নিজস্ব প্রতিবেদক, গাজীপুর: গাজীপুরের কালিয়াকৈরের শ্রমিক কলোনির অগ্নিকাণ্ডে দীর্ঘ হচ্ছে মৃত্যুর তালিকা। এ পর্যন্ত ১৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। ঘটনার ১২ দিন পেরিয়ে গেলেও এখনো স্বাভাবিক হতে পারেননি ওই এলাকার বাসিন্দারা। স্বজন ও প্রতিবেশী হারানোর বেদনা, অগ্নিকাণ্ডের আতঙ্ক এখনো তাদের তাড়া করে ফিরছে।
১৩ মার্চ বিকেলে তেলিরচালা এলাকার শ্রমিক কলোনিতে গ্যাস সিলিন্ডার চুলার সঙ্গে সংযোগ দেওয়ার সময় লিক হয়ে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। এ সময় চুলার আগুনের সংস্পর্শে আগুন লেগে যায়। দগ্ধ হন ৩৪ জন। ৩২ জনকে রাজধানীর শেখ হাসিনা বার্ন ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয়। তাঁদের মধ্যে এ পর্যন্ত ১৬ জন মারা গেছেন। বাকিরা শেখ হাসিনা বার্ন ইনস্টিটিউটে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন। দুজনকে স্থানীয়ভাবে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। এলাকাবাসীর আক্ষেপ, এত মানুষের মৃত্যু দায়িত্বশীল কোনো মহলের হৃদয় স্পর্শ করতে পারেনি।
ঘটনার পরদিন শ্রমিক কলোনি পরিদর্শন করেন গাজীপুরের জেলা প্রশাসক আবুল ফাতে মো. শফিকুল ইসলাম ও পুলিশ সুপার কাজী শফিকুল আলম। এ ঘটনা তদন্তে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে জেলা প্রশাসন। কমিটি তদন্ত করে কিছু সুপারিশমালাসহ প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। এতে কাউকে ঘটনার জন্য দায়ী করা হয়নি। এটিকে একটি নিছক দুর্ঘটনা হিসেবেই দেখা হয়েছে।
সরেজমিন দেখা গেছে, গাজীপুর মহানগরীর শেষ সীমানায় কোনাবাড়ী ফ্লাইওভার থেকে নামলেই মহাসড়কের উত্তর পাশে নিচে নেমে গেছে একটি গলি। এটি গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার তেলিরচালা এলাকা। পাশেই রয়েছে টপস্টার কারখানা। এর কোল ঘেঁষে গড়ে ওঠা কলোনিতে ঢুকতেই উৎকট গন্ধে গা গুলিয়ে আসে। মনে পড়ে যায় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সেই উক্তি, ‘ঈশ্বর থাকেন ওই ভদ্র পল্লিতে, এখানে তাহাকে খুঁজিয়া পাওয়া যাইবে না।’ সেই পদ্মাপারের কেতুর গ্রামের কথা। সেখানে অনেক কষ্টে বেঁচে থাকার জন্য ঘর ভাড়া নিয়ে জীবন ধারণ করে আছেন অসংখ্য নিম্ন আয়ের মানুষ।
দুর্গন্ধ ও ভাঙাচোরা পথ পেরিয়ে একটু এগোলেই চোখে পড়ে প্রায় ৩০০ মিটার দীর্ঘ গলির দুই পাশে থাকা সারি সারি টিনের ঘর। একটি সারিতে ১৪-১৫টি করে ঘর। প্রায় সবাই ঘরের ভেতরে গ্যাস সিলিন্ডার দিয়ে রান্না করেন। কেউ কেউ সামনের গলিতে মাটির চুলায় রান্না করেন। বিদ্যুৎ বিলসহ ভাড়া মাত্র দেড় থেকে দুই হাজার টাকা। এসব ঘরে থাকেন বিভিন্ন কল-কারখানা বা দৈনিক মজুরি ভিত্তিতে কাজ করা নিম্ন আয়ের মানুষ।
এমনই দুই সারিতে ১৮টি ঘরের মালিক শফিকুল। তিনি এসব ঘরের একটিতে স্ত্রী-সন্তানকে নিয়ে নিজে বসবাস করেন। বাকিগুলো ভাড়া দিয়েছেন।
শফিকুল বলেন, ‘আমার ঘরে গ্যাস শেষ হয়ে যায়। আমার স্ত্রী তাঁর ভাই মালেককে গ্যাস সিলিন্ডার পাঠানোর জন্য বলে। ঘটনার দিন বিকেল ৫টার দিকে মালেক লালমাটিয়া এলাকার এরশাদ রানার দোকান থেকে একটি গ্যাস সিলিন্ডার নিয়ে আমার ছেলের মাধ্যমে পাঠায়। সিলিন্ডারটি চুলার সঙ্গে সংযোগ দিতে গেলে সিলিন্ডারটির চাবি ভেঙে যায়। গ্যাস ঘরের ভেতরে ছড়িয়ে পড়ে। নিজেকে বাঁচাতে সিলিন্ডারটি ঘরের বাইরে গলিতে ফেলে দিই।’
শফিকুল আরও বলেন, ‘আমি লোকজনকে কাছে না আসার অনুরোধ করলেও কেউ আমার কথা শোনেনি। পরে ওই গলিতেই কাঠের চুলায় রান্না করার আগুন গ্যাসের সংস্পর্শে এসে দুর্ঘটনা ঘটে।’
এ ঘটনার সময় শফিকুল ও তাঁর পরিবারের লোকজন ঘরের ভেতর থাকায় তাঁরা আহত হননি। শফিকুলের ১৮টি রুমের বাসিন্দাদের মধ্যে পাঁচজন আগুনে দগ্ধ হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে তিনজন মারা গেছেন। বাকিরা পাশের অন্যান্য ঘরের ভাড়াটিয়া।
গ্যাস সিলিন্ডার বিক্রয়কারী ওমেগা গ্যাসের সাবডিলার এরশাদ রানা বলেন, ‘আমার দোকান থেকে শফিকুলের শ্যালক মালেক একটি ওমেগা গ্যাস সিলিন্ডার নিয়ে যায়। পরে তিনি ওই গ্যাস সিলিন্ডার একটি ছোট ছেলেকে দিয়ে ওই বাড়িতে পাঠায়। নেওয়ার পথে সিলিন্ডারটি কয়েকবার আছাড় খেয়েছে, এতে সিলিন্ডারটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকতে পারে।’
এরশাদ রানার দাবি করেন, ‘আমি সিলিন্ডার বিক্রি করলে সরাসরি নিজে গিয়ে চুলার সঙ্গে সংযোগ দিয়ে আসি। সিলিন্ডার যে বিক্রি করেন—এটি তাঁর দায়িত্ব। মালেক সিলিন্ডার বিক্রি করেছে। এটি নিরাপদে চুলের সঙ্গে সংযুক্ত করার দায়িত্ব ছিল মালেকের। তিনি (মালেক) নিজেও গ্যাস সিলিন্ডারের ব্যবসা করে। একজন অভিজ্ঞ ব্যক্তি দিয়ে সিলিন্ডারটি চুলার সঙ্গে সংযুক্ত করলে হয়তো দুর্ঘটনা এড়ানো যেত। কারণ, যাঁরা এ বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করেন, তাঁদের কাছে অতিরিক্ত চাবি অথবা রাইজার থাকে। একটি নষ্ট হলে আরেকটি লাগিয়ে সংযোগটি নিরাপদ করা যেত।’
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঘটনার দিন বিকেলে গলিতে কাঠের চুলায় রান্না করছিলেন শফিকুলের একটি ঘরের ভাড়াটিয়া মুক্তি বেগম (৪০)। শফিকুল ঘরের ভেতর গ্যাস সিলিন্ডার চুলার সঙ্গে সংযোগ দেওয়ার সময় চাবি ভেঙে যায়। গ্যাস ঘরের ভেতর ছড়িয়ে পড়লে তিনি সিলিন্ডারটি গলিতে ছুড়ে ফেলে দেন। এ সময় চুলার আগুনের সংস্পর্শে আগুন ধরে যায়। এতে গলিতে থাকা পথচারী ও আশপাশের লোকজন নারী, পুরুষ ও শিশুসহ ৩৪ জন দগ্ধ হয়।
মরদেহ হাসপাতাল থেকেই সরাসরি তাঁদের নিজ নিজ গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তাঁদের সবার ঘর বর্তমানে তালাবদ্ধ পাওয়া যায়।
এখানে একটি ঘরে ভাড়া থাকেন শাহিদা বেগম (৩২)। তিনি সেদিনের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে বলেন, ‘প্রথমে সিলিন্ডার থেকে গ্যাস বের হচ্ছিল। হঠাৎ চুলা থেকে আগুন ধরে বিভীষিকাময় অবস্থা। গলির ভেতরে মানুষের আর্তনাদ। বর্তমানে আমরা আতঙ্কের মধ্যে রয়েছি। আবার দুর্ঘটনা ঘটে কি না; আমরা খুব উদ্বিগ্ন।’
সিরাজগঞ্জ জেলার কাজীপুর থানার পানাগাড়ি গ্রামের শুকুর শেখ স্ত্রী কমলা বেগমকে (৭০) নিয়ে এসেছিলেন ছেলে ও মেয়ের কাছে বেড়াতে। তাঁদের ছেলে আল আমিন ও মেয়ে স্থানীয় কারখানায় কাজ করেন। এখানে একটি ঘরে ভাড়া থাকেন। দুর্ঘটনার সময় তিনি মসজিদে ছিলেন। কমলা বেগমের পুত্রবধূ শিল্পী বলেন, ‘আমার শাশুড়ি কমলা বেগম আমাদের ঘর থেকে ননদের ঘরে যাচ্ছিলেন। পথে তিনি দগ্ধ হন। বর্তমানে তিনি শেখ হাসিনা বার্ন ইনস্টিটিউটের আইসিইউতে ভর্তি।’
শিল্পী আরও বলেন, ‘আমার ভাগনে জামাই লালন কারখানা থেকে ইফতারের উদ্দেশ্যে বাড়ি ফিরছিলেন। তিনিও পথে দগ্ধ হন। বর্তমানে বার্ন ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন আছেন। আমাদের দাবি এই সিলিন্ডার গ্যাস তুলে দিয়ে আমাদের সরকারি সাপ্লাইয়ের গ্যাস সরবরাহ করা হোক।’
রাজশাহী জেলার বাগা থানার যুবক আরিফ। তিনি এক ছেলে, এক মেয়ে ও স্ত্রীকে নিয়ে এই কলোনিতে ভাড়া থাকতেন। পাশের একটি ফ্যাক্টরিতে চাকরি করেন। গ্যাস সিলিন্ডার বন্ধে চেষ্টা করার সময় হঠাৎ আগুন ধরে যায়। এ ঘটনায় তিনি দগ্ধ হয়ে মারা গেছেন।
আরেকটি ঘরের ভাড়াটিয়া হালিমা বেগম বলেন, ‘আমার ভগ্নিপতি কবির হোসেন গ্যাস বের হওয়ার সময় পাশের চুলার আগুন নেভানোর জন্য অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু তাঁর কথা শোনেনি। উল্টো তর্ক করছিলেন। এর কিছুক্ষণের মধ্যেই আগুনে সবকিছু শেষ করে দিল। কবির ও তার দেড় বছরের কন্যাসন্তান রাহিমা দগ্ধ হয়। শেখ হাসিনা বার্ন ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন। কবিরের অবস্থা গুরুতর।’
ওই কলোনির বাসিন্দা সুজন হোসেন বলেন, ‘ঘটনার পর থেকে আমি আতঙ্কের মধ্যে আছি। আবারও যেকোনো সময় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে এই শঙ্কা। আমার স্ত্রী ও সাত বছর বয়সী কন্যাকে নিয়ে থাকি। এখন ভাবছি স্ত্রী ও সন্তানকে দেশের বাড়িতে পাঠিয়ে দেব।’
গাজীপুরের জেলা প্রশাসক আবুল ফাতে মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছি। তদন্ত কমিটি প্রতিবেদন দিয়েছে। প্রতিবেদনে কাউকে দোষারোপ করা হয়নি। তবে কিছু সুপারিশ করা হয়েছে। এখন আমরা ভবিষ্যতে এ ধরনের দুর্ঘটনা রোধে নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য নির্মিত বাসা বা ঘরগুলো যাতে নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত হয়; সে জন্য এসব ঘরের রান্নাঘরগুলো আলাদা করে পুনর্নির্মাণ করা, নিরাপত্তা বাড়ানোর জন্য আরও কী ব্যবস্থা নেওয়া যায়—এসব বিষয় নিয়ে কাজ করছি।’
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।