শঙ্খচিলটির কোনো দোষ ছিল না। ও বসেছিল শিমুল গাছের মাথায়। আচমকা চৈতি-পাগলা হাওয়া এল, সে হাওয়ার দাপটে ওকে উড়তেই হলো। পাখা মেলতেই ও পড়ে গেল বেকায়দায়। বাতাস চাইল ওকে ইচ্ছেমতো ঠেলে ঠেলে নিয়ে যেতে। শঙ্খচিল পাক খেয়ে, ঘূর্ণি হাওয়ার পাক কাটিয়ে গিয়ে বসার ইচ্ছা ওর। কিন্তু চালতা গাছটায় বসার আগেই ‘পিক পিক’ ভয়ার্ত ডাক ছেড়ে ছিটকে উঠল একটি মেয়ে কোকিল।
বাগানের ভেতর দিয়ে দ্রুত উড়ে গিয়ে বসল একটি জামরুল গাছে। পুরুষ কোকিলটাও কোথার থেকে উড়ে এল ওই ‘পিক পিক’ ডাক ছেড়েই, বসল বউয়ের পাশে। মেয়েপাখিটি জামরুলের ডালে বসেই একটা ডিম ছেড়ে দিল মাটিতে। পড়েই ভেঙে গেল ওটা। একজোড়া বেজি কাছাকাছিই ছিল, ছুটে এল। ভাঙা ডিমের কুসুম চাটতে চাটতে ওরা ওপরের দিকে তাকাল। যদি পাখিটা আরও ডিম ছাড়ে। আর মেয়ে কোকিলটি তখন অসহায় চোখে দেখছে নিজের ডিমের করুণ পরিণতি। পুরুষটি যেন ওকে সান্ত্বনা দিচ্ছে। মেয়ে কোকিলের কি মন মানে তাতে? সে তো ডিম এভাবে ছাড়তে চায়নি।
সে তো ডিম পাড়ার জন্য গোপনে গিয়ে বসেছিল কুকোর (Crow pheasant) বাসায়। দুই দিন আগে যে বাসাটি তছনছ হয়েছিল প্রচণ্ড ঘূর্ণিঝড়ে, বাসার ওপরের দিকটা গিয়েছিল একেবারেই আলগা হয়ে। না হলে ওই বাসায় চুরি করে ডিম পাড়ার সুযোগটা আসত না—কুকোর বাসায় বসে কোকিলের ডিম পাড়ার সাহস যেমন হতো না, তেমনি বসতেও পারত না। স্বামী-বউ মিলে আজ কত না ফন্দি-ফিকির করে, কুকো দম্পতিকে দূরে সরিয়ে দিতে পেরেছিল।
ওই সুযোগে মেয়ে কোকিল ওই বাসায় বসেও গিয়েছিল। আর একটু সময় পেলে একটা ডিম অন্তত ছাড়তে পারত। কিন্তু যত নষ্টের মূল ওই শঙ্খচিলটা। ও ব্যাটা আসাতেই ঘাবড়ে গেল মেয়ে কোকিল। ছোঁ মারার ভঙ্গিতে নেমে পড়ল বেজি দুটির মাথার ওপর। তারপর ধেয়ে গেল চিলটির দিকে। পুরুষ কোকিলও তাই করল। বেচারা শঙ্খচিল! সে বুঝতেই পারছে না, কী দোষ তার!
এই হচ্ছে কোকিল। যে বাসা করে না, কৌশলে বুদ্ধি খাটিয়ে ডিম পাড়ে কাক, ছাতারে ও হাঁড়িচাচা পাখির বাসায়। এই তিনটি পাখির বাসাই প্রথম নির্বাচন। তারপরের পছন্দ হচ্ছে কসাই ও বুলবুলির বাসা। কোনোটাই না পেলে তখন খোঁজে অন্য পাখির বাসা। কুকোর বাসায় ডিম পাড়াটা ব্যতিক্রমী ঘটনা। কসাইয়ের বাসায় কোকিলকে ডিম দিতে আমি ১৯ বার দেখেছি। সর্বশেষ দেখেছিলাম ১৯৯৬ সালের এপ্রিলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে। ওই বাসা ও কোকিলের বাচ্চাকে আমরা পরপর কিছুদিন পর্যবেক্ষণও করেছিলাম।কোকিলরা প্রথমে একাধিক বাসা নির্বাচন করে। পুরুষটি ‘কুউউ কুউউ’ ডাক ছেড়ে বাসার মালিককে ক্ষেপিয়ে তোলে।
ওরাও ভালো করেই জানে কোকিলের মতলব। ধাওয়া করে। ওই সুযোগে মেয়ে কোকিল ওই বাসায় গিয়ে ডিম পাড়ে। কোকিলেরা ডিম পাড়ে ৪-৬টা। এক বাসায় দুটির বেশি ডিম পাড়ে না। অবশ্যই ওই বাসার দুটি ডিম ফেলে দেয় আগে। অঙ্কটা ওরা ভালোই জানে। এই যে ৪ থেকে ৬টা ডিম, মেয়ে কোকিল তা একাধিক বাসায় ৪৮-৫০ ঘণ্টার ভেতরে ছাড়ে। সময় পার হয়ে গেলে, অর্থাৎ ডিম কোনো বাসায় ছাড়তে না পারলে, ডিম ছেড়ে দেয় গাছের ডালে বসে। সেগুলো মাটিতে পড়ে নষ্ট হয়।
আর কাক-ছাতারেরা জানে কোকিলের স্বভাব, তবুও বোকার হদ্দ ওই পাখিরা কোকিলের ডিমে তা দেয়, বাচ্চা ফোটায় ও লালন-পালন করে। কোকিলের বাচ্চারাও বংশগতির ধারায় বাসা থেকে অন্য বাচ্চাদের ঠেলে ফেলে দেয়। এ হচ্ছে প্রকৃতির এক গূঢ় রহস্য। কোকিলের ডিম ফুটে বাচ্চা হতে সময় লাগে ২৯৪ ঘণ্টা থেকে ৩০০ ঘণ্টা। অথচ কাক-ছাতারেদের সময় লাগে আরও বেশি। এখানেও রয়েছে প্রকৃতির গূঢ় রহস্য ও অঙ্কের নিখুঁত হিসাব। আবার ডিম পাড়ার পরে বাচ্চা হওয়া ও বাচ্চাদের ওড়া পর্যন্ত কোকিলেরা ডিমপাড়া বাসাগুলো নজরে রাখে।
পুরুষ কোকিলের রং কুচকুচে কালো। তার ওপরে হালকা নীলের আভা। সবুজাভ হলুদ ঠোঁট। চোখের রং পাকা মরিচের মতো লাল। ওই লালে যেন হালকা আলতা রং ছড়ানো। মেয়ে কোকিল বাদামি, তাতে হালকা কালচে আভা ও সারা শরীরে সাদা সাদা ছিট-ছোপ আছে। মেয়ে-পুরুষের শরীরের মাপ ৪০-৪৩ সেন্টিমিটার। কোকিলের ইংরেজি নাম Asian koel। বৈজ্ঞানিক নাম Eudynamys scolopacea.
পৃথিবীতে কোকিল ও কোকিলের জাতভাই আছে অনেক। সবাই কিন্তু পরের বাসায় ডিম পাড়ে না। কেউ কেউ বাসা বাঁধে। আমাদের দেশে কোকিলের জাতভাইরা হচ্ছে পাপিয়া, বউ কথা কও, চোখ গেল। সবাই ডিম পাড়ে গ্রীষ্মকালে।
কোকিল চেনে না বা ওর ‘কুউউ কুউউ’ মধুর সুর শোননি, বাংলাদেশে এমন মানুষ বোধ হয় নেই। কী মিষ্টি মোলায়েম আর সুরেলা কণ্ঠ ওই কোকিলের। তবুও পাখিবিজ্ঞানীরা ওকে ‘গায়ক পাখি’ হিসেবে স্বীকার করে না। কেন করে না তা বড় হয়ে জানতে পারবে, যদি জানার ইচ্ছা থাকে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।