আপনার মনে প্রশ্ন আসতে পারে যে, ক্লোরিন গ্যাসে কী এমন জিনিস আছে, যার কারণে মাত্র ১০ মিনিটে মানুষের মৃত্যু ঘটে? এই গ্যাস কাজ করে কীভাবে? বর্তমানে অবশ্য জেনেশুনে কারও এ রকম ক্লোরিন গ্যাসের সম্মুখীন হওয়ার সম্ভাবনা কম। কিন্তু আপনি যদি জীবাণুনাশক হিসেবে ব্যবহার করা অতিরিক্ত ক্লোরিনযুক্ত কোনো সুইমিংপুলের পানিতে সাঁতার কেটে থাকেন, তাহলে দেখবেন, চামড়া আর চোখে খুব অস্বস্তি হচ্ছে।
আমাদের চোখ, নাক, মুখ ও ফুসফুসে তরলের একটা পাতলা আবরণ থাকে। তরলের এ আবরণ বিভিন্ন অঙ্গ আর্দ্র রাখে এবং স্বাভাবিকভাবে কাজ করতে সাহায্য করে। আমাদের মুখের লালারস বা স্যালাইভাতে থাকে মিউকাস নামের একধরনের পদার্থ, যা খাবার গিলতে সাহায্য করে। পাশাপাশি ক্ষতিকারক ব্যাকটেরিয়াও মেরে ফেলে এই লালারস।
নাক ও শ্বাসযন্ত্রের তরলের আবরণ একটু আঠালো ধরনের—ক্ষতিকারক ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া ও ধুলাবালু আটকে রাখে, ফলে এগুলো ফুসফুসে গিয়ে সংক্রমণ করতে পারে না। এই যে তরল আবরণ আমাদের শরীরের প্রতিরক্ষা দেয়, এতে ক্লোরিন গ্যাস প্রবেশ করলে দ্রবীভূত হয়ে যায়। আর তখনই সৃষ্টি হয় সমস্যা।
ক্লোরিন গ্যাস যখন পানিতে দ্রবীভূত হয়, তখন ভেঙে গিয়ে দুই ধরনের অ্যাসিড তৈরি করে—হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিড (HCl) ও হাইপোক্লোরাস অ্যাসিড (HClO)। হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিড অবশ্য আমাদের শরীরের কাছে অপরিচিত কিছু নয়। আমাদের পাকস্থলীতে এই অ্যাসিড থাকে খাদ্য পরিপাক ও ব্যাকটেরিয়া ধ্বংস করার জন্য। পাকস্থলীতে মিউকাসের একটা দৃঢ় আবরণ থাকে, যার কারণে পাকস্থলীর কোষগুলো অ্যাসিডে ক্ষতিগ্রস্ত হয় না।
কিন্তু চোখ আর ফুসফুসে এ রকম কোনো প্রতিরক্ষাব্যবস্থা নেই। ফলে এসব অঙ্গের কোষগুলো সরাসরি অ্যাসিডের মুখে পড়ে যায়। চোখে যদি ক্লোরিন থেকে অ্যাসিড তৈরি হয়, তখন আমাদের চোখে শুরু হয় বেদনাদায়ক জ্বালাপোড়া। তবে চোখের পানি এ ক্ষেত্রে ভালো প্রতিরক্ষা দেয়। ক্লোরিন গ্যাসের পরিমাণ যদি অল্প হয়, তাহলে সেটা চোখের কান্নার পানিতে ভেসে যায়।
অন্যদিকে ফুসফুসে এ রকম প্রতিরক্ষাব্যবস্থা সামান্যই। শ্বাস গ্রহণের সঙ্গে ক্লোরিন গ্যাস ঢুকে পড়লে যে অ্যাসিড তৈরি হয়, তা ফুসফুসের টিস্যু ধ্বংস করে দেয়, ফলে অস্বস্তিকর অনুভূতি হয়। এতে আমাদের শরীর আত্মরক্ষার জন্য শ্বাসনালি সংকুচিত করে দেয়, যেন বিষাক্ত ক্লোরিন ফুসফুসের গভীরে যেতে না পারে। এই ফুসফুসে অক্সিজেন ও কার্বন ডাই–অক্সাইড বিনিময় ঘটে।
সমস্যা হলো, শ্বাসনালি সংকুচিত হয়ে গেলে ফুসফুসে অক্সিজেন আসার রাস্তাও বন্ধ হয়ে যায়। ফলে কেউ ক্লোরিন গ্যাসের সংস্পর্শে এলে হাঁপাতে শুরু করে, আরও বেশি করে বাতাস টানার চেষ্টা করে। এভাবে আরও বেশি ক্লোরিন ঢুকে পড়ে ফুসফুসে।
ফুসফুসের টিস্যুতে জ্বালাপোড়া করলে প্রতিক্রিয়া হিসেবে কাশি হয়। সাধারণ সময়ে এটা ভালো জিনিস। কারণ, কাশির সঙ্গে বেরিয়ে যায় ছোটখাটো বর্জ্য বা ক্ষতিকারক ব্যাকটেরিয়া। কিন্তু ক্লোরিনের সংস্পর্শে সাধারণ কাশিই অনেক তীব্র ও দীর্ঘতর হয়। এতে শ্বাসপ্রশ্বাস খুব কঠিন হয়ে পড়ে। ফলে শ্বাসনালি ও ফুসফুসে যে দুর্বল কোষগুলো থাকে, সেগুলো ধ্বংস হয়ে যায়। প্রদাহের কারণে ফুসফুসের টিস্যুগুলো ধ্বংস হয়ে যেতে থাকে।
যুদ্ধের ময়দান থেকে যেসব সৈন্য ক্লোরিনের আক্রমণ থেকে জীবিত ফিরতে পেরেছিলেন, তাঁদের অনেকেই বাকি জীবন ফুসফুসের সমস্যায় ভুগেছেন। অনেক বেশি ক্লোরিন দেহে প্রবেশ করলে ফুসফুসে এত বেশি ক্ষত সৃষ্টি হয় যে এর চারদিকে থাকা রক্তনালিগুলো থেকে অতিরিক্ত তরল এসে জমতে থাকে। এতে আক্রমণের শিকার ব্যক্তির ফুসফুস নিজের শরীরের তরলেই ডুবে যেতে থাকে। আর তখনই শ্বাসরোধে মারা যায় আক্রান্ত ব্যক্তি।
দুর্ভাগ্যজনকভাবে বিষাক্ত ক্লোরিনের কোনো প্রতিষেধক নেই। ক্লোরিনের সংস্পর্শ থেকে আক্রান্ত ব্যক্তিকে দ্রুত সরিয়ে আনাই জীবন বাঁচানোর একমাত্র উপায়। এরপর তার শ্বাসপ্রশ্বাস স্বাভাবিক করাই হবে বড় চ্যালেঞ্জ। আক্রান্ত ব্যক্তির কত দ্রুত বা ধীরগতিতে মৃত্যু হবে, তা নির্ভর করবে কী পরিমাণ ক্লোরিনের সংস্পর্শে এসেছে, আর ফুসফুসে কী পরিমাণ ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে, তার ওপর।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর পেরিয়ে গেছে এক শতাব্দী। রাসায়নিক অস্ত্রও আগের চেয়ে অনেক উন্নত হয়েছে। রাশিয়ার বিভিন্ন ধনকুবের ও গুপ্তচররা রাসায়নিক অস্ত্রের শিকার হয়েছেন। সম্প্রতি রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের তীব্র সমালোচক অ্যালেক্সি নাভালনি ও উত্তর কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট কিম জং–উনের সৎভাই কিম জং–ন্যামও শিকার হয়েছেন বিষক্রিয়ার।
রাসায়নিক অস্ত্র নিয়ে পরাশক্তিদের উদ্বেগ তাই ফেলে দেওয়ার মতো নয়। এটাও পারমাণবিক অস্ত্রের মতোই গুরুত্বপূর্ণ। ক্ষেত্রেবিশেষে আরও বেশি ক্ষতিকর। আসলে যেকোনো ধরনের অস্ত্রই মানবসভ্যতার জন্য ক্ষতিকর। মানুষ অস্ত্রের ব্যবহার ভুলে গিয়ে সবাই মিলেমিশে পৃথিবী গড়ার চেষ্টা করলেই কেবল এ ধরনের ক্ষতি এড়ানো সম্ভব।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।