কটন বাড ব্যবহার করেন। ঢাকার মতো শহরে ধুলাবালির প্রকোপে এই সমস্যা আরও বাড়ে।
- কানের পর্দায় ছিদ্র (Perforated Eardrum): তীব্র শব্দ (বাজি ফাটানো), সরাসরি আঘাত (চড়, কানে সুতলি দেয়া), আকস্মিক চাপের পরিবর্তন (উড়োজাহাজে ওঠা), বা দীর্ঘস্থায়ী কানের সংক্রমণ (ক্রনিক ওটিটিস মিডিয়া) এর কারণ হতে পারে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে দুর্বল স্বাস্থ্য সচেতনতা ও প্রাথমিক চিকিৎসার অভাবে এই সমস্যা প্রকট।
- ওটিটিস মিডিয়া (কানের মাঝখানে সংক্রমণ): বিশেষ করে শিশুদের মধ্যে খুবই সাধারণ। সংক্রমণে তরল জমে মধ্যভাগ ফুলে যায়, শব্দ পরিবহনে বাধা দেয়। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে অপরিচ্ছন্ন পরিবেশ ও অপুষ্টির কারণে শিশুদের মধ্যে এর প্রকোপ বেশি। দীর্ঘস্থায়ী সংক্রমণ স্থায়ী ক্ষতির কারণও হতে পারে।
- অটোস্ক্লেরোসিস (Otosclerosis): কানের মধ্যভাগের ছোট হাড়গুলোর (বিশেষ করে স্টেপিস) অস্বাভাবিক বৃদ্ধি, যা তাদের নড়াচড়ায় বাধা দেয়। এটি প্রায়ই বংশগতভাবে হতে পারে।
-
সেন্সরিনিউরাল হিয়ারিং লস (Sensorineural Hearing Loss): এটি সবচেয়ে বেশি দেখা যায় এবং সাধারণত স্থায়ী ধরনের। সমস্যা থাকে অন্তঃকর্ণে (ককলিয়া) বা শ্রবণ স্নায়ুতে (অডিটরি নার্ভ)। এখানে শব্দ তরঙ্গ বৈদ্যুতিক সংকেতে রূপান্তরিত হয় না বা সঠিকভাবে মস্তিষ্কে পৌঁছায় না। প্রধান কারণগুলো:
- বয়সের সাথে সম্পর্কিত (প্রেসবাইকিউসিস): স্বাভাবিক বার্ধক্যজনিত প্রক্রিয়া, সাধারণত ৬০ বছরের পর থেকে শুরু হয়। বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান প্রবীণ জনসংখ্যার সাথে এই সমস্যাও বাড়ছে।
- শব্দদূষণের প্রভাব (Noise-Induced Hearing Loss – NIHL): বাংলাদেশের শহরাঞ্চলে, বিশেষ করে ঢাকা, চট্টগ্রাম, গাজীপুরে শব্দদূষণ ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। রিকশা-অটোরিকশার হর্ন, কলকারখানার শব্দ, উঁচু ভলিউমে গান শোনা – দীর্ঘদিন ধরে উচ্চ শব্দের সংস্পর্শে থাকলে ককলিয়ার সূক্ষ্ম চুলের মতো কোষগুলো স্থায়ীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। গার্মেন্টস কর্মী, ট্রাফিক পুলিশ, নির্মাণ শ্রমিকেরা বিশেষ ঝুঁকিতে।
- কিছু শক্তিশালী ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া (ওটোটক্সিক ড্রাগস): নির্দিষ্ট কিছু অ্যান্টিবায়োটিক (যেমন জেন্টামাইসিন), কেমোথেরাপির ওষুধ, উচ্চমাত্রার পেইনকিলার দীর্ঘমেয়াদে ব্যবহারে শ্রবণশক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
- রোগের প্রভাব: মাম্পস, মিজলস, মেনিনজাইটিস, মেনিয়ার্স ডিজিজ ইত্যাদি রোগ কানে শোনার সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে।
- মাথায় আঘাত: মাথায় গুরুতর আঘাত ককলিয়া বা শ্রবণ স্নায়ু ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।
- জন্মগত ত্রুটি: কিছু শিশু জন্ম থেকেই শ্রবণ সমস্যা নিয়ে জন্মায়।
-
মিশ্র শ্রবণ ক্ষতি (Mixed Hearing Loss): উপরের দুটি ধরনের সমস্যা একসাথে থাকলে তাকে মিশ্র শ্রবণ ক্ষতি বলে।
- টিনিটাস (কানে শোঁ শোঁ শব্দ): যদিও এটি সরাসরি শোনার ক্ষমতা কমায় না, কিন্তু কানে অবিরাম ঝিঁঝিঁ, গুঞ্জন বা হুইসেলের মতো শব্দ (যা বাইরে থেকে আসে না) শোনা যায়। এটি প্রায়ই অন্য কোনও কানে শোনার সমস্যার (বিশেষ করে সেন্সরিনিউরাল) উপসর্গ বা সহগামী সমস্যা হিসেবে দেখা দেয়। এটি ব্যক্তির মানসিক চাপ, ঘুমের ব্যাঘাত, মনোযোগের সমস্যা তৈরি করতে পারে।
বাংলাদেশে প্রেক্ষাপট: বাংলাদেশে কানে শোনার সমস্যা একটি অবহেলিত জনস্বাস্থ্য ইস্যু। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) মতে, বাংলাদেশে প্রায় ১.৬ কোটি মানুষ নানান মাত্রার শ্রবণ ক্ষতিতে ভুগছেন। শহুরে এলাকায় শব্দদূষণ, গ্রামীণ এলাকায় সংক্রামক রোগের প্রকোপ ও প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার সীমিত সুযোগ এই সমস্যাকে আরও বাড়িয়ে তুলছে। শিশুদের মধ্যে বিলম্বিত ভাষা বিকাশের একটি বড় কারণ হলো শোনার সমস্যা চিহ্নিত না হওয়া।
কানে শোনার সমস্যার লক্ষণ: কখন সতর্ক হবেন?
শ্রবণ ক্ষতি অনেক সময় ধীরে ধীরে হয়, তাই ব্যক্তি নিজেও বুঝতে পারেন না। পরিবারের সদস্য বা কাছের মানুষরাই প্রায়শ প্রথম টের পান। নিচের লক্ষণগুলো দেখা দিলে দেরি না করে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের (ইএনটি বা অডিওলজিস্ট) পরামর্শ নিন:
- অন্যের কথা বারবার বলতে বলা: “আবার বলুন তো?”, “কী বললেন বুঝতে পারিনি” – এই ধরনের কথা প্রায়ই বলা।
- উচ্চ শব্দে টিভি বা রেডিও শোনা: পরিবারের অন্য সদস্যদের কাছে যেটা অস্বস্তিকর মনে হয়।
- গুঞ্জন বা শোরগোলপূর্ণ পরিবেশে (রেস্টুরেন্ট, বাজার) কথা বুঝতে অসুবিধা: পটভূমির শব্দের জন্য মূল কথোপকথন শুনতে না পাওয়া।
- টেলিফোনে কথা বলতে সমস্যা: কার কথা শুনতে অসুবিধা, বিশেষ করে অপরিচিত নম্বর থেকে ফোন এলে।
- কানে অবিরাম শব্দ (টিনিটাস): ঝিঁঝিঁ, গুঞ্জন, হুইসেল, হৃদস্পন্দনের শব্দ ইত্যাদি।
- কানে ব্যথা, চাপ বা পূর্ণতার অনুভূতি: সংক্রমণ বা অন্যান্য সমস্যার ইঙ্গিত।
- কান থেকে তরল বের হওয়া: সংক্রমণের লক্ষণ।
- মাথা ঘোরা বা ভারসাম্য হারানো: অন্তঃকর্ণ ভারসাম্য রক্ষায়ও ভূমিকা রাখে।
- শিশুদের ক্ষেত্রে: জন্মের পর শব্দে সাড়া না দেয়া, শব্দের উৎস খুঁজতে না পারা, কথা বলতে দেরি হওয়া, স্কুলে পড়াশোনায় পিছিয়ে পড়া, জোরে জোরে কথা বলা ইত্যাদি। শিশুদের ক্ষেত্রে কানে শোনার সমস্যা দ্রুত শনাক্ত করা অত্যন্ত জরুরি ভাষা ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশের জন্য।
সতর্কতার বিষয়: কানে হঠাৎ করে শোনা কমে গেলে (সাডেন হিয়ারিং লস) তা চিকিৎসা জরুরি অবস্থা হিসেবে বিবেচিত হয়। অবিলম্বে হাসপাতালের ইএনটি বিভাগে যোগাযোগ করতে হবে। সময়মতো চিকিৎসা না পেলে স্থায়ী ক্ষতি হতে পারে।
কানে শোনার সমস্যার কারণ: শনাক্ত করুন ঝুঁকির উৎস
কানে শোনার সমস্যার পেছনে নানা রকম কারণ কাজ করে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কিছু কারণ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য:
- শব্দদূষণ (Noise Pollution): এটি বাংলাদেশে শ্রবণ ক্ষতির প্রধান প্রতিরোধযোগ্য কারণ। ঢাকার মতো মহানগরীতে শব্দের মাত্রা প্রায়ই নিরাপদ সীমা (৬০-৭০ ডেসিবেল) ছাড়িয়ে যায় (প্রায়শই ১০০ ডেসিবেলেরও বেশি)। রাস্তাঘাট, নির্মাণকাজ, শিল্পকারখানা, উঁচু ভলিউমে মিউজিক সিস্টেম এবং সামাজিক অনুষ্ঠানের শব্দ দীর্ঘমেয়াদে কানের মারাত্মক ক্ষতি করে। গার্মেন্টস শ্রমিক, রিকশাচালক, ট্রাফিক পুলিশ, ফ্যাক্টরি কর্মী, নির্মাণ শ্রমিকেরা বিশেষ ঝুঁকিতে। এমনকি স্মার্টফোনে ইয়ারফোন ব্যবহার করে দীর্ঘসময় উচ্চ শব্দে গান শোনাও ক্ষতিকর।
- বয়স (Age-Related): বার্ধক্যজনিত শ্রবণ ক্ষতি (প্রেসবাইকিউসিস) একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। বাংলাদেশেও গড় আয়ু বৃদ্ধির সাথে সাথে এই সমস্যা বাড়ছে। সাধারণত উচ্চ ফ্রিকোয়েন্সির শব্দ (মহিলা ও শিশুদের কণ্ঠস্বর, পাখির ডাক) শোনায় প্রথমে অসুবিধা হয়।
- কানের সংক্রমণ (Ear Infections): বিশেষ করে ওটিটিস মিডিয়া (কানের মাঝখানে সংক্রমণ) শিশুদের মধ্যে অত্যন্ত সাধারণ। বাংলাদেশের গ্রামীণ এলাকায় স্বাস্থ্যবিধি ও চিকিৎসা সেবার অভাবে সংক্রমণ দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে এবং কানের পর্দা ফুটো হওয়া বা মধ্যভাগের হাড় ক্ষয়ে যাওয়ার মতো জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে। কানের খোল জমে যাওয়াও সংক্রমণ ও সাময়িক শোনার সমস্যার কারণ।
- জন্মগত কারণ (Congenital Causes): গর্ভাবস্থায় মায়ের সংক্রমণ (যেমন রুবেলা), জন্মের সময় জটিলতা, বা নির্দিষ্ট কিছু জিনগত রোগের কারণে শিশু শ্রবণ সমস্যা নিয়ে জন্মাতে পারে।
- মাথায় আঘাত বা কানে আঘাত (Head/Ear Trauma): দুর্ঘটনা, মারাত্মক চড় বা কানের ভেতরে কোনও বস্তু ঢুকিয়ে কান পরিষ্কারের চেষ্টা করলে কানের পর্দা ছিদ্র হতে পারে বা অন্তঃকর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
- ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া (Ototoxic Medications): কিছু অ্যান্টিবায়োটিক (যেমন জেন্টামাইসিন, নিওমাইসিন), কেমোথেরাপির ওষুধ (সিসপ্লাটিন), উচ্চমাত্রার অ্যাসপিরিন বা কুইনিন দীর্ঘমেয়াদে বা উচ্চমাত্রায় ব্যবহারে শ্রবণশক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া ওষুধ সেবন এড়ানো উচিত।
- কিছু রোগব্যাধি (Medical Conditions): মাম্পস, মিজলস, মেনিনজাইটিস, মেনিয়ার্স ডিজিজ (কানে চাপ, টিনিটাস, মাথা ঘোরা ও শ্রবণ ক্ষতি), ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, অটোইমিউন ডিজিজ ইত্যাদি কানে শোনার সমস্যার সাথে সম্পর্কিত হতে পারে।
- ধূমপান ও অ্যালকোহল: ধূমপান কানে রক্ত চলাচল কমিয়ে দিতে পারে। অতিরিক্ত অ্যালকোহল সেবনও ক্ষতির কারণ হতে পারে।
- কানের খোল জমে যাওয়া (Earwax Buildup): ভুলভাবে কান পরিষ্কার করার চেষ্টা (যেমন কটন বাডের অত্যধিক ব্যবহার যা খোলকে আরও ভেতরে ঠেলে দেয়) বা প্রাকৃতিকভাবেই অত্যধিক খোল উৎপাদন হলে শোনায় বাধা সৃষ্টি করে।
বাংলাদেশের বিশেষ চ্যালেঞ্জ: জনবহুলতা, দারিদ্র্য, স্বাস্থ্যসেবায় অসম প্রবেশাধিকার, স্বাস্থ্য সচেতনতার অভাব এবং পরিবেশ দূষণ (বিশেষ করে শব্দদূষণ) বাংলাদেশে কানে শোনার সমস্যার প্রকোপ ও জটিলতা বাড়িয়ে তুলছে। অনেক ক্ষেত্রে দেরিতে রোগ নির্ণয় এবং চিকিৎসার অভাবে সমস্যা স্থায়ী রূপ নেয়।
কানে শোনার সমস্যার প্রতিকার ও চিকিৎসা: আশার আলো দেখুন
ভালো খবর হলো, বেশিরভাগ কানে শোনার সমস্যারই কার্যকর প্রতিকার বা চিকিৎসা রয়েছে। চিকিৎসার ধরন নির্ভর করে সমস্যার ধরন, কারণ ও তীব্রতার উপর। বাংলাদেশে এখন উন্নত মানের ইএনটি ও অডিওলজি সেবা পাওয়া যায়, বিশেষ করে বড় শহরগুলোর সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও বেসরকারি হাসপাতাল/ক্লিনিকে।
-
কন্ডাকটিভ হিয়ারিং লসের চিকিৎসা:
- কানের খোল অপসারণ (Earwax Removal): ইএনটি বিশেষজ্ঞ নিরাপদ পদ্ধতিতে (সাকশন, সিরিঞ্জিং বা বিশেষ যন্ত্র দিয়ে) কানের খোল বের করে আনেন। এটি দ্রুত এবং কার্যকর সমাধান। কখনই নিজে কটন বাড, পিন বা অন্য কিছু দিয়ে খোল বের করার চেষ্টা করবেন না!
- ওষুধের মাধ্যমে সংক্রমণের চিকিৎসা: ব্যাকটেরিয়াল সংক্রমণের জন্য অ্যান্টিবায়োটিক ড্রপ বা ওরাল মেডিসিন। ফাংগাল ইনফেকশনের জন্য অ্যান্টিফাংগাল ড্রপ। প্রদাহ কমাতে কখনও স্টেরয়েড ড্রপও দেয়া হয়।
- কানের পর্দায় ছিদ্র মেরামত (টিমপ্যানোপ্লাস্টি): যদি ছিদ্র নিজে থেকে না সারে, তাহলে সার্জারির মাধ্যমে পর্দা মেরামত করা হয়। বাংলাদেশের বড় হাসপাতালগুলোতে এই সার্জারি সফলভাবে করা হয়।
- অটোস্ক্লেরোসিসের সার্জারি (স্টেপেডেক্টমি বা স্টেপেডোটমি): আক্রান্ত স্টেপিস হাড় সরিয়ে কৃত্রিম ইমপ্লান্ট বসানো হয়। এটি একটি সূক্ষ্ম অপারেশন।
- ভেন্টিলেশন টিউব (Grommet Insertion): দীর্ঘস্থায়ী ওটিটিস মিডিয়ায় যেখানে তরল জমে, সেখানে কানের পর্দায় ছোট টিউব বসিয়ে তরল বের করে দেয়া হয় এবং বায়ু চলাচলের সুযোগ করে দেয়া হয়। শিশুদের মধ্যে এটি বেশি করা হয়।
-
সেন্সরিনিউরাল হিয়ারিং লসের চিকিৎসা:
- হিয়ারিং এইড (শ্রবণ সহায়ক যন্ত্র): এটিই সেন্সরিনিউরাল এবং মিশ্র শ্রবণ ক্ষতির প্রধান ও সবচেয়ে কার্যকর চিকিৎসা পদ্ধতি। আধুনিক ডিজিটাল হিয়ারিং এইডগুলো অত্যন্ত উন্নত, ক্ষুদ্রাকৃতির এবং ব্যক্তির শ্রবণ ক্ষতির ধরন অনুযায়ী কাস্টমাইজড করা যায়। এগুলো শুধু শব্দই জোরালো করে না, পটভূমির শব্দ কমিয়ে মূল কথোপকথন স্পষ্ট করে। ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহীসহ বড় শহরগুলোতে লাইসেন্সপ্রাপ্ত অডিওলজিস্টদের ক্লিনিকে বিস্তৃত পরিসরের হিয়ারিং এইড পাওয়া যায়। সরকারি হাসপাতালেও কিছু সহায়তা পাওয়া যেতে পারে। হিয়ারিং এইড বেছে নেয়া, ফিটিং করা এবং এর সাথে মানিয়ে নেয়া একটি বিশেষজ্ঞের তত্ত্বাবধানে হওয়া উচিত।
- ককলিয়ার ইমপ্লান্ট (Cochlear Implant): যাদের গভীর সেন্সরিনিউরাল হিয়ারিং লস আছে এবং হিয়ারিং এইডে তেমন সুবিধা পায় না, তাদের জন্য এটি একটি বিপ্লবী চিকিৎসা। এটি একটি সার্জিক্যাল ইমপ্লান্ট যা সরাসরি শ্রবণ স্নায়ুকে উদ্দীপিত করে। বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ), ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং কিছু বেসরকারি হাসপাতালে (যেমন স্কয়ার, অ্যাপোলো) এই জটিল সার্জারি ও পুনর্বাসন সেবা দেওয়া হয়। তবে এটি ব্যয়বহুল এবং দীর্ঘ পুনর্বাসন প্রক্রিয়া প্রয়োজন।
- অস্থি-বহনশীল শ্রবণযন্ত্র (Bone-Anchored Hearing Aids – BAHA): যাদের বাইরের বা মধ্যভাগের কানে সমস্যা আছে (যেমন জন্মগত ত্রুটি, ক্রনিক সংক্রমণ যার জন্য প্রচলিত হিয়ারিং এইড ব্যবহার করা যায় না), তাদের জন্য এই যন্ত্র। এটি খুলির হাড়ের মধ্য দিয়ে শব্দের কম্পন অন্তঃকর্ণে পৌঁছে দেয়।
- ওষুধ: হঠাৎ শ্রবণ ক্ষতির (সাডেন হিয়ারিং লস) ক্ষেত্রে উচ্চমাত্রার স্টেরয়েড (ওরাল বা ইনজেকশন) দ্রুত শুরু করা জরুরি। মেনিয়ার্স ডিজিজের জন্য বিশেষ ডায়েট, মূত্রবর্ধক ওষুধ এবং জীবনযাত্রার পরিবর্তন সুপারিশ করা হয়। টিনিটাসের জন্য নির্দিষ্ট কিছু থেরাপি (টিনিটাস রিট্রেনিং থেরাপি – TRT) বা ওষুধ ব্যবহার করা হতে পারে, যদিও এর স্থায়ী নিরাময় এখনও আবিষ্কৃত হয়নি।
- অডিটরি রিহ্যাবিলিটেশন থেরাপি: হিয়ারিং এইড বা ইমপ্লান্ট ব্যবহারকারীদের শব্দ চিনতে, কথা বুঝতে এবং যোগাযোগের দক্ষতা বাড়াতে সাহায্য করে।
- সহায়ক শোনার যন্ত্র (Assistive Listening Devices – ALDs): হিয়ারিং এইডের পাশাপাশি বা কখনও কখনও এর বিকল্প হিসেবে কিছু সহায়ক যন্ত্র ব্যবহার করা যায়:
- টিভি বা ফোনের জন্য বিশেষ হেডফোন।
- ক্লাসরুম বা সভাকক্ষে ব্যবহারের জন্য FM সিস্টেম (মাইক্রোফোন থেকে সরাসরি হিয়ারিং এইডে বা রিসিভারে শব্দ প্রেরণ করে)।
- ফোনে কথা বলার সময় শব্দ জোরালো করে এমন যন্ত্র।
- দরজার বেল, ফায়ার অ্যালার্মের জন্য ভিজুয়াল বা ভাইব্রেটিং সতর্কীকরণ যন্ত্র।
বাংলাদেশে সেবা প্রাপ্তি: সরকারি হাসপাতালে ইএনটি বিভাগে প্রাথমিক পরীক্ষা ও চিকিৎসা কম খরচে বা বিনামূল্যে পাওয়া যায়। হিয়ারিং এইড কিনতে গেলে বেসরকারি ক্লিনিকের দিকে যেতে হয়, যেখানে দাম অনেক রেঞ্জের (কয়েক হাজার থেকে লক্ষাধিক টাকা)। ককলিয়ার ইমপ্লান্টের খরচ খুবই বেশি (১০-২০ লক্ষ টাকা বা তারও বেশি)। কিছু এনজিও (যেমন সেন্টার ফর দ্য রিহ্যাবিলিটেশন অফ দ্য প্যারালাইজড – সিআরপি, হিয়ারিং অ্যান্ড স্পিচ ইমপেয়ারমেন্ট কেয়ার – এইচএসআইসি) সীমিত আকারে স্বল্পমূল্যে বা বিনামূল্যে হিয়ারিং এইড ও পুনর্বাসন সেবা প্রদান করে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার শ্রবণক্ষমতা বিষয়ক রিপোর্টে এই ধরনের সেবার প্রসারে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে: WHO Report on Hearing (বাংলাদেশে প্রাসঙ্গিক ডেটা ও সুপারিশের জন্য দেখুন)।
কানে শোনার সমস্যা প্রতিরোধ: সহজ উপায়ে সুস্থ কান
প্রতিরোধ সবসময় প্রতিকারের চেয়ে উত্তম। কিছু সহজ সচেতনতা ও অভ্যাস গড়ে তুলে কানে শোনার সমস্যার ঝুঁকি অনেকাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব:
- শব্দদূষণ থেকে কান বাঁচান (Protect from Noise): এটি বাংলাদেশে শ্রবণক্ষমতা রক্ষার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।
- উচ্চ শব্দের উৎস এড়িয়ে চলুন (যতটা সম্ভব)।
- শব্দদূষণপূর্ণ পরিবেশে (ফ্যাক্টরি, কনসার্ট, নির্মাণস্থল) অবশ্যই ইয়ারপ্লাগ বা ইয়ারমাফ (শব্দনিরোধক) ব্যবহার করুন। ঢাকার নিউমার্কেট বা অনলাইনে ভালো মানের ইয়ারপ্লাগ পাওয়া যায়।
- হেডফোন বা ইয়ারফোনে গান শুনুন ৬০/৬০ নিয়ম মেনে: ভলিউম ৬০% এর নিচে রাখুন এবং একটানা ৬০ মিনিটের বেশি শুনবেন না। বিরতি নিন।
- গাড়ি বা বাড়িতে হর্নের ব্যবহার কম করুন। সামাজিক অনুষ্ঠানে সাউন্ড সিস্টেমের ভলিউম যুক্তিসঙ্গত পর্যায়ে রাখুন।
- কান পরিষ্কারের সঠিক পদ্ধতি: কানপাটা (পিনা) শুধু একটি ভেজা কাপড় বা টিস্যু দিয়ে মুছে নিন। কানের ভেতর (কাননালী) পরিষ্কার করার দরকার নেই! এটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে পরিষ্কার হয়। কটন বাড, কাঠি, চাবি, পিন বা অন্য কোনও বস্তু কানের ভেতরে প্রবেশ করাবেন না। এতে খোল ভেতরে ঢুকে যায়, পর্দা ফুটো হতে পারে বা সংক্রমণ হতে পারে। যদি খোল জমে শোনায় সমস্যা হয়, ইএনটি ডাক্তারের কাছে যান।
- কানের সংক্রমণ প্রতিরোধ:
- সাঁতারের সময় ইয়ারপ্লাগ ব্যবহার করুন বা সাঁতারের পর কান ভালো করে শুকিয়ে নিন (তুলা দিয়ে শুধু বাইরের অংশ শুকান, ভেতরে নয়)।
- কানে পানি ঢুকলে মাথা কাত করে হালকা টান দিন বা হেয়ার ড্রায়ারের ঠাণ্ডা বাতাস (কম শক্তিতে) দূরত্ব রেখে সামান্য দেয়া যেতে পারে।
- সর্দি-কাশি বা অ্যালার্জি থাকলে সঠিক চিকিৎসা নিন, যাতে কানে সংক্রমণ না ছড়ায়।
- শিশুদের কান পরিষ্কারের ক্ষেত্রে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করুন।
- নিয়মিত শ্রবণ পরীক্ষা (Hearing Test): বিশেষ করে যদি আপনার ঝুঁকিপূর্ণ পেশায় কাজ করেন (উচ্চ শব্দের পরিবেশ), বয়স ৫০ পেরিয়েছে, বা আগে থেকেই শোনায় সামান্য সমস্যা মনে হয়। বড় বেসরকারি হাসপাতাল ও অডিওলজি ক্লিনিকে অডিওমেট্রি টেস্ট করা যায়। প্রাথমিক স্ক্রিনিং সরকারি হাসপাতালেও পাওয়া যায়।
- ওটোটক্সিক ওষুধ সতর্কতার সাথে ব্যবহার: যে কোনও ওষুধ ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া সেবন করবেন না। যদি ডাক্তার এমন ওষুধ দেন যা শ্রবণের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ, তাহলে নিয়মিত শ্রবণ পরীক্ষার পরামর্শ নিন।
- ধূমপান ত্যাগ করুন: ধূমপান কানে রক্ত চলাচল কমিয়ে দেয়।
- সুস্থ জীবনযাপন: সুষম খাদ্য, নিয়মিত ব্যায়াম (যা রক্ত সঞ্চালন বাড়ায়), রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা সামগ্রিক স্বাস্থ্যের পাশাপাশি শ্রবণশক্তির জন্যও ভালো।
গুরুত্বপূর্ণ: শিশু জন্মের পরপরই নবজাতকের শ্রবণ পরীক্ষা (Newborn Hearing Screening) করানো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের অনেক বড় হাসপাতালে এখন এই সুবিধা আছে। দ্রুত শনাক্তকরণ ভাষা ও সামাজিক বিকাশের জন্য অপরিহার্য।
কানে শোনার সমস্যা নিয়ে মানসিক স্বাস্থ্য ও সামাজিক দিক
কানে শোনার সমস্যা শুধু শারীরিক সমস্যা নয়, এর গভীর মানসিক ও সামাজিক প্রভাব রয়েছে। বাংলাদেশের মতো সমাজে যেখানে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের প্রতি সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি এখনও পুরোপুরি ইতিবাচক নয়, সেখানে এই সমস্যা আরও কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।
- সামাজিক বিচ্ছিন্নতা: কথোপকথনে অংশ নিতে না পারার কারণে ব্যক্তি ধীরে ধীরে সামাজিক অনুষ্ঠান, পারিবারিক আড্ডা, ধর্মীয় সমাবেশ থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিতে শুরু করেন। একাকিত্ব বোধ বাড়ে।
- কর্মক্ষেত্রে সমস্যা: মিটিং, প্রেজেন্টেশন, ফোন কল ইত্যাদিতে অসুবিধার কারণে চাকরি হারানোর ঝুঁকি বাড়ে, কর্মদক্ষতা কমে, পদোন্নতির সুযোগ কমে যায়। অনেকেই আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলেন।
- পারিবারিক সম্পর্কে টানাপোড়েন: বারবার কথা বলতে বলতে পরিবারের সদস্যরা বিরক্ত হতে পারেন। ভুল বোঝাবুঝির কারণে ঝগড়া হতে পারে। দাম্পত্য জীবনে প্রভাব পড়তে পারে।
- হতাশা ও উদ্বেগ: যোগাযোগের অসুবিধা, একাকিত্ব এবং ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তা হতাশা, উদ্বেগ এমনকি ডিপ্রেশনের কারণ হতে পারে। টিনিটাস থাকলে তা আরও ভয়াবহ রূপ নিতে পারে।
- আত্মসম্মানে আঘাত: অন্যের সাহায্য নিতে হয়, বারবার কথা বলতে বলতে হয় – এসবে ব্যক্তির আত্মসম্মানবোধ ক্ষুণ্ণ হতে পারে।
কী করণীয়?
- খোলামেলা আলোচনা: পরিবার ও বন্ধুদের সাথে নিজের সমস্যা ও চাহিদাগুলো শেয়ার করুন। তাদের বুঝতে সাহায্য করুন।
- সহায়ক যন্ত্র ব্যবহারে সিদ্ধান্ত নিন: হিয়ারিং এইড বা অন্যান্য যন্ত্র ব্যবহার করে যোগাযোগের উন্নতি করা সম্ভব। এতে আত্মবিশ্বাস ফিরে আসবে।
- সাপোর্ট গ্রুপ: অন্যান্য যারা একই সমস্যায় ভুগছেন তাদের সাথে কথা বলুন। অভিজ্ঞতা শেয়ার করলে মানসিক শক্তি পাওয়া যায়। বাংলাদেশে কিছু সংগঠন (যেমন বাংলাদেশ ন্যাশনাল ফেডারেশন অফ দ্য ডিফ – বিএনএফডি) কাজ করে।
- কাউন্সেলিং: যদি মানসিক চাপ, হতাশা বা উদ্বেগ খুব বেশি হয়, মনোবিদ বা কাউন্সেলরের সাহায্য নিন।
- সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি: শ্রবণ সমস্যা নিয়ে খোলামেলা আলোচনা, এই সমস্যায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের প্রতি সহানুভূতিশীল ও সহযোগিতামূলক আচরণ করার জন্য সামাজিক আন্দোলন প্রয়োজন।
কানে শোনার সমস্যা কোনো লজ্জার বিষয় নয়, এটি একটি স্বাস্থ্য সমস্যা মাত্র। সঠিক চিকিৎসা, সহায়ক যন্ত্র ও সামাজিক সহযোগিতার মাধ্যমে একজন ব্যক্তি সম্পূর্ণ ও সক্রিয় জীবনযাপন করতে পারেন।
জেনে রাখুন (FAQs)
-
প্রশ্ন: কানে শোনা কমে গেলে প্রথমেই কি করব?
উত্তর: প্রথমেই একজন নাক-কান-গলা (ইএনটি) বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের শরণাপন্ন হন। তিনি কানের প্রাথমিক পরীক্ষা করবেন। প্রয়োজনে তিনি আপনাকে একজন অডিওলজিস্টের কাছে রেফার করবেন শ্রবণ পরীক্ষার (অডিওগ্রাম) জন্য। হঠাৎ করে শোনা কমে গেলে (সাডেন হিয়ারিং লস) দ্রুততম সময়ে (অন্তত ৭২ ঘন্টার মধ্যে) চিকিৎসা শুরু করা জরুরি। নিজে থেকে কোনও ওষুধ বা তেল ব্যবহার করবেন না। -
প্রশ্ন: হিয়ারিং এইড কতটা কার্যকর? আমি কি এটি ব্যবহার করে স্বাভাবিকের মতো শুনতে পাব?
উত্তর: আধুনিক হিয়ারিং এইড অত্যন্ত উন্নত প্রযুক্তির। এটি আপনার কানে শোনার সমস্যার ধরন ও মাত্রা অনুযায়ী শব্দকে বাড়িয়ে, পরিষ্কার করে এবং পটভূমির শব্দ কমিয়ে শোনার ক্ষমতা অনেকাংশে ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করে। তবে এটি স্বাভাবিক কানের মতো ১০০% কার্যকর নয় এবং ব্যবহারকারীকে এর সাথে মানিয়ে নিতে কিছু সময় (কয়েক সপ্তাহ বা মাস) লাগতে পারে। নিয়মিত ব্যবহার ও অডিওলজিস্টের সাথে ফলো-আপে যাওয়া জরুরি। এটি আপনাকে স্বাচ্ছন্দ্যে যোগাযোগ করতে, সামাজিকভাবে সক্রিয় থাকতে এবং জীবনযাত্রার মান বাড়াতে সাহায্য করবে। -
প্রশ্ন: কানে ব্যথা এবং শোনায় সমস্যা একসাথে হলে কি করব?
উত্তর: কানে ব্যথা এবং শোনায় সমস্যা একসাথে হওয়া প্রায়শই কানের সংক্রমণ (ওটিটিস মিডিয়া বা এক্সটার্না), কানের পর্দায় চাপ বা কানের পর্দা ফুটো হওয়ার লক্ষণ। এ ধরনের উপসর্গ দেখা দিলে দ্রুত ইএনটি ডাক্তারের পরামর্শ নিন। ডাক্তার কারণ নির্ণয় করে অ্যান্টিবায়োটিক, ব্যথানাশক বা অন্যান্য প্রয়োজনীয় ওষুধ দেবেন। নিজে থেকে কানে তেল বা কোনও কিছু ঢালবেন না, তাতে অবস্থা আরও খারাপ হতে পারে। -
প্রশ্ন: স্মার্টফোন বা হেডফোনে বেশি গান শুনলে কি শ্রবণশক্তি কমে যায়?
উত্তর: হ্যাঁ, অবশ্যই কমে যায়। স্মার্টফোন বা হেডফোনে উচ্চ ভলিউমে দীর্ঘক্ষণ গান শোনা শব্দদূষণজনিত শ্রবণ ক্ষতি (Noise-Induced Hearing Loss) এর একটি বড় কারণ, বিশেষ করে তরুণদের মধ্যে। ৬০/৬০ নিয়ম মেনে চলুন: ভলিউম ৬০% এর নিচে রাখুন এবং একটানা ৬০ মিনিটের বেশি শুনবেন না। এরপর কানে বিশ্রাম দিন। নয়েজ-ক্যানসেলিং হেডফোন ব্যবহার করলে কম ভলিউমে পরিষ্কার শব্দ শোনা যায়। শোঁ শোঁ শব্দ (টিনিটাস) বা কানে চাপ লাগা প্রথম সতর্কীকরণ লক্ষণ। -
প্রশ্ন: কানে পানি ঢুকলে কি করা উচিত?
উত্তর: কানে পানি ঢুকলে সাধারণত আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। মাথা কাত করে হালকা করে কানপাটা টান দিন বা একই দিকে মাথা কাত করে লাফ দিন। চিবানো বা হাঁচি দেয়ার চেষ্টাও কাজ করতে পারে। কানের বাইরের অংশ শুকনো কাপড় বা টিস্যু দিয়ে মুছে নিন। কটন বাড ব্যবহার করবেন না। বেশিরভাগ সময় পানি নিজে থেকেই বেরিয়ে আসে। যদি ২৪-৪৮ ঘন্টার মধ্যে পানি না বেরোয়, কানে ব্যথা হয়, শোনায় সমস্যা হয় বা দুর্গন্ধযুক্ত তরল বের হয়, তাহলে ডাক্তারের কাছে যান। - প্রশ্ন: বয়স্ক ব্যক্তিদের কানে কম শোনার সমস্যা কি ঠিক করা সম্ভব?
উত্তর: বয়সজনিত শ্রবণ ক্ষতি (প্রেসবাইকিউসিস) সাধারণত স্থায়ী। তবে, এর মানে এই নয় যে এর কোনও সমাধান নেই। হিয়ারিং এইড এই সমস্যায় সবচেয়ে কার্যকরী ও প্রচলিত চিকিৎসা পদ্ধতি। এটি শোনার ক্ষমতা অনেকাংশে ফিরিয়ে আনে, যোগাযোগের সুযোগ বাড়ায়, একাকিত্ব ও হতাশা কমায় এবং জীবনযাত্রার মান উন্নত করে। বয়স শোনার যন্ত্র ব্যবহারের বাধা নয়। অডিওলজিস্টের পরামর্শে সঠিক যন্ত্র বেছে নেওয়া এবং ধৈর্য ধরে ব্যবহার অভ্যাস করা গেলে বয়স্ক ব্যক্তিরা এর সুফল পাবেন।
কানে শোনার সমস্যা জীবনকে ম্লান করে দিতে পারে, সম্পর্কগুলোকে দূরত্বে ঠেলে দিতে পারে, আপনাকে বিচ্ছিন্নতার গভীরে নিয়ে যেতে পারে। কিন্তু এই অন্ধকারের মাঝেও আশার আলো জ্বলজ্বল করছে। আপনার শ্রবণশক্তি যে শুধু একটি ইন্দ্রিয়, তা নয়; এটি আপনার জীবনের গান, প্রিয়জনের স্পর্শ, বিশ্বের সাথে সংযোগের অমূল্য সেতু। আজই সচেতন হোন – শব্দদূষণ থেকে কানকে সুরক্ষা দিন, কান পরিষ্কারের ভুল অভ্যাস ত্যাগ করুন, উপসর্গ দেখা দিলে দেরি না করে ইএনটি বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন। আধুনিক হিয়ারিং এইড এবং চিকিৎসা পদ্ধতিগুলো অত্যন্ত উন্নত; এগুলো কেবল শব্দই ফেরায় না, ফিরিয়ে আনে আত্মবিশ্বাস, সামাজিকতা এবং জীবনের প্রতি ভালোবাসা। আপনার শ্রবণশক্তি আপনার অমূল্য সম্পদ; এর যত্ন নিন, সময়মতো পদক্ষেপ নিন, এবং বিশ্বের সমস্ত সুরেলা আওয়াজের সাক্ষী হয়ে জীবনকে পূর্ণতা দিয়ে উপভোগ করুন। আজই আপনার শ্রবণশক্তির গুরুত্ব উপলব্ধি করুন এবং প্রয়োজনে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে দ্বিধা করবেন না।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।