ইসলামের ইতিহাসে এমন বহু ঘটনা আছে যা আমাদের হৃদয় স্পর্শ করে, আমাদের বিবেককে নাড়া দেয়, এবং জীবন চলার পথ দেখায়। আজ আমরা তেমনই এক অনন্য সাহাবি — কাব (কাহফ) বিন মালেক (رضي الله عنه)-এর ঘটনা জানব, যিনি সত্যবাদিতার পথে দাঁড়িয়ে নিজের সবচেয়ে কঠিন সময় পার করে পেয়েছিলেন আল্লাহর ক্ষমা।
তাঁর জীবনের এই অধ্যায় শুধু একটি গল্প নয় — এটি একটি আত্মশুদ্ধির যাত্রা, একটি শিক্ষণীয় দৃষ্টান্ত যে কীভাবে সত্য ও তাওবা একজন মানুষকে আল্লাহর নৈকট্যে পৌঁছে দিতে পারে।
তাবুক যুদ্ধ ও কাবের অনুপস্থিতি
তাবুক যুদ্ধ ছিল ইসলামের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ মিশন। সেই সময় রোমান বাহিনী ইসলামের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছিল এবং রাসুলুল্লাহ ﷺ সাহাবিদের নিয়ে রওনা দেন উত্তর আরবের দিকে। সেই যুদ্ধ ছিল খুবই কষ্টকর — প্রচণ্ড গরম, দূরত্ব এবং শুষ্কতা। কিন্তু তারপরও, ঈমানদারদের জন্য সেটি ছিল আল্লাহর পথে এক গুরুত্বপূর্ণ জিহাদ।
কাব বিন মালেক ছিলেন এক অভিজ্ঞ সাহাবি। তিনি বদর, উহুদ, খন্দক — প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। কিন্তু এইবার, তাঁর মন তাকে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল।
প্রথমে ভাবলেন — “কাল প্রস্তুতি নেবো।”
পরদিন বললেন — “আরো সময় আছে।”
এইভাবে অলসতায়, দ্বিধায়, এবং কিছুটা গাফলতিতে দিন চলে যায়। যখন সেনাবাহিনী মদিনা থেকে রওনা হয়, তিনি তখনো অনিচ্ছায় ঘরে বসে।
সত্যের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ সাহাবি
যখন রাসুলুল্লাহ ﷺ বিজয়ী হয়ে মদিনায় ফিরে এলেন, তখন মুনাফিকরা একজনের পর একজন নানা অজুহাত দিতে থাকল। মিথ্যা বলেই তারা নিজেদের রক্ষা করতে চাইল।
কিন্তু কাব ভিন্ন ছিলেন। তিনি চিন্তা করলেন — আমি যদি আজ মিথ্যা বলি, রাসুল ﷺ হয়তো এখন আমাকে মাফ করে দেবেন, কিন্তু আল্লাহ জানেন আমি মিথ্যা বলছি।
তাই তিনি নবীর কাছে গিয়ে বললেন:
“ইয়া রাসুলুল্লাহ! আমার কোনো অজুহাত নেই। আমি সত্যি বলছি, আমি অলসতা করেছি। আমি এই যুদ্ধে অংশ নিতে পারতাম, কিন্তু নেইনি।”
রাসুলুল্লাহ ﷺ কাবের এই কথায় স্তব্ধ হয়ে গেলেন। তিনি অন্য কোনো শাস্তি দিলেন না, কেবল বললেন:
“তুমি যাও, আল্লাহই তোমার বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেবেন।”
সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন জীবনের ভয়াবহ সময়
এরপর কাবের জন্য শুরু হয় কঠিন পরীক্ষা। তাঁকে ৫০ দিনের জন্য সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন রাখা হয়। রাসুল ﷺ নির্দেশ দেন — কেউ কাবের সঙ্গে কথা বলবে না, তাঁকে সালাম দেবে না, এমনকি তাঁর স্ত্রীও তাঁর সঙ্গ ত্যাগ করে।
এই একাকী সময়টুকু ছিল অন্ধকারময়, বিষণ্নতায় ভরা। চারপাশের মানুষ, যাঁরা তাঁকে ভালোবাসতেন — সবাই যেন দূরে সরে গেলেন।
তিনি লিখে ফেলেন এক চিঠি এক খ্রিষ্টান রাজার উদ্দেশ্যে, যেখানে তাঁকে ডাকা হয়েছিল “আমাদের মাঝে আসো, আমরা তোমার মূল্য বুঝি।” কিন্তু সেই চিঠি তিনি সঙ্গে সঙ্গে পুড়িয়ে ফেলেন। কাব জানতেন — তাঁর জীবন আল্লাহর জন্য, তিনি দ্বীন ত্যাগ করবেন না।
আল্লাহর পক্ষ থেকে ক্ষমার সুসংবাদ
৫০ দিনের সেই কঠিন সময় শেষে এক সকাল। ফজরের সময় কাব নামাজ শেষ করে বসে ছিলেন। তখন হঠাৎ এক ডাক এল:
“হে কাব! খুশির সংবাদ! আল্লাহ তোমার তাওবা কবুল করেছেন!”
কাব কান্নায় ভেঙে পড়েন। তিনি দৌড়ে যান মসজিদে। রাসুলুল্লাহ ﷺ তাঁকে দেখে বলেন:
“আনন্দিত হও হে কাব! আজ তোমার জীবনের সবচেয়ে ভালো দিন — আল্লাহ তোমার তাওবা কবুল করেছেন।”
এ সময় নাজিল হয় সূরা আত-তাওবা, আয়াত ১১৮, যেখানে কাব ও তাঁর দুই সাথীর (হিলাল ইবন উমাইয়া ও মুরারা ইবন রাবি) তওবা কবুল হওয়ার ঘোষণা আসে।
কুরআনের আয়াত
وَعَلَى ٱلثَّلَـٰثَةِ ٱلَّذِينَ خُلِّفُوا۟ حَتَّىٰٓ إِذَا ضَاقَتْ عَلَيْهِمُ ٱلْأَرْضُ بِمَا رَحُبَتْ وَضَاقَتْ عَلَيْهِمْ أَنفُسُهُمْ…
“এবং ক্ষমা করা হয়েছে সেই তিনজনকে, যাদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত বিলম্বিত করা হয়েছিল — এমনকি তাদের জন্য পৃথিবী চওড়া হওয়া সত্ত্বেও তা সংকীর্ণ মনে হচ্ছিল এবং তাদের আত্মার ভেতরেও সংকট সৃষ্টি হয়েছিল… এরপর আল্লাহ তাদের প্রতি অনুগ্রহ করলেন, যাতে তারা তাওবা করে। নিশ্চয়ই আল্লাহ তাওবা কবুলকারী, পরম দয়ালু।”
— সূরা আত-তাওবা (৯:১১৮)
এই ঘটনার শিক্ষা
👉 সত্য বলার সাহস:
সবচেয়ে কঠিন সময়ে সত্য বলা সহজ নয়। কিন্তু কাব আমাদের দেখিয়ে গেছেন যে সত্যই শেষ পর্যন্ত মুক্তি দেয়।
👉 তাওবার গুরুত্ব:
কখনো দেরি হলেও তাওবা করলে আল্লাহ ক্ষমা করেন, যদি তা হয় অন্তরের গভীর অনুশোচনায় ভরা।
👉 পরীক্ষা আল্লাহর পক্ষ থেকে হয়:
যারা সত্য পথে থাকে, তাদের পরীক্ষা হয় — কিন্তু শেষে বিজয়ও তাঁরাই পান।
👉 সঠিক সময়ের সিদ্ধান্ত:
অন্যরা যখন মিথ্যা বলেছিল, কাব তখন সত্য বেছে নিয়েছিলেন — এটাই তাঁকে কুরআনের পাতায় তুলে ধরেছে।
আজকের মুসলিম সমাজে আমাদের অনেকেই হয়তো কোনো ভুল করি, গাফিলতি করি, কিন্তু সেটি লুকাতে গিয়ে আমরা আরও অন্যায় করে ফেলি। কাব বিন মালেকের এই ঘটনা আমাদের শেখায় — যদি আমরা সত্য বলি, অনুশোচনা করি, এবং আল্লাহর কাছে ফিরি, তবে আল্লাহ আমাদেরও ক্ষমা করবেন।
এই ঘটনাটি একটি উদাহরণ নয় শুধু, এটি এক অনন্ত অনুপ্রেরণা — এক সাহসিকতার গল্প, এক আত্মশুদ্ধির যাত্রা।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।