ধর্ম ডেস্ক : আল্লাহ তা‘য়ালার ইলমে (জ্ঞানে) কিয়ামতের একটি দিন নির্ধারিত আছে। সেদিনই কিয়ামত সংঘটিত হবে। সুতরাং কিয়ামত সত্য। যে মহান সত্তা নিজ কুদরাতে বিশ্ব জগত সৃষ্টি করেছেন; তিনি শেষও করতে পারেন। ধ্বংসের পর পুনরায় জীবিতও করতে পারেন একেই বলে কিয়ামত। আল্লাহর ইরশাদ-(ক) নিশ্চয়ই কিয়ামত আগমন করবে। এতে কোন সন্দেহ নেই। আর অবশ্যই আল্লাহপাক কবরের সকলকে পুনরুত্থিত করবেন। (সূরা আলহাজ্জ-৭) [নবী (সা:) এরশাদ করেন-(খ) কিয়ামতের দিনক্ষণ সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত ব্যক্তি (আমি/নবী) জিজ্ঞাসাকারী হতে অধিক জানে না। (কেননা তা গায়েবের অন্তর্ভূক্ত। আর গায়েবের খবর একমাত্র আল্লাহ জানেন)। (সহীহ বুখারী-১/১২) আল্লাহ তা‘য়ালা কবর হতে মৃত প্রাণীদের পুনরুত্থান ঘটাবেন এমনভাবে যে, সৃষ্টির মৌলিক বস্তুসমূহ (পানি, মাটি, আগুন, বাতাস) একত্রিত করবেন এবং তাতে রুহ প্রদান করবেন, একেই বা‘আছ বলে। একে সত্য বলে বিশ্বাস করতে হবে। আল্লাহতা‘য়ালা বলেন-অত:পর অবশ্যই তোমরা কিয়ামতের দিন পুনরুত্থিত হবে। (শরহে আকাইদ-১০২)
হযরত ইসরাফিল (আ:) এর শিংগায় ফুৎকারের মাধ্যমে কিয়ামত কায়েম হবে। শিংগার ফুৎকারে সকল জীবিত প্রাণী মৃত্যুবরণ করবে। আসমান ও যমিন ফেটে যাবে। সব কিছু চৌচির হয়ে ধ্বংস হয়ে যাবে। তারা কেবলমাত্র একটি মহানীনাদের অপেক্ষা করছে (সূরা সাদ-১৫) শিংগায় ফুৎকার ধ্বনিত হবে। আসমান ও যমীনের সকল প্রাণী চিৎকার দিয়ে মৃত্যুবরণ করবে, তবে আল্লাহ যাদের ইচ্ছা তাদের জীবিত রাখবেন। (সূরা আযযুমার-৬৮) কিয়ামত আল্লাহ তা‘আলার অতল রহস্যাবলীর অন্তর্গত। তার ঠিক ঠিক সময় কাকেও বলা হয়নি, কুরআন ও হাদীসের মাধ্যমে এতটুকু জানা যায় যে, কোন একটি মুহাররম মাসের দশ তারিখ জুমআর দিন হঠাৎ কিয়ামত সংঘটিত হবে। অবশ্যই কিয়ামত আগমন করবে। আমি তার দিন, সন গোপন করে রাখছি যাতে প্রত্যেক প্রাণী তার চেষ্টা সাধনার প্রতিফল পায়। (সূরা ত্বা-হা-১৫) কিয়ামতের নির্ধারিত সময়ের ইলম একমাত্র আল্লাহর নিকটই আছে। (সূরা লুকমান-৩৭)]
লোকেরা আপনাকে কিয়ামতের সময় সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে, আপনি বলুন-এর নির্ধারিত সময় একমাত্র আল্লাহই জানেন। (সূরা আল আহযাব-৬৩) তাঁরই নিকট আছে কিয়ামত সম্পর্কিত অবগতি; আর তাঁরই কাছে তোমাদের প্রত্যাবর্তিত হতে হবে। (সূরা আয যুখরুফ-৮৫) হযরত আবু হোরায়রা (রা:) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (স:) বলেছেন-কিয়ামত জুমআর দিনেই অনুষ্ঠিত হবে। (তিরমিযি-১/২২২) (বিস্তারিত জানার জন্য শাহ রফিউদ্দিন মুহাদ্দিসে দেহলভীকৃত আলামতে কিয়ামত অধ্যয়ন করা যেতে পারে।)
কিয়ামতের মাধ্যমে বিশ্বজগত ধ্বংস হয়ে যাওয়ার চল্লিশ দিন পর হযরত ইসরাফিল (আ:) পুনরায় শিংগায় ফুৎকার দিবেন। যার ফলে সকল মৃত প্রাণী জীবিত হয়ে কবর থেকে উঠে হাশরের ময়দানে সমবেত হতে থাকবে। প্রথম শিংগায় ফুৎকারকে নাফখে ইমাতাত/নাফখে উলা ও দ্বিতীয় শিংগায় ফুৎকারকে নাফখে ইহইয়া/নাফখে ছানিয়া বলে। অত:পর আবার শিংগায় ফুৎকার দেয়া হবে অনন্তর সবাই দাঁড়িয়ে একে অন্যের প্রতি দৃষ্টি করতে থাকবে। (সূরা আয যুমার-৬৮)
শিঙ্গায় ফুৎকার দেয়া হবে। অনন্তর তারা পুরাতন কবর হতে উঠে রবের পানে দৌঁড়াতে থাকবে। (সুরা ইয়াসীন-৫১) হযরত আবু হুরায়রা (রা:) রাসূল (স:) হতে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন : শিঙ্গায় ফুৎকার দেয়া হবে আসমান-যমিনের সকলে জাগ্রত হবে। দু ফুৎকারের মাঝে চল্লিশ বছরের ব্যবধান হবে। (সুনানে আবু দাউদ-২/৮০) “ভাল করে শোন! যেদিন নিকটবর্তী স্থান হতে এক ঘোষণাকারী ঘোষণা দিতে থাকবে। সকলে সে বজ্রকঠিন নিনাদ বাস্তবে শুনতে পাবে” মুফাসসিরগণ বলেন, উক্ত আয়াতে কারিমাতে বর্ণিত ঘোষণাকারী হলেন হযরত ইসরাফীল (আ:)। তিনি শিঙ্গায় ফুৎকার দিয়ে ঘোষণা দিবেন, হে পুরাতন হাড়সমূহ, ছিন্ন-ভিন্ন জোড়াসমূহ, টুকরা হয়ে যাওয়া মাংস খ-সমূহ, বিক্ষিপ্ত কেশরাজী। তোমাদের প্রতি নির্দেশ, মহান প্রভুর সিদ্ধান্ত মত তোমরা সমবেত হয়ে যাও। একদল তাফসির বিশারদ বলেন, শিঙ্গা দু ফুৎকারের মাঝের সময় হবে চল্লিশ বছর (পৃথিবীর হিসাবে চল্লিশ হাজার বছর)। (শরহে আকাইদে সিফারিনিয়্যাহ-২/১৬৪)
কিয়ামতের উদ্দেশ্য হল, যে ব্যক্তিবর্গ পৃথিবীতে আল্লাহ তা‘য়ালার নির্দেশাবলীর অনুযায়ী জীবন-যাপন করে, নবীগণের শিক্ষা অনুসরণ করে তাদেরকে পুরস্কৃত করা আর যারা আল্লাহর অবাধ্যাচরণ ও নবীগণের শিক্ষা হতে মুখ ফিরিয়ে রাখে তাদেরকে শাস্তি প্রদান করা। অত্যাচারির উপর প্রতিশোধ গ্রহণ ও অত্যাচারিতকে প্রতিদান প্রদান, পৃথিবীতে যাদের উপর অত্যাচার করা হয়েছে, কিন্তু ন্যায় বিচার পায়নি, তাদের ন্যায় বিচারের ব্যবস্থা করা, সকল সঠিক দাবীদারের দাবী বা অধিকার পরিপূর্ণভাবে প্রদান করা। আল্লাহ তা‘য়ালা বলেন- (ক) যারা দুষ্কর্ম করার দু:সাহস দেখিয়েছে তারা কি মনে করে যে, আমি তাদেরকে ঈমানদার ও সৎকর্মশীলদের মত স্থান দিব? তাদের সিদ্ধান্ত কতই না ঘৃণীত। (সূরা আল জা-ছিয়াহ-৩০) (খ) কুরআন হাদীসের একাধিক স্থানে পুণ্যাত্মাদের সওয়াব ও দৃষ্কৃতকারীদের শাস্তির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। যদি এ শাস্তি-শাস্তিরূপ লাভ না করে তবে আল্লাহর ওয়াদা লংঘিত ও তার বাণীর অসত্যতা প্রমাণিত হবে। (শরহুল মাকাসিদ-৩/২৭৫) (গ) ভঙ্গুর জীবনে আল্লাহপাক পরীক্ষার নিমিত্তে কখনো কখনো অবাধ্য বান্দাকে নি’মাত দান করেন ও অনুগত বান্দাকে বিপদে নিক্ষেপ করেন। সুতরাং তাদের খাতিরে একটি প্রতিফল জগতের বিকল্প নেই। (ঘ) সৎকর্মের বিনিময় এক প্রকার নি’মাত তার সাথে অন্য নি’মাত মিশ্রিত হতে পারে না। দুষ্কৃর্মের প্রতিফল শাস্তি, তার সাথে নি’মাত যুক্ত হতে পারে না। অথচ দুনিয়ার শাস্তি নি’মাতের সাথে, দুনিয়ার নি’মাত শাস্তির সাথে মিশ্রিত হতে পারে। কাজেই এমন একটি জগতের বিকল্প নেই। যেখানে পরিপূর্ণভাবে প্রতিফল লাভকরা যায়। (ঙ) কোন কোন সময় সৎকর্ম পরায়ণ ও দুষ্কর্ম পরায়ণ তাদের কাজের ভাল বা মন্দ ফল লাভের পূর্বেই ইহজগত ত্যাগ করে। অত:পর হাশর নাশরের মাধ্যমে বান্দা যদি নিজের কর্মফল ভোগের সুযোগ না পায়, তবে এ পৃথিবী অর্থহীন ও উদ্দেশ্যহীন প্রমাণিত/সাব্যস্ত হবে। অথচ পৃথিবীর জীবন অনর্থক নয়। যেমন-আল্লাহ তা‘য়ালা ইরশাদ করেনÑআমি আসমান যমিনকেও এতদুভয়ের মধ্যের সৃষ্টিকে অর্থহীন খেল তামাশার বস্তু রূপে সৃষ্টি করিনি। (শরহে ফিকহে আকবার-১০৩)
শিঙ্গার প্রথম ফুৎকার হতে জান্নাত বা জাহান্নামে প্রবেশের পূর্ব পর্যন্ত কাল বা সময়কে কিয়ামত বলে। (ক) (ইয়াওমুল কিয়ামাহ) অর্থ পুনরুত্থান দিবস। “তাহযীব” গ্রন্থে লিখেছেÑকিয়ামত অর্থ হল পুনরুত্থান দিবস যে দিন সকল সৃষ্টি চিরজীব মহা নিয়ন্ত্রক আল্লাহর সামনে উপস্থিত হবে। (লিসানুল আরব-১২/৫৯৭) কিয়ামতের পূর্বে কিয়ামতের নিদর্শনসমূহ প্রকাশ পাবে। অত:পর কিয়ামত হবে। কিয়ামতের নিদর্শন অবশ্যই প্রকাশ পাবে। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ বলেনÑ (ক) তারা তো শুধু এরই অপেক্ষা করছে যে, অকস্মাৎ কিয়ামত তাদের মাঝে এসে পড়বে। জেনে রাখা উচিৎ যে, তার অনেক নিদর্শন ইতোমধ্যেই এসে পড়েছে। (সূরা মুহাম্মদ-১৮) (খ) হাদীসে জিবরাইলে দীর্ঘ বর্ণনায় নবী (স:) ইরশাদ করেন-আমি তোমাকে কিয়ামতের কতিপয় আলামত বলছি, কৃতদাসী তার মনিবকে জন্ম দান করবে, উট ও চতুষ্পদ প্রাণীর রাখালেরা সুরম্য বালাখানাসমূহে গৌরবময় জীবনযাপন করবে (ইত্যাদি) পাঁচটি বিষয়ের কথা তিনি বলেন যে, এর সঠিক জ্ঞান আল্লাহ ব্যতীত আর কেউ জানে না। তার পর নবী করিম (স:) এ আয়াতটি তেলাওয়াত করেনÑ অর্থাৎ কিয়ামত অনুষ্ঠিত হওয়ার সময় সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান একমাত্র আল্লাহ রাখেন। (সহীহ বুখারী শরীফ-১/১২) (গ) হযরত আবু হুরায়রা (রা:) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (স:) বলেন, কিয়ামত বাস্তব রূপ লাভ করবে না, যতক্ষণ দুটি বড় বাহিনী পরস্পর যুদ্ধে লিপ্ত না হবে। উভয় দলের দাবী হবে এক। (সহীহ মুসলিম-২/৩৯০) (ঘ) হযরত উসাইন বিন হুযাইর (রা:) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (স:) ইরশাদ করেন-দশটি নির্দশন প্রকাশ পাওয়ার পূর্বে কিয়ামত অনুষ্ঠিত হবে না। (১) প্রাচ্যে একটি ভূমিধ্বস হবে। (২) পাশ্চাত্যে একটি ভূমি ধ্বস হবে (৩) আরব উপদ্বীপে একটি ভূমি ধ্বস হবে। (৪) ধোয়ায় আচ্ছন্ন হবে। (৫) দাজ্জালের আগমন ঘটবে। (৬) দাব্বাতুল আরদ-এর আগমন হবে। (৭) ইয়াজুজ (৮) মাজুজের আত্মপ্রকাশ (৯) পশ্চিম দিগন্তে সূর্যের উদয় (১০) এডেন শহর হতে অগ্নির বহির্গমন যা লোকদেরকে তাড়া করে ফিরবে। (সহীহ মুসলিম-২/৩৯৩) (বিস্তারিত জানার জন্য সহীহ মুসলিম-২/৩৯১-৪০২ দ্রষ্টব্য।)
কিয়ামতের আলামত দু প্রকার :
(১) ছোট আলামত তথা প্রাথমিক নিদর্শন। (২) বৃহৎ আলামত তথা চূড়ান্ত নিদর্শন।
ছোট বা প্রাথমিক নিদর্শন : মহানবী মুহাম্মদ (স:) এর ধরা মাঝে পদার্পণ থেকে শুরু করে ইমাম মাহদী (আ:) এর প্রকাশের পূর্ব পর্যন্ত যে সকল নিদর্শন প্রকাশ পেতে থাকবে, সেগুলোকে আলামতে সুগরা বা প্রাথমিক নিদর্শন বলা হয়।
আলামতে কুবরা : কিয়ামতের যে সকল নিদর্শন ইমাম মাহদী (আ:) এর প্রকাশ পাবার পর থেকে প্রথম শিংগায় ফুৎকারের পূর্ব পর্যন্ত বাস্তব রূপ লাভ করতে থাকবে, সেগুলোকে আলামতে কুবরা বা চূড়ান্ত নিদর্শন বলা হয়। নি¤েœ উভয় প্রকার নিদর্শনাবলী উল্লেখ করা হলো। আশরাতুস সা’আহ বলতে ঐ সকল নিদর্শনকে বুঝায় যা কিয়ামত নিকটবর্তী হওয়ার ইঙ্গিত বা প্রমাণ বহন করে। তার মধ্যে কিছু আছে ছোট বা প্রাথমিক যা দীর্ঘকাল হতে অদ্যাবধি প্রকাশিত হয়ে আসছে। কতিপয় আছে বৃহৎ বা চূড়ান্ত নিদর্শন যেগুলো কিয়ামতের অতি নৈকট্যের সতর্কবাণী ঘোষণা করবে। যেমন ইমাম মাহদী, হযরত ঈসা ও দাজ্জালের আবির্ভাব ইত্যাদি। (মুরামুল কালাম-৬৬) (চলবে)
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।