কোপেনহেগেন, ডেনমার্ক। নিলস বোরের স্বপ্নের পদার্থবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের পাশেই ছোট্ট একটা পার্ক। পদার্থবিদ্যার জটিল জগতের ভাবনা-জট ছাড়াতে মাঝেমধ্যে এই একখণ্ড সবুজে আসেন বোরের শিষ্যরা। ১৯২৫ সালের এক রাত। পার্কের আশপাশে গাঢ় অন্ধকার। শুধু অনেক দূর পরপর স্ট্রিট ল্যাম্পের ম্লান আলো সেই জমাট অন্ধকারে ফুটে আছে, মহাসমুদ্রের বুকে ছোট ছোট দ্বীপের মতো।
সেই রাতে কোপেনহেগেন শহরে তরুণ হাইজেনবার্গও আমাদের চিন্তার জগৎ ভাঙচুরের আরেকটি মন্ত্র পেয়েছিলেন। এভাবেই তাঁর হাতে জন্ম নিয়েছিল কোয়ান্টাম মেকানিকস বা কণাবাদী বলবিদ্যা, যা বিশ শতকের পদার্থবিজ্ঞানের প্রধান দুটি ভিত্তির অন্যতম। আরেকটি প্রধান ভিত্তির নাম সাধারণ আপেক্ষিকতা, যার জন্ম আইনস্টাইনের হাতে, যেটি আগেই বলেছি।
স্বাভাবিকভাবেই এ দুটি ভিত্তির পরস্পরের মধ্যে খুব বেশি পার্থক্য থাকার কথা নয়। দুটি তত্ত্বই শিক্ষা দেয়—প্রকৃতির সূক্ষ্ম কাঠামোকে আমরা চর্মচোখে যে রূপে দেখি, তা তার চেয়েও অনেক বেশি সূক্ষ্ম। সাধারণ আপেক্ষিকতা মহাকর্ষ, স্থান ও সময় সম্পর্কে এক সরল ও যৌক্তিক দৃষ্টিকোণ।
অন্যদিকে কোয়ান্টাম বলবিদ্যা বা কোয়ান্টাম তত্ত্ব এরই মধ্যে সব পরীক্ষণে অতুলনীয় সফলতা অর্জন করেছে, যা প্রায়োগিক দিকেও সফল। সে জন্যই আমাদের জীবনযাত্রা পাল্টে গেছে (যেমন: কম্পিউটারসহ বিভিন্ন ইলেকট্রনিকস যন্ত্রপাতি)। কিন্তু তারপরও এই তত্ত্ব জন্মের পরও প্রায় এক শ বছরেরও বেশি সময় ধরে রহস্য ও অস্পষ্টতায় ঢাকা রয়েছে।
প্রায় এক শতাব্দীর চিন্তা-ভাবনার পর ১৯০০ সালে জন্ম হয়েছিল কোয়ান্টাম তত্ত্বের। সে সময় জার্মান পদার্থবিদ ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক একটি উত্তপ্ত বাক্সের ভেতরের সাম্যাবস্থায় বৈদ্যুতিক ক্ষেত্র নির্ণয় করছিলেন। কাজটি করতে তিনি এক বিশেষ কৌশল কাজে লাগিয়েছিলেন। কৌশলটি এ রকম: তিনি ধরে নিলেন, ওই ক্ষেত্রের শক্তি কোয়ান্টা আকারে বণ্টিত হয়। অর্থাৎ, শক্তি প্যাকেট বা গুচ্ছ গুচ্ছ আকারে বণ্টিত হয়। এই পদ্ধতিতে পাওয়া ফলাফল পরীক্ষার সঙ্গে যথার্থভাবে মিলে গিয়েছিল। তবে ঝামেলা বাধল অন্য সবকিছুর সঙ্গে, অর্থাত্ যাকে আমরা সময় নামে জানি। শক্তিকে এমন এক বিষয় বলে ধরা হলো, যা অনবরত পরিবর্তিত হয়।
অবশ্য এটি অনেকগুলো ছোট ছোট কোনো মৌলিক উপাদানে গঠিত এমনটি ভাবার কোনো কারণ ছিল না। কিন্তু তারপরও শক্তিকে সসীম প্যাকেট দিয়ে গঠিত বলে ধরে গণনার এই অদ্ভুত কৌশলের আশ্রয় নিলেন প্ল্যাঙ্ক। তবে কৌশলটি কেন কার্যকর হলো, তা তিনিও সঠিকভাবে বুঝতে পারেননি। পাঁচ বছর পর আইনস্টাইন বুঝতে পারলেন শক্তির প্যাকেটের অস্তিত্ব সত্যিই আছে। তিনি প্রমাণও দেখালেন, আলো গুচ্ছ গুচ্ছ প্যাকেট দিয়ে গঠিত, যা আসলে আলোর কণা।
বর্তমানে একে আমরা বলি ফোটন। বিশ শতকের দ্বিতীয় ও তৃতীয় দশকে এ তত্ত্বটি এগিয়ে নিতে প্রধান পথপ্রদর্শক ছিলেন দিনেমার নিলস বোর। তিনিই বুঝতে পেরেছিলেন, আলোকশক্তির মতোই পরমাণুর ভেতরে ইলেকট্রনের শক্তিও শুধু নির্দিষ্ট পরিমাণ হওয়া সম্ভব। তিনি বুঝেছিলেন, ইলেকট্রনগুলো এক পারমাণবিক কক্ষপথ থেকে আরেকটিতে সুনির্দিষ্ট মানের শক্তি নিয়ে লাফ দিতে পারে। এই লাফের সময় ইলেকট্রন একটি ফোটন নিঃসরণ কিংবা শোষণ করে।
এটিই সেই বিখ্যাত কোয়ান্টাম লাফ বা কোয়ান্টাম লিপ। পারমাণবিক জগতের এই হতবুদ্ধিকর আচরণকে বুঝতে এবং তাকে একটি নির্দিষ্ট নিয়মে বাঁধতে কোপেনহেগেনে বোরের ইনস্টিটিউটে ওই শতাব্দীর সবচেয়ে মেধাবী আর প্রতিভাবান তরুণেরা জড়ো হয়েছিলেন। অবশেষে ১৯২৫ সালে এই তত্ত্বের কাঙ্ক্ষিত সেই সমীকরণের দেখা মিলেছিল, যা নিউটনের পুরো বলবিদ্যা হটিয়ে দিয়েছিল। এই সমীকরণটি লিখেছিলেন হাইজেনবার্গ। হাইজেনবার্গ কল্পনা করেছিলেন, ইলেকট্রন সব সময় অস্তিত্বশীল নয়।
কেউ বা কোনো কিছু যখন তাদের দেখে, শুধু তখনই তাদের অস্তিত্ব থাকে। কিংবা আরও ভালোভাবে বলা যায়, অন্য কোনো কিছুর সঙ্গে ইলেকট্রন ক্রিয়াশীল হলেই কেবল তাদের মূর্ত হতে দেখা যায়। কোনো কিছুর সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হলে তারা নির্ণয়যোগ্য সম্ভাবনাসহ একটি জায়গায় মূর্ত (বা বাস্তবে পরিণত) হয়।
এক কক্ষপথ থেকে আরেক কক্ষপথে ‘কোয়ান্টাম লাফ’-এর একটিই অর্থ যে তারা ‘বাস্তবে’ পরিণত হয়। অর্থাৎ একটি ইলেকট্রন হচ্ছে এক মিথস্ক্রিয়া থেকে আরেকটি মিথস্ক্রিয়ায় লিপ্ত হওয়ার এক সেট লাফ। যখন কোনো কিছু এদের বিরক্ত বা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে না, তখন এর অবস্থানও কোনো জায়গাতেই সুনির্দিষ্ট নয়। অর্থাৎ তখন এটি কোনো ‘স্থানেই’ থাকে না।
সত্যিকার অর্থেই আমাদের জ্ঞানের পরিধি বাড়ছে। এর মাধ্যমে আমরা নতুন কিছু করতে পারছি, যা আগে কখনো কল্পনাই করা যায়নি। কিন্তু জ্ঞানের এই বিকাশ আমাদের নতুন নতুন সব প্রশ্নের এবং নতুন রহস্যের মুখে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে। বর্তমানে এই তত্ত্বের এসব সমীকরণ পরীক্ষাগারের চেয়ে গবেষণা প্রবন্ধ আর কনফারেন্সে ব্যবহার অনেক বেড়েই চলেছে। জন্মের প্রায় একশ বছর পরও পদার্থবিজ্ঞানী আর দার্শনিকেরা অনুসন্ধান চালিয়ে যাচ্ছেন: কোয়ান্টাম তত্ত্ব আসলে কী? প্রকৃতির বাস্তবতার অতল গভীরে ব্যতিক্রমী এক ডুব?
নাকি বিশাল কোনো ভুল, যা ভাগ্যক্রমে বেশ ভালোভাবে কাজ করছে? কোনো অসম্পূর্ণ ধাঁধার অংশবিশেষ? নাকি এই মহাবিশ্বের গভীর কোনো কাঠামোর একটি ক্লু, যাকে আমরা এখনো যথাযথভাবে হজম করতে পারিনি? সে কারণেই পদার্থবিদ রিচার্ড ফাইনম্যান একবার বলেছিলেন, ‘আমরা নিশ্চিন্তে বলতে পারি, কেউই কোয়ান্টাম মেকানিকস বোঝে না।’
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।