জুমবাংলা ডেস্ক: কুড়িগ্রামের মানুষের দীর্ঘ দিনের স্বপ্ন ও প্রত্যাশা ছিল কুড়িগ্রামে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হবে। যেটি কুড়িগ্রামের মানুষকে দারিদ্রতার কষাঘাত থেকে মুক্তি দিয়ে ভাগ্যোন্নয়নে কাজ করবে। কুড়িগ্রামের মানষের সেই স্বপ্ন এবং প্রত্যাশা পুরণে ২০১৫ সালের ১৫ অক্টোবর কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজ মাঠে এক জনসভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর নিজস্ব চিন্তা থেকে কুড়িগ্রাম জেলায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দেন। গত বছরের ১৫ সেপ্টেম্বর ‘কুড়িগ্রাম কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় বিল, ২০২১’ সংসদে পাশ হয়। এরপর বিশ্ববিদ্যালয়টির আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরুর লক্ষ্যে গত ২৬ এপ্রিল রাষ্ট্রপতি ও বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের চ্যান্সেলর চার বছরের জন্য বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফসল ও উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক এবং আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন কৃষি বিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. এ. কে. এম. জাকির হোসেনকে বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রথম উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ প্রদান করেন। গত ৮ মে উপাচার্য হিসেবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে যোগ দিয়ে তিনি দাপ্তরিক কাজ শুরু করেন। নতুন বিশ্ববিদ্যালয়কে ঘিরে নবনিযুক্ত উপাচার্যের পরিকল্পনা জানতে তাঁর সাথে কথা বলেছেন জুমবাংলার নিজস্ব প্রতিনিধি কৃষিবিদ মোঃ আব্দুল মান্নান।
কুড়িগ্রাম কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পাওয়ায় আপনার অনুভূতি কেমন?
উপাচার্য: প্রথমে শুকরিয়া জ্ঞাপন করছি মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের প্রতি যিনি আমাকে সম্মানিত করেছেন। আমার ওপর আস্থা রেখে নব গঠিত কুড়িগ্রাম কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ প্রদানের জন্য ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি মহামান্য রাষ্ট্রপতি এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রতি। আমার মেধা ও প্রজ্ঞার সর্বোচ্চ ব্যবহার করে আমার ওপর অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে সর্বদা সচেষ্ট থাকবো। আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির সঙ্গে সংগতি রেখে কুড়িগ্রাম কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়কে বিশ্বমানের একটি বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে গড়ে তুলতে আমি অঙ্গীকারাবদ্ধ।
কুড়িগ্রাম জেলার মানুষের ভাগ্যোন্নয়নে বিশ্ববিদ্যালয়টি কতটা ভূমিকা রাখতে পারবে বলে আপনি মনে করে?
উপাচার্য: বাংলাদেশ কৃষি প্রধান দেশ এবং দেশের অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি হচ্ছে কৃষি। তাই উত্তরাঞ্চলের মানুষের আর্থসামাজিক উন্নয়ন ঘটাতে হলে কৃষির উন্নয়ন ঘটাতে হবে। সেক্ষেত্রে কুড়িগ্রাম কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় যুগোপযোগী কৃষি শিক্ষা, কৃষি গবেষণা, সম্প্রসারণ ও কৃষির যান্ত্রিকীকরণের মাধ্যমে এ অঞ্চলের মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থা বেগবান করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে বলে আমার বিশ্বাস।
নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে কোন কাজটি চ্যালেঞ্জিং হিসেবে মনে হচ্ছে এবং সেটি সমাধানে কি উদ্যোগ বা পরিকল্পনা নিয়েছেন?
উপাচার্য: যেহেতু কুড়িগ্রাম কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় একেবারে নতুন একটি বিশ্ববিদ্যালয় সেহেতু অনেক চ্যালেঞ্জ থাকবে এটিই স্বাভাবিক। তাই বলে থেমে থাকলে চলবে না, কাউকে না কাউকে দায়িত্ব নিতেই হবে। আমি মনে করি নতুন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় যেমন অনেক চ্যালেঞ্জ আছে তেমনি অনেক সম্ভাবনাও আছে। আমি সেই সম্ভাবনা গুলোকে কাজে লাগাতে চাই। প্রথম উপাচার্য হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়টির ইতিহাসের পাতায় নিজের স্বাক্ষর রেখে যেতে চাই। আমি চাই কুড়িগ্রামের মানুষের আশা আকাঙ্খার প্রতিফলন হিসেবে কুড়িগ্রাম কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়কে শিক্ষা, গবেষণা এবং আধুনিকতায় বিশ্বের অনন্য বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে গড়ে তুলতে। আর এটি বাস্তবায়ন সম্ভব হবে সকলের সম্মিলিত সহযোগিতার মাধ্যমে। আমার বিশ্বাস কুড়িগ্রামবাসী এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করবে।
যতদূর জানি কুড়িগ্রাম কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য এখনো জায়গা নির্ধারিত হয়নি, না হওয়ার কারণ কী বা আপনি কি উদ্যোগ নিয়েছেন?
উপাচার্য: আমি গত ৮ মে কুড়িগ্রাম কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে যোগদান করেছি। যোগদানের পর কয়েকবার কুড়িগ্রাম গিয়েছি এবং সেখানে জেলা প্রশাসকসহ স্থানীয় নেতৃবৃন্দের সাথে কথা বলেছি। আশা করছি খুব শিগগিরই আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য জায়গা নির্ধারণ করতে পারবো। ইতোমধ্যে ঢাকায় একটি অতিথিভবন কাম অফিস ভাড়া নেওয়া হয়েছে, কুড়িগ্রামেও নেওয়া হবে। বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জরী কমিশন এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ করা হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের জায়গা নির্ধারণের বিষয়ে ইতোমধ্যেই শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুসারে ইউজিসির একটি প্রতিনিধি দল কুড়িগ্রাম সফর করবে। সফরকালে জেলা প্রশাসকের সাথে বিস্তারিত আলোচনা করে মন্ত্রণালয়ের নিকট প্রতিবেদন দাখিল করবে। পরবর্তীতে সেভাবেই কাজ শুরু করা হবে।
একাডেমিক কার্যক্রম কবে শুরু করবেন এ নিয়ে কোন পরিকল্পনা করেছেন, হলে শুরুতে কতটা ডিপার্টমেন্ট নিয়ে এর যাত্রা শুরু হবে?
উপাচার্য: বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণ হচ্ছে শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থী না থাকলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সৌন্দর্য নেই। সবকিছু ঠিক থাকলে আমার ইচ্ছা আছে আগামী বছর থেকেই শিক্ষার্থী ভর্তির কার্যক্রম হাতে নিবো। সমন্বিত কৃষি গুচ্ছের সাথে যুক্ত হয়ে আগামী বছরের মধ্যে এখানে শিক্ষার্থী ভর্তি করাতে চাই। আপনারা জানেন যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাক্ট অনুযায়ী গ্রোসলি চারটি ডিসিপ্লিনকে অ্যাড্রেস করা হবে। এখানে থাকবে কৃষি, লাইভ স্টক ও ভেটেনারি সায়েন্স, ফিসারিজ ও সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি। সেগুলির সঙ্গে অনেক ফ্যাকাল্টি হবে। প্রথমেই এগ্রিকালচার, ফিসারিজ ও লাইভস্টোক এই তিনটি সেক্টরকে অ্যাড্রেস করে শুরু করবো। খুব অল্প পরিমাণ ছাত্র ভর্তি করা হবে। কারণ অবকাঠামো সংকট আছে। এগুলি কিন্তু জেনারেল ইউনিভার্সিটির মতো না, এটা বিশেষায়িত ইউনিভার্সিটি। প্রতিটি বর্ষে ১৭-১৮টি সাবেজেক্ট পড়াতে হবে। এজন্য প্রয়োজনীয় শিক্ষক-কর্মচারি নিয়োগ করতে হবে। যেমন ধরেন, বাংলা পড়াতে গেলে শুধু বাংলা পড়ালেই চলবে। কিন্তু এখানে এগ্রিকালচার পড়াতে গেলে এগ্রিকালচার রিলেটেড যত সাবজেক্ট আছে-সব পড়াতে হবে ইন্ট্রিগ্রেটেড এ্যাপ্রোচে। কাজেই পরিধি যেহেতু বড়, একটু সময় নিয়ে করতে হবে।
প্রতিষ্ঠাতা উপাচার্য হিসাবে আপনি প্রথম কোন কাজকে বিশেষভাবে জোর দিতে চান?
উপাচার্য: বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান কাজ শিক্ষা ও গবেষণা করা। আর এটি যেন দ্রুতগতিতে শুরু করা যায় সেটিই বিশেষভাবে জোর দিতে চাই। এছাড়াও সম্প্রসারণ ও প্রশিক্ষণের বিষয়টিও গুরুত্বসহকারে দেখা হবে। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসটি যাতে একেবারেই পরিকল্পনামাফিক করা যায় সে লক্ষ্যে কাজ করছি। এ অঞ্চলের একটি নয়নাভিরাম ক্যাম্পাস হবে বলে মনে করি। এছাড়াও শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন ধরণের স্কলারশিপের ব্যবস্থা করার উদ্যোগ গ্রহণ করবো। যথেষ্ট পরিমাণ বিদেশী শিক্ষার্থী যাতে এখানে আসতে পারে এবং কিছু কিছু বিষয়ে বিদেশী শিক্ষককে যুক্ত করা যেতে পারে। এছাড়াও গবেষণার জন্য পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করে অত্যাধুনিক গবেষণাগার, মাঠ গবেষণাগার, বোটানিক্যাল গার্ডেন, উপযোগী জার্মপ্লাজম সেন্টারসহ পুরো বিশ্ববিদ্যালয়কে একটি রিসার্চ হাব হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করবো।
কৃষি গবেষণার ক্ষেত্রে এই বিশ্ববিদ্যালয় কী ভূমিকা রাখবে বলে আপনি মনে করেন?
উপাচার্য: আমি প্রথমেই বলেছি, যেহেতু বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয় এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এই চিন্তা করেই এই বিশ্ববিদ্যালয় উপহার দিয়েছেন। তিনি মনে করেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শুধু লেখাপড়া করলে হবেনা—গবেষণা ও প্রযুক্তি উদ্ভাবন করতে হবে। কারণ কৃষককে এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কিছু পেতে হবে। শুধু সার্টিফিকেট-সর্বস্ব গ্রাজুয়েট তৈরি করলাম, এই সোসাইটিতে কৃষির উন্নয়নে তাঁর কোন অবদান থাকলো না, এখনকার যুগে সেটি চিন্তা করলে হবে না। সুতারাং আমরা মনে করি এখানকার গ্রাজুয়েটরা শিক্ষার সঙ্গে সমহারে গবেষণার সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকবে। তাদের গবেষণার মাধ্যমে উদ্ভাবিত প্রযুক্তি আমরা কৃষকদের কাছে নিয়ে যাবো। সেটা অবশ্যই সাসটেইনেবল ওয়েতে নিয়ে যাবো-যাতে কৃষক উপকৃত হয়। প্রথম থেকে ছাত্ররা কৃষকের সঙ্গে ও গবেষণার সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকবে। কাজেই শিক্ষার গুরুত্বের সঙ্গে গবেষেণার গুরুত্ব কম হবেনা।
আগামী চার বছর পরে বিশ্ববিদ্যালয়কে কোন অবস্থানে দেখতে চান?
উপাচার্য: বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে জ্ঞান এবং বিজ্ঞান চর্চার ক্ষেত্র। আমার মূল লক্ষ্য থাকবে কুড়িগ্রাম কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়কে একটি বিশ্বমানের বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে গড়ে তোলা। সারা বিশ্ব থেকে শিক্ষার্থীরা যেন এ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসে আমি সে লক্ষ্যে কাজ করে যেতে চাই। বিশ্বব্যাপী যাতে এ বিশ্ববিদ্যালয় পরিচিতি লাভ করে, কোর্স, কনটেন্ট ও কারিকুলাম সেভাবেই প্রস্তুত করা হবে। বিশেষ করে কুড়িগ্রাম অঞ্চলের ভূপ্রকৃতি, খরা, অতিবৃষ্টি, বন্যা ও কৃষির ওপর ভিত্তি করে নতুন ধরনের বিভাগ চালু করা হবে। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা যাতে সরাসরি গবেষণায় নিয়োজিত থাকেন, সে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আধুনিক কৃষির বিষয়গুলো আমরা নিশ্চিত করবো। পাশাপাশি এ অঞ্চলের কৃষির সমস্যাগুলো অগ্রাধিকার দিয়ে গবেষণার মূল বিষয়বস্তু হিসাবে সংযুক্ত করার চেষ্টা করবো এবং এই অঞ্চলের যুগোপযোগী বিষয়গুলোকে কোর্সের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করবো। চতুর্থ শিল্প বিল্পবের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রযুক্তিগুলোকে সমন্বয় করে আধুনিক কৃষির যে বিষয়গুলো পাঠ্যক্রমে থাকা উচিত সেটি অন্তর্ভূক্ত করা হবে।
মূল্যবান সময় দেওয়ার জন্য জুমবাংলার পক্ষ থেকে আপনাকে অনেক ধন্যবাদ স্যার
উপাচার্য: আপনাকেও ধন্যবাদ।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।