উইকিপিডিয়ার তথ্য কি সরাসরি বিশ্বাস করা উচিত? জবাব: না! আমাদের কি উইকিপিডিয়া ব্যবহার করা উচিত? উত্তর: হ্যাঁ! কেন সরাসরি বিশ্বাস না করলেও ব্যবহার করা উচিত? উত্তরটা লুকিয়ে আছে কীভাবে ব্যবহার করা উচিত, তার ভেতরে।প্রথমে একটা মজার কথা বলি। উইকিপিডিয়া নিজেই বলে, ‘উইকিপিডিয়া: উইকিপিডিয়া ইজ নট আ রিলায়েবল সোর্স’।
অর্থাৎ উইকিপিডিয়া নির্ভরযোগ্য উৎস নয়। তাই একটি উইকিপিডিয়া নিবন্ধে আরেকটি উইকিপিডিয়া নিবন্ধকে তথ্যসূত্র হিসেবে ব্যবহার করা যায় না। বরং একই তথ্য দুটি উইকিপিডিয়া নিবন্ধে ব্যবহার করা হলে প্রথম উইকিপিডিয়া নিবন্ধটিকে সূত্র হিসেবে ব্যবহার না করে, সেই নিবন্ধের সূত্রগুলো ব্যবহার করা হয়। তাহলে প্রশ্ন আসে, কীভাবে উইকিপিডিয়া ব্যবহার করব? তা নিয়েই এ লেখায় আলোচনা করব।
মূল প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে আরেকটা কথা বলে নিই। ‘রিডিং উইকিপিডিয়া ইন দ্য ক্লাসরুম’ নামে একটি টিচার্স ট্রেনিং প্রোগ্রাম আছে। সারা পৃথিবীতে এই প্রশিক্ষণের জন্য ৭৩ জন সার্টিফায়েড ট্রেইনার রয়েছেন। উইকিপিডিয়া ব্যবহার করে কীভাবে শিক্ষার্থীদের ‘মিডিয়া অ্যান্ড ইনফরমেশন লিটারেসি’ বাড়ানো যায়, সে বিষয়ে হাইস্কুল শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেন তাঁরা। গত এক বছরে নাইজেরিয়া, ইউক্রেন, কলম্বিয়া, মরক্কো, ইয়েমেন, বলিভিয়া, জর্দানসহ অনেকগুলো দেশে হাইস্কুল শিক্ষকদের এই প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে।
প্রশিক্ষণ শেষে সার্টিফিকেটসহ প্রয়োজনীয় স্বীকৃতিও দেওয়া হয়েছে। এসব কার্যক্রমে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ইউনেস্কো, সংশ্লিষ্ট শিক্ষা মন্ত্রণালয়, শিক্ষক প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটসহ শিক্ষাখাতের অন্যান্য স্টেকহোল্ডাররা পার্টনার হিসেবে অন্তর্ভুক্ত থাকেন। এই প্রশিক্ষণ কারিকুলাম ইউনেস্কোর ‘মিডিয়া অ্যান্ড ইনফরমেশন লিটারেসি ফ্রেমওয়ার্কের’ ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছে।
ইউনেস্কোর মিডিয়া অ্যান্ড ইনফরমেশন লিটারেসি (এমআইএল) ফ্রেমওয়ার্কের তিনটি মূল কম্পোনেন্ট বা উপাদান রয়েছে। প্রথমটি হলো একজন মানুষের কী তথ্য দরকার এবং কোথা থেকে সেই তথ্য খুঁজে পেতে হবে, তা জানা। দ্বিতীয় দক্ষতা হলো, তথ্য খুঁজে পাওয়ার পর ঠিকভাবে বুঝতে পারা এবং তার সত্যতা যাচাই করা। আর তৃতীয়টি হলো নিজে জ্ঞান তৈরি করতে পারা এবং সেটি যথাযথ উপায়ে ব্যবহার ও সবার সঙ্গে শেয়ার করার দক্ষতা।
‘রিডিং উইকিপিডিয়া ইন দ্য ক্লাসরুম’ প্রোগ্রাম মূলত এই তিনটি মূল উপাদানের ওপর ভিত্তি করে উইকিপিডিয়ার কর্মপ্রণালী ব্যবহার করে একজন শিক্ষকের মিডিয়া অ্যান্ড ইনফরমেশন লিটারেসি বাড়াতে কাজ করে। এ লেখায় উইকিপিডিয়া বিশ্বাসযোগ্য কি না বা কতটা বিশ্বাস করা উচিত, তা আলোচনা করতে গিয়ে রিডিং উইকিপিডিয়া ইন দ্য ক্লাসরুম প্রোগ্রামে এমআইএলের দ্বিতীয় দক্ষতা, অর্থাৎ তথ্য যাচাই করার দক্ষতা নিয়ে যে কারিকুলাম রয়েছে, তা অনুসরণ করা হয়েছে।
গোটা এমআইএল, বিশেষত দ্বিতীয় উপাদানটি—অর্থাৎ তথ্য যাচাই করার দক্ষতা বাংলাদেশের মতো দেশে গুজব প্রতিরোধে বেশ কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে। সময়ের সঙ্গে গুজব বা ভুয়া তথ্য শনাক্ত করা অনেক কঠিন হয়ে যাচ্ছে। সত্য থেকে অর্ধ সত্য বা মিথ্যা আলাদা করা আরও বেশি কঠিন। এখানেই এমআইএল ফ্রেমওয়ার্কের মতো পরীক্ষিত পদ্ধতি আমাদের পথ দেখাতে পারে।
এবার মূল প্রসঙ্গে ফিরি। আগের একটি লেখায় বলেছিলাম, পৃথিবীতে ৩২০টির বেশি ভাষায় উইকিপিডিয়ার সংস্করণ রয়েছে। এর মধ্যে ইংরেজি উইকিপিডিয়া সবচেয়ে বেশি সমৃদ্ধ। সেখান থেকেই প্রায় সব উইকিপিডিয়ার ভাষা সংস্করণের নীতিমালা ও পদ্ধতি আত্তীকরণ করা হয়। তাই ইংরেজি উইকিপিডিয়ার কাঠামো এবং তথ্য যাচাই করার পদ্ধতি জানলে পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি উইকিপিডিয়ার ভাষা সংস্করণে একই কাজ প্রায় একইভাবে করা সম্ভব। এই লেখায়ও ইংরেজি উইকিপিডিয়ার ওপর ভিত্তি করে তথ্য যাচাইয়ের উপায় দেখানো হয়েছে।
উইকিপিডিয়ার তিনটি মূল কন্টেন্ট পলিসি হলো—এক, নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি (ইংরেজিতে এনপিওভি বা নিউট্রাল পয়েন্ট অব ভিউ), দুই, ভেরিফায়েবিলিটি বা যাচাইযোগ্যতা এবং তিন, মৌলিক গবেষণা না হওয়া (ইংরেজিতে এনওআর বা নো অরিজিনাল রিসার্চ)। এর বাইরে উইকিপিডিয়ার ফাইভ পিলার্স বা পঞ্চস্তম্ভ, বিহেভিওরাল গাইডলাইনস বা আচরণগত নির্দেশিকার মতো গুরুত্বপূর্ণ কিছু ডকুমেন্ট রয়েছে। তবে আমরা এ লেখায় শুধু কন্টেন্ট নিয়ে আলোচনা করছি বলে মূল কন্টেন্ট পলিসির বাইরে অন্য বিষয়ে যাব না।
নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি বা এনপিওভি বলে, উইকিপিডিয়া নিবন্ধের ভাষা হবে যথাসম্ভব নিরপেক্ষ। ভাষার ব্যবহার বা তথ্যের উপস্থাপন কোনো একটি নির্দিষ্ট মতের দিকে ঝুঁকে পড়তে পারবে না। যদি একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে একাধিক মতবাদ থাকে, তাহলে সবগুলোই যথাযথ নীতিমালা মেনে নিরপেক্ষ ভাষা ব্যবহার করে তুলে ধরতে হবে। কোনো নিবন্ধের ভাষা যদি একপেশে হয়ে যায়, তা নিম্নমানের বলে বিবেচিত হবে।
ভেরিফায়েবিলিটি বা যাচাইযোগ্যতা বলে, উইকিপিডিয়ায় থাকা প্রতিটি তথ্য নির্ভরযোগ্য উৎস থেকে যাচাই করতে পারা উচিত। এ কারণেই যেকোনো ভাষার উইকিপিডিয়ায় প্রতিটি তথ্যের পর সংখ্যা দিয়ে তথ্যসূত্র বা রেফারেন্স দেওয়া থাকে, যেন পাঠক সেই সূত্র ব্যবহার করে তথ্য যাচাই করে নিতে পারেন। যেকোনো উৎসকে আবার নির্ভরযোগ্য হিসেবে উইকিপিডিয়ায় গ্রহণ করা হয় না। তৃতীয় পক্ষের স্বাধীন উৎস উইকিপিডিয়ায় ব্যবহৃত হয়। বই, সংবাদপত্র, বিজ্ঞান জার্নাল হলো বহুল ব্যবহৃত কিছু তথ্যসূত্রের উদাহরণ।
কোনো উৎস নিয়ে সন্দেহ দেখা গেলে সেই প্রকল্পে যাঁরা কাজ করেন, তাঁরা সবাই মিলে আলোচনা করে উৎসের নির্ভরযোগ্যতা যাচাই করে সিদ্ধান্তে আসেন। ইংরেজি উইকিপিডিয়ায় ‘পেরেনিয়াল সোর্স’ নামে আলাদা একটি পাতা রয়েছে, যেখানে এর আগে যেসব উৎস নিয়ে আলোচনা হয়েছে, সেগুলোর তালিকা আর কতটা নির্ভরযোগ্য, তা নথিবদ্ধ করা আছে। উদাহরণস্বরূপ, অ্যাসোশিয়েটেড প্রেসকে (এপি) নির্ভরযোগ্য, আর ক্যালিফোর্নিয়া গ্লোবকে যথাযথ সম্পাদকীয় প্রক্রিয়ার অভাবে অনির্ভরযোগ্য বলে তালিকাভুক্ত করা আছে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।