শাইখ সিরাজ : ১০০ গরুর মধ্যে নির্দিষ্ট কোনো গরুকে দেখে আলাদা করা যাবে কি? নিশ্চয়ই না। আমাদের কাছে সব গরু দেখতে আসলে একই রকম। চোখে দেখে শুধু রঙের ও আকারের পার্থক্য করতে পারব। কিন্তু আধুনিক যন্ত্র ঠিকই গরুর মুখে ক্যামেরা ধরে বলে দিতে পারে গরুর নম্বর কত, গরুর শারীরিক অবস্থা কেমন, কী পরিমাণ খাবার খেয়েছে। এসব নিয়ে বিস্তারিত কালের কণ্ঠের করা প্রতিবেদন থেকে তুলে ধরা হলো-
প্রযুক্তি, বিশেষ করে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা) এবং আইওটি (ইন্টারনেট অব থিংস) উৎপাদনব্যবস্থাকে নিয়ে যাচ্ছে এমন এক পর্যায়ে, যা কিছুদিন আগেও ছিল বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি, কিন্তু আজ তা বাস্তব। একা একজনের পক্ষে একটি বিশাল খামার পরিচালনা করা কঠিন কাজ নয়।
গত শতকের আশির দশকের প্রথম দিকে গ্রামেগঞ্জে কাজ করতে গিয়ে দেখেছি, কৃষক তাঁর বাড়িতে একটি-দুটি গরু পালতেন। ধানের খড় আর মাঠের ঘাস খাইয়ে দু-একটি গরু লালন-পালনে তেমন খরচ হতো না তাঁদের।
পরে উৎসাহিত করা হলো বিদেশি জাতের সঙ্গে সংকরায়িত উন্নত গাভি পালনের। কিন্তু উন্নত জাতের গাভির খাবারের খরচ বেশি। ১৫ থেকে ২০ লিটার দুধ নিয়ে বাজারে গিয়ে দুধের দাম পাননি কৃষক। অভিমানে দুধ ফেলে দিয়েছেন।
ফলে আমাদের দুগ্ধ খাত প্রত্যাশিতভাবে বিকশিত হয়নি। কিন্তু উন্নত বিশ্বের অনেক দেশ এই খাতে সুপরিকল্পিতভাবে সফল হয়েছে।
২০১৫ সালে নেদারল্যান্ডসের ডো মার্কে গরুর খামারে গিয়ে অবাক হয়েছিলাম। আধুনিক প্রযুক্তির বিস্ময়কর ব্যবহার দেখে মনে হচ্ছিল গরুর খামার নয়, যেন কোনো এক শিল্পপ্রতিষ্ঠানে চলে এসেছি। ইন্টারনেট অব থিংস বা আইওটি কৃষিতে যে বৈপ্লবিক রূপান্তর আনতে যাচ্ছে, এটি ছিল তারই স্মারক।
এই শতাব্দীতে আমরা প্রবেশ করেছি স্মার্ট যুগে। নেদারল্যান্ডসের গরুর খামারটিও ছিল একটি স্মার্ট গরুর খামার। গরুর খাদ্য দেওয়া থেকে শুরু করে দুধ সংগ্রহ পর্যন্ত সব কিছু নিয়ন্ত্রিত হয় যান্ত্রিক উপায়ে। ডো মার্কের দুধ দোয়ানোর আধুনিক পদ্ধতিও বেশ চমকপ্রদ। সেখানে গাভি উন্মুক্ত বিচরণ করতে করতে নিজেই যখন উপলব্ধি করে তার দুধ দেওয়ার সময় হয়েছে, তখন লাইন ধরে দুধ দোয়ানো কেন্দ্রে উপস্থিত হয়। শুধু গাভির উপলব্ধি দিয়ে যন্ত্র সন্তুষ্ট হয় না, যন্ত্র যখন তার হিসাব দিয়ে উপলব্ধি করবে যে দুধ দোয়ানোর জন্য গাভি প্রস্তুত, তখনই সে স্বয়ংক্রিয়ভাবে দুধ দোয়ানো শুরু করবে, অন্যথায় নয়।
২০১৮ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার চুংনাম প্রোভিন্সের থম্বক গ্রামের কিম নামের খামারির খামারে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। কিম দুই শতাধিক গরুর একটি খামার একাই পরিচালনা করছিলেন। অফিসকক্ষে বসে কম্পিউটারে সব নিয়ন্ত্রণ করছিলেন। গরুর খাবার দেওয়া থেকে শুরু করে দুধ দোয়ানো, দুধ প্রক্রিয়াকরণ—সবই হচ্ছিল অটোমেটিক যন্ত্রের সাহায্যে।
এ বছর এপ্রিলে নেদারল্যান্ডসের ফ্রেইডোপিল এলাকায় আরেকটি ডেইরি ফার্ম দেখার সুযোগ হয়েছিল। এক হাজার ১০০ হেক্টর জমির ওপর বিশাল এক খামার। খামারে দুই হাজার ৬০০টি গাভি। একেকটি গাভি বছরে দুধ দেয় ১১ হাজার লিটার। অথচ সম্পূর্ণ খামারটিতে মাত্র দুজন লোক। গাভির গোসল, খাবার দেওয়া, দুধ দোয়ানো—সবই করছে যন্ত্র। উৎপাদিত দুধ চিলিং হয়ে অটোমেটিক প্যাকেট জাত হয়ে যাচ্ছে।
আমাদের দেশেও স্মার্ট গরুর খামার গড়ে উঠতে শুরু করেছে। নারায়ণগঞ্জের কাঞ্চনে ব্যবসায়ী এম এ সবুর তাঁর গরুর খামারটি নিয়ে এসেছিলেন গ্রামীণফোনের স্মার্ট গরুর খামার ব্যবস্থাপনায়। স্মার্ট ফার্ম ব্যবস্থাপনায় প্রতিটি গরুর জন্য একটি করে চিপ থাকে। চিপটি সাধারণত গলার কলারে বা কানে ট্যাগে যুক্ত থাকে, যা গরুর শারীরিক ও পারিপার্শ্বিক সব ধরনের তথ্যই সংগ্রহ করতে সক্ষম।
যেমন—গরুর দেহের তাপমাত্রা, রক্তসঞ্চালন, জাবরকাটা থেকে শুরু করে প্রজনন সময়ের নির্ভুল হিসাব দেয়। মাতৃগরুর শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে সব ধরনের তথ্য দিয়ে অসময়ের গর্ভপাত রোধ করতে সাহায্য করে। গরুর কী ধরনের পুষ্টির প্রয়োজন, কী পরিমাণ আলো-বাতাস লাগবে—এমনকি গাভির দুধ দেওয়ার সময় সম্পর্কেও নানা তথ্য ইন্টারনেটের মাধ্যমে যুক্ত বেইস স্টেশন থেকে সরাসরি খামারির মোবাইল ফোনে চলে আসে।
জানি না কী কারণে গ্রামীণ ফোনের ডিজি কাউ আর অগ্রসর হতে পারেনি। তবে আদর্শ প্রাণিসেবা লিমিটেডের ফিদা হক তাঁর বোলাস কার্যক্রম এখনো চালিয়ে যাচ্ছেন। এই তো কদিন আগেই আশুলিয়ায় একটি খামারে দেখেছি আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার। ডাচ ডেইরি বা আমেরিকান ডেইরির কথা অনেকেই হয়তো জানেন। তারাও আধুনিক প্রযুক্তির বিশাল খামার গড়ে তুলেছে।
কৃষি খামারে চতুর্থ শিল্প বিপ্লব, অর্থাৎ ইন্টারনেট অব থিংস ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার আমূল পরিবর্তন এনেছে। এতে উৎপাদন যেমন বেড়েছে, কমেছে উৎপাদন ব্যয়, সেই সঙ্গে বেড়েছে খাদ্যের গুণগত মান। বাণিজ্যিক কৃষি মানেই প্রযুক্তির কৃষি। আর প্রযুক্তির কৃষি মানেই বড় বিনিয়োগের কৃষি। একজন ক্ষুদ্র কৃষকের পক্ষে এককভাবে বাণিজ্যিক কৃষিতে বিনিয়োগ সম্ভব নয়। তবে সম্মিলিতভাবে বিনিয়োগ কঠিন কিছু নয়।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।