উইকিপিডিয়ার পাশাপাশি অন্যান্য উইকিগুলো এখনো উইকিউইকিওয়েবের নিয়মগুলো অনুসরণ করে এবং নিজেদের প্রয়োজনের সঙ্গে সেগুলো সমন্বয় করে ব্যবহার করে। শুধু আদর্শিক দিক থেকেই নয়, উইকিউইকিওয়েবের কারিগরি অনেক দিক এখনো সরাসরি অন্যান্য উইকিতে ব্যবহার করা হয়। এই জ্ঞানগুলো সংকলন করেই ২০০১ সালে ‘দ্য উইকি ওয়ে’ নামে একটি বই লেখেন কানিংহাম। উইকির ইতিহাস ও সংস্কৃতি নিয়ে আগ্রহীদের জন্য এক মূল্যবান বই এটি।
‘কানিংহামস ল’ নামে একটা নীতি আছে। এই নীতি অনুসারে, ইন্টারনেটে কোনো প্রশ্নের জবাব পাওয়ার সবচেয়ে ভালো উপায় প্রশ্ন করা নয়, বরং অন্য কারো প্রশ্নের ভুল জবাব দেওয়া। তাঁর পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, মানুষ প্রশ্নের জবাব দিতে এমনিতে হয়তো দেরি করবে; তবে অন্য কারো ভুল ধরতে সে দেরী করবে না। এই ভুল ধরতে গিয়েই সে হয়তো দ্রুত আপনার মূল প্রশ্নের জবাবও দিয়ে দেবে। একটু খেয়াল করলে হয়তো আশপাশের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই নীতির কিছু উদাহরণও পেয়ে যাবেন।
উইকিউইকিওয়েব থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে পরে প্রচুর উইকি জন্ম নেয়। এরমধ্যে ‘ইউজমড উইকি’ বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করে। আর ‘মিটবলউইকি’ নামে আরেকটি উইকি তৈরি হয় শুধু অন্যান্য উইকিগুলো এবং সবচেয়ে বড় ‘উইকি কালচার’ নিয়ে আলোচনা ও ডকুমেন্টেশনের জন্য।
১৯৯০ সালের পর ইন্টারনেট যখন সাধারণ মানুষের জন্য উন্মুক্ত হতে থাকে, তখন ইন্টারনেট কেন্দ্র করে তৈরি হওয়া স্টার্ট আপগুলোর দাম যুক্তরাষ্ট্রের পুঁজিবাজারে হু হু করে বাড়তে থাকে। ইন্টারনেটভিত্তিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান তৈরি করতে শুরু করেন নতুন ব্যবসায়ীরা। এই পুরো ঘটনাকে ‘ডটকম বাবল’ বা ‘ডটকম বুম’ বলা হয়। এই ডটকম বুমে তৈরি হওয়া নতুন কোম্পানিগুলোর একটা হলো ‘বমিস’। জিমি ওয়েলস, টিম শেল এবং মাইকেল ডেভিস এই কোম্পানি তৈরি করেন। বমিস নামের একটা মজার পূর্ণরূপ আছে, ‘বিটার ওল্ড মেন ইন স্যুটস’। এই নামের তাৎপর্য অবশ্য জিমি ওয়েলসই ভালো বলতে পারবেন।
যাহোক, ওয়েবসাইট তো হলো। এখন এই কোম্পানির কাজ কী? কাজ নিয়ে তিন উদ্যোক্তা পড়লেন বিপাকে। প্রথমে একটা অনলাইন ডিরেক্টরি তৈরি করলেন, যেখানে ব্যবহৃত গাড়ির তথ্য পাওয়া যাবে এবং পুরোনো গাড়ি সেখান থেকেই কেনা যাবে। এতে তেমন সাড়া পাওয়া গেল না। এরপর অনলাইনে শুরু করতে চাইলেন খাবার অর্ডারের ব্যবসা। খাবারের বিজ্ঞাপনের খরচ তুলতেই হিমশিম অবস্থা। তাই সেটা বাদ দিয়ে শুরু করলেন ‘ইন্টারনেট ডিরেক্টরি’। এতে ভালোই লাভ হলো। এরপর ধীরে ধীরে তাঁরা বিশেষায়িত এলাকায় কাজ করা শুরু করলেন। এক পর্যায়ে শুরু করলেন প্রাপ্তবয়স্ক কনটেন্টের পরিষেবা। ‘বমিস প্রিমিয়াম’ সাবস্ক্রিপশন করলে প্রাপ্তবয়স্কদের ছবির সংগ্রহ উপভোগ করা যেত।
পরে বমিস নিয়ে আরও নতুন কাজ করার দিকে ঝুঁকলেন জিমি। অনেক আগে থেকেই ওপেন সোর্স, হ্যাকার কালচার, হাইপারকার্ড, উইকিউইকিওয়েব—সবগুলোই তিনি ব্যবহার করেছেন। তা ছাড়া উন্মুক্ত জ্ঞানের প্রতি তাঁর আলাদা দুর্বলতা ছিল। একটা অনলাইন বিশ্বকোষ বানানোর স্বপ্ন ছিল জিমির। বমিস কোম্পানির অধীনে তিনি শুরু করলেন ‘নুপিডিয়া’ নামে একটি অনলাইন এনসাইক্লোপিডিয়া বা বিশ্বকোষ। সেখানে সব কনটেন্ট ওপেন সোর্স লাইসেন্সের আওতায় থাকবে এবং সাইটে বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে আয় করা হবে। নুপিডিয়ার জন্য জিমি ল্যারি স্যাঙ্গার নামে এক ব্যক্তিকে ‘এডিটর ইন চিফ’ হিসেবে নিয়োগ দেন।
ল্যারি ছিলেন দর্শনে পিএইচডি। নুপিডিয়ায় লিখতে হলে লেখককে নির্দিষ্ট বিষয়ে পিএইচডি থাকতে হতো। পাশাপাশি সাত ধাপের কঠোর প্রক্রিয়ায় অন্তত দুই সপ্তাহ সময় নিয়ে প্রকাশিত হতো প্রতিটি নিবন্ধ। একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে নিবন্ধ লেখা শুরু করতে হলে সে বিষয়ে ন্যূনতম তিনজন লেখক থাকতে হতো। লেখকেরা সবাই ছিলেন স্বেচ্ছাসেবী। এই কঠোর প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে যাওয়ার কারণে প্রথম বছরে নুপিডিয়ায় মাত্র ২১টি নিবন্ধ যুক্ত হয়। সবাই বুঝতে পারছিলেন, নুপিডিয়া একটি ব্যর্থ প্রকল্প হতে যাচ্ছে।
নুপিডিয়াকে এই অবস্থা থেকে উদ্ধার করার জন্য জিমি এবং ল্যারি মিলে একটি ‘উইকি’ ওয়েবসাইট খোলার সিদ্ধান্ত নেন। সেখানে সবাই নিবন্ধ লিখতে পারবে। এই উইকি ওয়েবসাইটের নিবন্ধই পরে নুপিডিয়ায় যাচাই-বাছাই ও সংশোধন করে প্রকাশ করা হতো। সেখান থেকে জন্ম নেয় ‘উইকিপিডিয়া’।
‘উইকি’ আর ‘পিডিয়া’ শব্দের মিলিত রূপ উইকিপিডিয়া। (বলা বাহুল্য, এনসাইক্লোপিডিয়া থেকে এই ‘পিডিয়া’ শব্দটি এসেছে।) একে ইংরেজিতে বলে পোর্টম্যান্টো। এরপর থেকে বিশ্বের অনলাইন অ্যাক্টিভিস্টরা উইকিপিডিয়ায় যুক্ত হতে থাকেন। প্রথম মাসেই ইংরেজি উইকিপিডিয়ায় যুক্ত হয় ২০০-এর বেশি নিবন্ধ। আর প্রথম বছরে সেটি ১৮ হাজার ছাড়িয়ে যায়। উইকিপিডিয়া এত বেশি সাফল্য পায় যে এক পর্যায়ে নুপিডিয়া বন্ধ করে দেওয়া হয়। বন্ধ হয়ে যায় বমিসও। উইকিপিডিয়া এখন পর্যন্ত ইন্টারনেটের সবচেয়ে দামি ওয়েবসাইটগুলোর একটি হিসেবে রয়ে গেছে। সমৃদ্ধ হচ্ছে প্রতি মিনিটে।
ইকিপিডিয়ার সাহায্যে শুরু হলো একটি বিপ্লব। লিখিত জ্ঞানের পাশাপাশি ছবি, অডিও বা ভিডিও থেকেও জ্ঞান অর্জন করা যায়। সেই ধারণা থেকে জন্ম নেয় উইকিমিডিয়া কমন্স, উইকিডেটা, উইকিসোর্স, উইকিভয়েজ, উইকিস্পেশিজের মতো উইকিপিডিয়ার অনেকগুলো সহ-প্রকল্প। এই জগৎ বড় হতে হতে একটি বিশাল আন্দোলনের রূপ নেয়, পৃথিবীর প্রতিটি মানুষের কাছে উন্মুক্ত জ্ঞান ছড়িয়ে দেওয়ার আন্দোলন। নাম উইকিমিডিয়া আন্দোলন। উইকিমিডিয়া বলতে বিশাল এই আন্দোলনকেই বোঝায়। উইকিমিডিয়া আন্দোলনের একটি প্রকল্প উইকিপিডিয়া।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।