আতাউর রহমান খসরু : কোরআন সর্বশেষ ঐশী গ্রন্থ। মহান আল্লাহ কিয়ামত পর্যন্ত মানুষের পথনির্দেশ হিসেবে কোরআন নাজিল করেছেন। ফলে তিনি কোরআনকে জানিয়ে জ্ঞান-বিজ্ঞানের অন্তহীন উৎস এবং মুমিনদের কোরআন গবেষণা নানাভাবে উৎসাহিত করেছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘এক কল্যাণময় কিতাব, এটা আমি তোমার প্রতি অবতীর্ণ করেছি, যাতে মানুষ এর আয়াতগুলো অনুধাবন করে এবং বোধশক্তিসম্পন্ন ব্যক্তিরা গ্রহণ করে উপদেশ।’ (সুরা সোয়াদ, আয়াত : ২৯)
কোরআন গবেষণার পরিচয় : শাস্ত্রবিদরা ‘তাদাব্বুরুল কোরআন’ শব্দযুগল দ্বারা কোরআন গবেষণা বোঝানো হয়। তাদাব্বুরের শাব্দিক অর্থ একই বিষয়কে বারবার পর্যালোচনা করে দেখা, কোনো বিষয়ে গভীর চিন্তা ও গবেষণা করা। বিশিষ্ট কোরআন গবেষক সালমান বিন ওমর সুনাইদি ‘তাদাব্বুরে কোরআনে’র সংজ্ঞায় বলেন, ‘তা হলো কোরআনের শব্দগুলোর অর্থ বোঝা, আয়াতগুলোর মর্ম অনুধাবন করা; এর মধ্যে রয়েছে সেসব অর্থ যা ছাড়া বক্তব্য পূর্ণতা পায় না এবং সেসব অর্থ যার ইঙ্গিত, ইশারা ও আত্মোপলব্ধি তাতে রয়েছে। তা করতে হবে কোরআনের উপদেশগুলো বিনয়ের সঙ্গে গ্রহণ করে, তার আদেশের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করে এবং তা থেকে উপদেশ গ্রহণের মাধ্যমে।’ (তাদাব্বুরুল কোরআন, পৃষ্ঠা ১১)
কোরআন গবেষণার বিধান : ইসলামী শরিয়তের বিধান পালনের জন্য কোরআন শেখা ফরজ। যেমন বিশুদ্ধ নামাজ শুদ্ধ হওয়ার জন্য কোরআন তিলাওয়াত শুদ্ধ হওয়া আবশ্যক। তাই তিলাওয়াত শুদ্ধ করা ফরজ। ইবাদতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নয়—এমন জ্ঞানের ব্যাপারে বিশুদ্ধ মত হলো তা অর্জন করা ফরজে কেফায়া। যদি উম্মতের একটি বিশেষ দল কোরআন নিয়ে চিন্তা ও গবেষণা করে তাহলে অন্যরা পাপমুক্ত থাকবে। আর কেউ না করলে সবাই গুনাহগার হবে। তবে প্রতিটি মুমিনের উচিত কোরআন গবেষণায় আগ্রহী হওয়া। আল্লামা জারকাশি (রহ.) বলেন, ‘যার যথাযথ জ্ঞান, বোধ, আল্লাহভীতি ও গবেষণা নেই সে কোরআনের কোনো স্বাদ পাবে না।’ (আল বোরহান : ২/১৭১)
কোরআন নিয়ে গবেষণার উপকারিতা : ইসলামে কোরআন গবেষণার প্রতি মুমিনদের নানাভাবে উৎসাহী করা হয়েছে। যার কয়েকটি হলো—
আল্লাহর অনুগ্রহ লাভ : আল্লাহ কোরআনকে সুপথ ও অনুগ্রহ লাভের উৎস হিসেবে উল্লেখ করেছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘বলুন! আমার প্রতিপালক দ্বারা আমি যে বিষয়ে প্রত্যাদিষ্ট হই, আমি তো শুধু তারই অনুসরণ করি; এই কোরআন তোমাদের প্রতিপালকের নিদর্শন, বিশ্বাসী সম্প্রদায়ের জন্য এটা সুপথ ও রহমত।’ (সুরা বাকারা, আয়াত : ২০৩)
আলোর পথের সন্ধান : আল্লাহ কোরআনের মাধ্যমে মানুষকে আলোর পথের সন্ধান দেন। আল্লাহ বলেন, ‘যারা আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করতে চায়, এর (কোরআন) দ্বারা তিনি তাদের শান্তির পথে পরিচালিত করেন এবং নিজ অনুমতিক্রমে অন্ধকার থেকে বের করে আলোর দিকে নিয়ে যান এবং তাদের সরলপথে পরিচালিত করেন।’ (সুরা মায়িদা, আয়াত : ১৬)
ঈমান বর্ধক : কোরআন গবেষণায় মুমিনের ঈমান বৃদ্ধি পায়। ইরশাদ হয়েছে, ‘যখনই কোনো সুরা অবতীর্ণ হয়, তখন তাদের কেউ কেউ বলে, এটা তোমাদের মধ্যে কার ঈমান বৃদ্ধি করল? যারা মুমিন এটা তাদেরই ঈমান বৃদ্ধি করে এবং তারাই আনন্দিত হয়।’ (সুরা তাওবা, আয়াত : ১২৪)
কোরআন সব জ্ঞানের উৎস : আল্লাহ কোরআনকে সব জ্ঞানের উৎস বানিয়েছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘আমি আত্মসমর্পণকারীদের জন্য প্রত্যেক বিষয়ে ব্যাখ্যাস্বরূপ, পথনির্দেশ, দয়া ও সুসংবাদস্বরূপ তোমার প্রতি কিতাব অবতীর্ণ করলাম।’ (সুরা নাহল, আয়াত : ৮৯)
কোরআন গবেষণার শর্ত ও পদ্ধতি : গবেষক আলেমরা কোরআন গবেষণার ক্ষেত্রে নিম্নোক্ত শর্ত ও পদ্ধতিগুলোর কথা উল্লেখ করেন।
নিয়তের বিশুদ্ধতা : কোরআন গবেষণার আগে ব্যক্তি নিয়ত বিশুদ্ধ করবে এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি ও পুরস্কার আশা করবে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘কোরআন পাঠে দক্ষ ব্যক্তি উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন ফেরেশতাদের সঙ্গী হবে। আর যে ব্যক্তি কোরআন পড়ার সময় আটকে যায় এবং কষ্ট করে তিলাওয়াত করে তার জন্য রয়েছে দ্বিগুণ প্রতিদান।’ (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস : ১৪৫৪)
পরিচ্ছন্ন হৃদয় : কোরআন অর্থ ও মর্ম অনুধাবনের জন্য হৃদয়ের পরিচ্ছন্নতা ও ভিন্ন চিন্তা থেকে তা মুক্ত হওয়া আবশ্যক। ইরশাদ হয়েছে, ‘অতএব তুমি যখনই অবসর পাও একান্তে ইবাদত করো এবং তোমার প্রতিপালকের প্রতি মনোনিবেশ কোরো।’ (সুরা ইনশিরাহ, আয়াত : ৭-৮)
প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি : কোরআন অনুধাবন ও ধারণের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে হবে। সুরা মুজ্জাম্মিলে আল্লাহ তাআলা ‘আমি আপনার প্রতি অবতীর্ণ করছি গুরুভার বাণী’-এর প্রস্তুতি হিসেবে নির্দেশ দিয়েছেন, ‘হে বস্ত্রাবৃত, রাত্রি জাগরণ করো, কিছু অংশ ছাড়া—অর্ধেক কিংবা তদপেক্ষা অল্প অথবা তদপেক্ষা বেশি। আর কোরআন তিলাওয়াত করো ধীরে ধীরে ও সুস্পষ্টভাবে।’ (সুরা মুজ্জাম্মিল, আয়াত : ১-৫)
তাফসিরবিদরা বলেন, কোরআন গবেষণার প্রস্তুতি হলো নিজের মন ও মস্তিষ্ককে পরিশুদ্ধ করা, কোরআন বোঝার জন্য প্রয়োজনীয় ও আনুষঙ্গিক জ্ঞানগুলো অর্জন করা।
গ্রহণযোগ্য উৎস থেকে অধ্যয়ন : কোরআন গবেষণা ও তার সঠিক মর্ম লাভের জন্য বিশুদ্ধ উৎস থেকে তা গ্রহণ করা আবশ্যক। নতুবা ব্যক্তির বিভ্রান্ত হওয়ার সমূহ আশঙ্কা রয়েছে। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘যারা ঈমান এনেছে এবং তাদের ঈমানকে জুলুম দ্বারা কলুষিত করেনি, নিরাপত্তা তাদেরই জন্য এবং তারাই সৎপথপ্রাপ্ত।’ (সুরা আনআন, আয়াত : ৮২)
কোরআন গবেষণার সীমা ও সীমাবদ্ধতা : মহান আল্লাহ যেভাবে কোরআন গবেষণার ব্যাপারে উৎসাহিত করেছেন, তেমনি কোরআনের কিছু বিষয় মানুষের জ্ঞান সীমার বাইরে রেখেছেন, এসব বিষয়ের পেছনে পড়তে নিষেধ করেছেন। যেমন ‘হুরুফে মুকাত্তিয়াত’ (বিভিন্ন সুরার শুরুতে আসা বিভিন্ন আরবি বর্ণ) ও ‘আয়াতে মুতাশাবিহাত’।
পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, “তিনিই তোমার প্রতি এই কিতাব অবতীর্ণ করেছেন, যার কতক আয়াত ‘মুহকাম’, এগুলো কিতাবের মূল। আর অন্যগুলো ‘মুতাশাবিহ’, যাদের অন্তরে সত্য-লঙ্ঘন প্রবণতা রয়েছে শুধু তারাই ফিতনা এবং ভুল ব্যাখ্যার উদ্দেশ্যে মুতাশাবিহাতের অনুসরণ করে। আল্লাহ ছাড়া অন্য কেউ এর ব্যাখ্যা জানে না। আর যারা জ্ঞানে সুগভীর তারা বলে, আমরা এটা বিশ্বাস করি, পুরোটাই আমাদের প্রতিপালকের কাছ থেকে আগত এবং বোধশক্তিসম্পন্নরা ছাড়া অন্য কেউ শিক্ষা গ্রহণ করে না।” (সুরা আলে ইমরান, আয়াত : ৭)
মহান আল্লাহ আমাদের কোরআন গবেষণা ও তার মর্ম অনুধাবনের তাওফিক দান করুন। আমিন।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।