ক্লিক করুন। ইগনিশন চালু করুন। গাড়ি স্টার্ট। রোজকার এই রুটিনের শুরুতে একবারও কি ভেবে দেখেছেন, পিচ্ছিল রাস্তায় ব্রেক কষলে কীভাবে গাড়িটি হঠাৎই নিয়ন্ত্রণ হারায় না? সামনে থেকে হঠাৎ কোনো গাড়ি এগিয়ে এলে কীভাবে সতর্ক সংকেত পেলেন? কিংবা ভয়াবহ সংঘর্ষের পরেও কীভাবে আপনি বা আপনার পরিবারের সদস্যরা প্রাণে বেঁচে গেলেন? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর লুকিয়ে আছে আপনার গাড়ির অন্তরালে বসানো সেই অদৃশ্য রক্ষাকবচগুলোর মধ্যে – গাড়ির নিরাপত্তা ফিচার। এই ফিচারগুলোই প্রতিটি যাত্রাকে শুধু আরামদায়কই করে না, করে তোলে নিরাপদ। কিন্তু কতটুকু জানেন আপনি এই জীবনরক্ষাকারী প্রযুক্তিগুলো সম্পর্কে? কেন এই বৈশিষ্ট্যগুলো বেছে নেওয়া আপনার এবং আপনার প্রিয়জনের জন্য অপরিহার্য?
বাংলাদেশের রাস্তায় প্রতিদিন অসংখ্য দুর্ঘটনা ঘটে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) সাম্প্রতিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, সড়ক দুর্ঘটনায় বাংলাদেশে প্রতি বছর গড়ে প্রায় ২৫,০০০ মানুষের মৃত্যু হয় এবং আহত হন প্রায় ৬০,০০০ মানুষ। এই মর্মান্তিক পরিসংখ্যানের পেছনে অনেক কারণ থাকলেও, গাড়িতে পর্যাপ্ত ও আধুনিক নিরাপত্তা ফিচার এর অভাব একটি বড় ভূমিকা পালন করে। এই আর্টিকেলে, আমরা আপনাকে নিয়ে যাব গাড়ির সেই অদৃশ্য রক্ষাকবচগুলোর জগতে। জানাবো বিস্তারিত – কোন ফিচার কীভাবে কাজ করে, কেন তা গুরুত্বপূর্ণ, এবং আপনার গাড়িতে কী কী নিরাপত্তা ফিচার থাকা একান্ত প্রয়োজন। আপনার সচেতনতাই পারে আপনার এবং আপনার পরিবারের জীবন বাঁচাতে।
(চিত্র: আধুনিক গাড়িতে ব্যবহৃত বিভিন্ন নিরাপত্তা ফিচারের চিত্রিত ব্যাখ্যা – যেমন এয়ারব্যাগ, ABS, ESC ইত্যাদি। সোর্স: Global NCAP)
গাড়ির নিরাপত্তা ফিচার: জীবন বাঁচানোর প্রযুক্তির ভিত্তি জানুন বিস্তারিত
গাড়ির নিরাপত্তা ফিচার বলতে সেই সমস্ত প্রযুক্তি এবং বৈশিষ্ট্যকে বোঝায় যা দুর্ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা কমাতে (সক্রিয় নিরাপত্তা) এবং দুর্ঘটনা ঘটে গেলে চালক ও যাত্রীদের আঘাতের মাত্রা কমাতে বা প্রতিরোধ করতে (নিষ্ক্রিয় নিরাপত্তা) কাজ করে। এগুলোকে প্রায়শই গাড়ির ‘অদৃশ্য অভিভাবক’ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এই ফিচারগুলোর কার্যকারিতা শুধু গাড়ির দাম বা ব্র্যান্ডের উপর নির্ভর করে না, বরং নির্ভর করে সেগুলোর ডিজাইন, মান নিয়ন্ত্রণ এবং সঠিকভাবে কাজ করার সামর্থ্যের উপর। বাংলাদেশে গাড়ি কেনার সময় প্রায়শই আমরা লুক্সারি ফিচার, মাইলেজ বা বাহ্যিক সৌন্দর্যের দিকে বেশি নজর দিই, কিন্তু আসলেই যে ফিচারগুলো আমাদের প্রিয়জনের জীবন রক্ষা করতে পারে, সেগুলোকে অনেক সময় অবহেলা করি। একটি গাড়ির নিরাপত্তা রেটিং (যেমন Global NCAP বা ASEAN NCAP কর্তৃক প্রদত্ত) মূলত এর নিরাপত্তা ফিচার এর পরিপূর্ণতা ও কার্যকারিতার উপরই নির্ভর করে। একটি ৫-স্টার রেটেড গাড়ি প্রমাণ করে যে তার নিষ্ক্রিয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা ক্র্যাশ টেস্টে যাত্রীদের মারাত্মক আঘাত থেকে রক্ষা করতে সক্ষম।
সক্রিয় নিরাপত্তা সিস্টেম: দুর্ঘটনা এড়ানোর কলাকৌশল জানুন বিস্তারিত
সক্রিয় নিরাপত্তা সিস্টেম (Active Safety Systems) হলো সেইসব প্রযুক্তি যা দুর্ঘটনা ঘটার আগেই সেটি প্রতিরোধ বা এড়ানোর চেষ্টা করে। এগুলো গাড়ির নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে, চালককে সতর্ক করতে এবং ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতি শনাক্ত করে প্রাথমিকভাবে ব্যবস্থা নিতে সাহায্য করে।
অ্যান্টি-লক ব্রেকিং সিস্টেম (ABS):
- কী কাজ করে: ABS পিচ্ছিল বা ভেজা রাস্তায় জরুরি ব্রেকিংয়ের সময় গাড়ির চাকাগুলোকে লক হওয়া থেকে বিরত রাখে। এটি প্রতি সেকেন্ডে কয়েকশ বার ব্রেক ফ্লুইডের চাপ বাড়ায়-কমায়, যাতে চাকাগুলো ঘুরতে থাকে এবং গাড়ি স্টিয়ারিং নিয়ন্ত্রণে থাকে। ভাবুন তো, ঢাকার বৃষ্টিতে ভেজা রাস্তায় হঠাৎ সামনে পথচারী দেখে জোরে ব্রেক দিলেন। ABS ছাড়া গাড়ির চাকা লক হয়ে গেলে স্টিয়ারিং কাজ করবে না এবং গাড়ি ঘুরে যেতে পারে বা পিছলে যেতে পারে। ABS থাকলে আপনি ব্রেক চাপা দেওয়ার পাশাপাশি ঘুরিয়ে গাড়িটি বিপদ এড়িয়ে নিয়ে যেতে পারবেন।
- কেন গুরুত্বপূর্ণ: বাংলাদেশের মতো দেশে যেখানে আকস্মিক ব্রেকিংয়ের ঘটনা প্রায়শই ঘটে (যানজট, অনিয়ন্ত্রিত পথচারী পারাপার, পশু চলাচল), ABS থাকা অত্যাবশ্যক। এটি গাড়ির নিয়ন্ত্রণ ধরে রেখে সংঘর্ষের সম্ভাবনা উল্লেখযোগ্যভাবে কমায়। ভারতের ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ রোড ট্রান্সপোর্ট (IRTE) এর একটি গবেষণা অনুযায়ী, ABS সিস্টেম সড়ক দুর্ঘটনা ৩০% পর্যন্ত কমাতে পারে।
- ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা: সিলেটের পাহাড়ি রাস্তায় ভ্রমণের সময় একবার প্রচণ্ড বৃষ্টি হচ্ছিল। হঠাৎ একটি ট্রাক বিপরীত দিক থেকে বেপরোয়াভাবে ওভারটেক করতে এসে সামনে পড়ে যায়। জোরে ব্রেক চাপতেই ABS সিস্টেম সক্রিয় হয় – ব্রেক প্যাডেল কাঁপতে শুরু করে, কিন্তু গাড়ি সোজা পথ ধরে থামে এবং স্টিয়ারিং আমার হাতে থাকায় ডানে ঘুরে বিপদ এড়াতে পারি। ABS না থাকলে হয়তো দুর্ঘটনা অনিবার্য ছিল।
ইলেকট্রনিক স্টেবিলিটি কন্ট্রোল (ESC) / ভেহিক্যাল স্টেবিলিটি কন্ট্রোল (VSC):
- কী কাজ করে: ESC হলো ABS এর চেয়েও উন্নত একটি সিস্টেম। এটি সেন্সরগুলোর মাধ্যমে গাড়ির চলাচলের দিক (স্টিয়ারিং অ্যাঙ্গেল অনুযায়ী) এবং গাড়ির প্রকৃত চলাচলের দিকের মধ্যে কোনো অমিল আছে কিনা তা শনাক্ত করে। যদি গাড়ি হঠাৎ ঘুরে যায়, পিছলে যায় বা ওভারস্টিয়ার/আন্ডারস্টিয়ার করে (যেমন: তীব্র বেগে বাঁক নেওয়ার সময়), ESC স্বয়ংক্রিয়ভাবে নির্দিষ্ট চাকায় ব্রেক প্রয়োগ করে এবং প্রয়োজনে ইঞ্জিনের শক্তি কমিয়ে গাড়িকে আবার সোজা পথে ফিরিয়ে আনে। এটি গাড়িকে ‘রোলওভার’ বা ‘স্পিন আউট’ হওয়া থেকে রক্ষা করে।
- কেন গুরুত্বপূর্ণ: বাংলাদেশের জাতীয় মহাসড়কগুলোর অনেক অংশই সরু এবং বাঁক-টানা। উচ্চগতিতে বা ভেজা রাস্তায় বাঁক নেওয়ার সময়, কিংবা আকস্মিকভাবে কোনো বাধা এড়ানোর সময় ESC গাড়িকে স্থিতিশীল রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ইউরোপীয় ট্রান্সপোর্ট সেফটি কাউন্সিল (ETSC) এর মতে, ESC সমস্ত মারাত্মক সড়ক দুর্ঘটনা ২৫% এবং মারাত্মক একক গাড়ি দুর্ঘটনা ৪০% পর্যন্ত কমাতে পারে। বিশ্বের অনেক দেশেই এখন ESC বাধ্যতামূলক।
- প্রয়োগ: ধরুন, আপনি চট্টগ্রামের কর্ণফুলী এক্সপ্রেসওয়েতে গাড়ি চালাচ্ছেন। হঠাৎ সামনে থেকে একটি টায়ার বা বড় পাথর এসে পড়ল। আপনি দ্রুত স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে সেটা এড়ালেন। কিন্তু হঠাৎ করে গাড়ি আপনার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে, ডানে বা বামে ঘুরে যেতে পারে। এই মুহূর্তে ESC সক্রিয় হয়ে প্রয়োজনীয় চাকায় ব্রেক প্রয়োগ করে এবং ইঞ্জিন পাওয়ার সামঞ্জস্য করে গাড়িকে সোজা পথে ফিরিয়ে আনে।
ট্র্যাকশন কন্ট্রোল সিস্টেম (TCS):
- কী কাজ করে: TCS মূলত গাড়ির চাকার পিছলানো (Wheel Spin) রোধ করে। বিশেষ করে ত্বরণের সময়, ভেজা, বালি বা বরফে ঢাকা রাস্তায়, কিংবা খুব বেশি গ্যাস দিলে, চাকাগুলো ঘুরতে ঘুরতে পিছলাতে পারে এবং গাড়ি সামনে এগোতে পারে না। TCS সিস্টেম সেই পিছলানো চাকা বা চাকাগুলো শনাক্ত করে সেখানে ব্রেক প্রয়োগ করে এবং/অথবা ইঞ্জিনের শক্তি সাময়িকভাবে কমিয়ে দেয়, যাতে চাকার গ্রিপ ফিরে আসে এবং গাড়ি সামনে এগোতে পারে।
- কেন গুরুত্বপূর্ণ: বাংলাদেশে বর্ষাকালে পানি জমে থাকা রাস্তা, নির্মাণাধীন ময়লা-বালি পড়া রাস্তা বা গ্রামীণ কাঁচা পিচ্ছিল রাস্তায় TCS খুবই উপকারী। এটি শুধু গাড়ি আটকে যাওয়া রোধই করে না, ত্বরণের সময় গাড়ির নিয়ন্ত্রণ হারানো থেকেও রক্ষা করে। ঢাকার গুলিস্তান বা ফার্মগেটের মতো যানজটপূর্ণ এলাকায় হঠাৎ গ্যাপ পেয়ে দ্রুত গাড়ি সামনে নেওয়ার সময়ও TCS স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সাহায্য করে।
ব্রেক অ্যাসিস্ট (BA) বা ইমার্জেন্সি ব্রেক অ্যাসিস্ট (EBA):
- কী কাজ করে: জরুরি অবস্থায় মানুষ প্রায়ই দ্রুত কিন্তু পর্যাপ্ত জোরে ব্রেক চাপাতে পারে না। ব্রেক অ্যাসিস্ট সিস্টেম ব্রেক প্যাডেলে চাপের গতি এবং পরিমাণ সেন্সর করে বুঝতে পারে কখন জরুরি ব্রেকিং প্রয়োজন। সে অনুযায়ী এটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে ব্রেকিং চাপ সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিয়ে যায়, যত দ্রুত সম্ভব গাড়িটিকে থামানোর জন্য। এটি ABS এর কার্যকারিতা বাড়িয়ে দেয়।
- কেন গুরুত্বপূর্ণ: আকস্মিক বিপদের মুখে স্বাভাবিকের চেয়ে দ্রুত সাড়া দেওয়ার জন্য ব্রেক অ্যাসিস্ট অত্যন্ত কার্যকর। বিশেষ করে শহুরে রাস্তায়, যেখানে শিশু, রিকশা বা বাইক হঠাৎ সামনে চলে আসার ঘটনা অহরহ ঘটে, এই সিস্টেম স্টপিং দূরত্ব কমিয়ে আনে এবং দুর্ঘটনা রোধে সহায়ক হয়। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপঞ্জ (BRTA) এর সচেতনতামূলক প্রচারণায় জরুরি ব্রেকিংয়ের সঠিক কৌশলের পাশাপাশি ব্রেক অ্যাসিস্টের গুরুত্বও তুলে ধরা হয়।
- হিল স্টার্ট অ্যাসিস্ট (HSA) বা হিল হোল্ড কন্ট্রোল:
- কী কাজ করে: ঢালু রাস্তায় (উঠান বা নামান) ব্রেক ছেড়ে গিয়ার এনগেজ করে এক্সিলারেটর চাপানোর আগেই গাড়ি পিছনের দিকে বা সামনের দিকে হেলে যেতে পারে (রোল-ব্যাক বা রোল-ফরোয়ার্ড)। হিল স্টার্ট অ্যাসিস্ট ব্রেক চাপ ছাড়ার পরও কয়েক সেকেন্ডের জন্য স্বয়ংক্রিয়ভাবে ব্রেক চাপ ধরে রাখে, যতক্ষণ না আপনি ইচ্ছামতো গ্যাস দেন। এতে গাড়ি হেলে না গিয়ে স্থির থাকে।
- কেন গুরুত্বপূর্ণ: চট্টগ্রাম, সিলেট বা ঢাকার ধানমন্ডি, মগবাজার এলাকার মতো পাহাড়ি বা ঢালু রাস্তায় এই ফিচার অত্যন্ত সহায়ক, বিশেষ করে ম্যানুয়াল গাড়ি চালানোর সময়। এটি চালকের চাপ কমায় এবং ধাক্কা লাগার ঝুঁকি হ্রাস করে।
নিষ্ক্রিয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা: আঘাত কমানোর ডিজাইন জানুন বিস্তারিত
যখন সক্রিয় নিরাপত্তা সিস্টেমও দুর্ঘটনা ঠেকাতে ব্যর্থ হয়, তখনই কাজে আসে নিষ্ক্রিয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা (Passive Safety Systems)। এগুলো দুর্ঘটনার সময় এবং পরে যাত্রীদের আঘাতের তীব্রতা কমানোর জন্য ডিজাইন করা হয়।
সিট বেল্ট (Seat Belt) ও প্রি-টেনশনার:
- কী কাজ করে: সিট বেল্ট দুর্ঘটনার সময় চালক ও যাত্রীদের গাড়ির ভেতরে ধরে রাখে, যাতে তারা সামনের গ্লাস, ড্যাশবোর্ড বা স্টিয়ারিংয়ে ধাক্কা না খায় বা গাড়ি থেকে বেরিয়ে না যায়। আধুনিক সিট বেল্টে প্রি-টেনশনার থাকে। সংঘর্ষ শনাক্ত হওয়ার মুহূর্তেই এটি টাইট হয়ে যায়, যাত্রীকে সিটের সাথে শক্তভাবে বেঁধে ফেলে এবং আঘাতের আগেই শরীরের মুভমেন্ট সীমিত করে। অনেক গাড়িতে এখন ফোর্স লিমিটারও থাকে, যা অত্যধিক টান পড়লে সামান্য বেল্ট শিথিল করে বুকে আঘাতের ঝুঁকি কমায়।
- কেন গুরুত্বপূর্ণ: সিট বেল্টকে নিরাপত্তার সবচেয়ে মৌলিক এবং কার্যকর ফিচার হিসেবে বিবেচনা করা হয়। WHO এর মতে, সিট বেল্ট ব্যবহার চালকের মারাত্মক আঘাত এবং মৃত্যুর ঝুঁকি ৫০% পর্যন্ত কমাতে পারে। সামনের সিটের যাত্রীদের জন্য এটা ৪৫% পর্যন্ত কার্যকর। বাংলাদেশে সিট বেল্ট আইন থাকলেও এর ব্যবহার এখনও ব্যাপক নয়। আপনার শিশুটি যদি রিয়ার সিটে বসে থাকে, তাহলে চাইল্ড সিট লক না করা মানে তাকে মারাত্মক ঝুঁকিতে ফেলা। জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা পরিষদ নিরন্তর সিট বেল্ট ও চাইল্ড রেস্ট্রেইন্ট ব্যবহারের জন্য জনসচেতনতা তৈরি করছে।
- মর্মান্তিক সত্য: ঢাকা-চট্টগ্রাম বা ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে ঘটে যাওয়া অসংখ্য বাস দুর্ঘটনার পর্যালোচনায় দেখা গেছে, যেসব যাত্রী সিট বেল্ট পরেছিলেন না, তারাই বাস থেকে ছিটকে পড়ে সবচেয়ে মারাত্মক আঘাত পেয়েছেন বা নিহত হয়েছেন।
এয়ারব্যাগ (Airbags):
- কী কাজ করে: এয়ারব্যাগ সংঘর্ষের কয়েক মিলিসেকেন্ডের মধ্যে ফুলে ওঠে এবং চালক ও যাত্রীদের শরীরকে কঠিন ড্যাশবোর্ড, স্টিয়ারিং হুইল, ডোর প্যানেল বা উইন্ডস্ক্রিনে ধাক্কা খাওয়া থেকে রক্ষা করে। এটি মূলত সিট বেল্টের কার্যকারিতাকে সমর্থন করে, প্রতিস্থাপন করে না। বিভিন্ন ধরনের এয়ারব্যাগ আছে:
- ফ্রন্টাল এয়ারব্যাগ: ড্রাইভার এবং ফ্রন্ট প্যাসেঞ্জারের জন্য।
- সাইড এয়ারব্যাগ: সাইড ইমপ্যাক্ট থেকে বুক ও পেলভিস রক্ষা করে।
- কার্টেন/রিয়ার সাইড এয়ারব্যাগ: সাইড ইমপ্যাক্ট বা রোলওভারে মাথা রক্ষা করে।
- নী-এয়ারব্যাগ: লোয়ার লেগের আঘাত কমায়।
- পেডেস্ট্রিয়ান এয়ারব্যাগ: বনেটের উপর ফুলে উঠে পথচারীকে আঘাত কমাতে সাহায্য করে (কিছু আধুনিক গাড়িতে)।
- কেন গুরুত্বপূর্ণ: সঠিকভাবে কাজ করা এয়ারব্যাগ, সিট বেল্টের সাথে মিলে, মারাত্মক হেড ইনজুরি ৫০% পর্যন্ত কমাতে পারে। বাংলাদেশে যেখানে সাইড ইমপ্যাক্ট বা হেড-অন কলিশন প্রচুর ঘটে, সেখানে ফ্রন্ট এবং সাইড এয়ারব্যাগের উপস্থিতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মনে রাখবেন, এয়ারব্যাগ শুধু তখনই কার্যকরভাবে কাজ করবে যখন আপনি সিট বেল্ট পরেছেন। বেল্ট ছাড়া এয়ারব্যাগ নিজেই মারাত্মক আঘাতের কারণ হতে পারে।
- প্রযুক্তির বিবর্তন: আধুনিক এয়ারব্যাগ সিস্টেম (SRS – Supplemental Restraint System) সংঘর্ষের ধরন (ফ্রন্টাল, সাইড, রিয়ার, রোলওভার) এবং তীব্রতা সেন্সর করে। এটি নির্ধারণ করে কোন এয়ারব্যাগ বা এয়ারব্যাগগুলো ফুটানো হবে এবং কতটা জোরে ফুটানো হবে (মাল্টি-স্টেজ ডেপ্লয়মেন্ট)।
- কী কাজ করে: এয়ারব্যাগ সংঘর্ষের কয়েক মিলিসেকেন্ডের মধ্যে ফুলে ওঠে এবং চালক ও যাত্রীদের শরীরকে কঠিন ড্যাশবোর্ড, স্টিয়ারিং হুইল, ডোর প্যানেল বা উইন্ডস্ক্রিনে ধাক্কা খাওয়া থেকে রক্ষা করে। এটি মূলত সিট বেল্টের কার্যকারিতাকে সমর্থন করে, প্রতিস্থাপন করে না। বিভিন্ন ধরনের এয়ারব্যাগ আছে:
ক্রাম্পল জোন (Crumple Zones):
- কী কাজ করে: গাড়ির সামনে এবং পিছনের অংশ বিশেষভাবে ডিজাইন করা হয় যাতে সংঘর্ষের শক্তি শোষণ করতে পারে। এই অংশগুলো ইচ্ছাকৃতভাবে ভেঙে যায় বা ‘ক্রাম্পল’ হয়, যার ফলে যাত্রী কম্পার্টমেন্টে (যেখানে মানুষ বসে থাকে) প্রবেশ করা শক্তির পরিমাণ উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যায়। এটি মূলত একটি শক্তি শোষণকারী বাফার জোন।
- কেন গুরুত্বপূর্ণ: ক্রাম্পল জোন ছাড়া সংঘর্ষের পুরো শক্তি সরাসরি যাত্রী কম্পার্টমেন্টে চলে যায়, যার ফলাফল মারাত্মক আঘাত বা মৃত্যু হতে পারে। একটি ভালো ক্রাম্পল জোন ডিজাইন যাত্রী কম্পার্টমেন্টের অখণ্ডতা বজায় রেখে সংঘর্ষের শক্তিকে শোষণ করে নেয়। ঢাকার ব্যস্ত সড়কে সামনে বা পেছন থেকে ধাক্কা লাগার ঘটনা প্রায়ই ঘটে – এই ধরনের নিম্নগতির সংঘর্ষেও ক্রাম্পল জোন যাত্রীদের আঘাত কমাতে সাহায্য করে।
সেফটি সেল/রিগিড কেজ (Safety Cell/Rigid Cage):
- কী কাজ করে: ক্রাম্পল জোনের বিপরীতে, যাত্রী কম্পার্টমেন্ট (সেল) যতটা সম্ভব শক্ত এবং বিকৃতিরোধী (Rigid) করে তৈরি করা হয়। এটি উচ্চ-শক্তির ইস্পাত দিয়ে নির্মিত একটি কাঠামো, যার উদ্দেশ্য সংঘর্ষের সময় যাত্রীদের জন্য একটি ‘সুরক্ষিত জোন’ তৈরি করা এবং তাদের ওপর চাপা পড়া বা কম্পার্টমেন্ট ভেঙে যাওয়া রোধ করা।
- কেন গুরুত্বপূর্ণ: রোলওভার বা ভয়াবহ সংঘর্ষে গাড়ির ছাদ বা দরজা ভেঙে যাত্রীদের ওপর চাপা পড়ার ঘটনা ঘটতে পারে। একটি শক্তিশালী সেফটি সেল যাত্রীদের বেঁচে থাকার জায়গা নিশ্চিত করে। গ্লোবাল NCAP এর ক্র্যাশ টেস্টে মূলত এই সেলের অখণ্ডতা এবং সিট বেল্ট ও এয়ারব্যাগের কার্যকারিতাই মূল্যায়ন করা হয়।
- হেড রেস্ট্রেইন্টস (Head Restraints):
- কী কাজ করে: অনেকেই মনে করেন হেড রেস্ট শুধু আরামের জন্য। কিন্তু এর মূল কাজ হলো হুইপল্যাশ (Whiplash) ইনজুরি রোধ করা। রিয়ার-এন্ড কলিশনে গাড়ি হঠাৎ সামনের দিকে ধাক্কা খেলে, যাত্রীর শরীর সিটের সাথে সামনে যায় কিন্তু মাথা কিছুটা পিছনে থাকে, তারপর দ্রুত সামনে আসে – এই আকস্মিক ঝাঁকুনিতে ঘাড়ের মাংসপেশি, লিগামেন্ট বা ভার্টিব্রায় আঘাত লাগে, যা হুইপল্যাশ ইনজুরি। সঠিকভাবে সেট করা (মাথার পেছনের মাঝামাঝি উচ্চতায় এবং যতটা সম্ভব কাছাকাছি) হেড রেস্ট্রেইন্ট এই ঝাঁকুনিতে মাথাকে সাপোর্ট দেয় এবং হুইপল্যাশের ঝুঁকি কমায়।
- কেন গুরুত্বপূর্ণ: হুইপল্যাশ ইনজুরি প্রায়ই দীর্ঘমেয়াদী ব্যথা, ঘাড় শক্ত হওয়া এবং মাথাব্যথার কারণ হয়। বাংলাদেশে ট্রাফিক জ্যামে পেছন থেকে ধাক্কা লাগার ঘটনা খুবই সাধারণ। সঠিক হেড রেস্ট্রেইন্ট এই সাধারণ দুর্ঘটনার পরিণতিও কমাতে পারে।
নতুন যুগের সুরক্ষা: অ্যাডভান্সড ড্রাইভার অ্যাসিস্ট্যান্স সিস্টেম (ADAS) জানুন বিস্তারিত
প্রযুক্তির অগ্রগতির সাথে সাথে গাড়ির নিরাপত্তা ফিচার এর ধারণাও পাল্টেছে। ADAS হলো সেইসব সেমি-অটোনোমাস বা অ্যাসিস্টিভ প্রযুক্তির সমষ্টি যা চালককে নিরাপদে গাড়ি চালাতে সাহায্য করে এবং ক্রমশ দুর্ঘটনার ঝুঁকিকে শূন্যের কাছাকাছি নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে কাজ করছে। এসব সিস্টেম সাধারণত ক্যামেরা, রাডার, আল্ট্রাসনিক সেন্সর এবং লিডার ব্যবহার করে চারপাশের পরিবেশ পর্যবেক্ষণ করে।
অ্যাডাপ্টিভ ক্রুজ কন্ট্রোল (ACC):
- কী কাজ করে: সাধারণ ক্রুজ কন্ট্রোল গাড়িকে একটি নির্দিষ্ট গতিতে চালায়। ACC তার চেয়ে এগিয়ে। এটি রাডার বা ক্যামেরার সাহায্যে আপনার গাড়ির সামনে চলমান গাড়ির দূরত্ব এবং গতি মাপে। আপনার সেট করা গতির সীমার মধ্যে থেকেই এটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে গতি বাড়ায়-কমায় এবং নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখে। সামনের গাড়ি থেমে গেলে ACC আপনার গাড়িকেও থামিয়ে দিতে পারে এবং আবার চলতে শুরু করলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে তাকে ফলো করতে পারে।
- কেন গুরুত্বপূর্ণ: বাংলাদেশের হাইওয়েতে দীর্ঘ ভ্রমণে ACC চালকের ক্লান্তি অনেকাংশে কমায়। এটি রিয়ার-এন্ড কলিশনের ঝুঁকিও কমিয়ে দেয়, বিশেষ করে যখন সামনের গাড়ি হঠাৎ ব্রেক করে। ঢাকা-চট্টগ্রাম বা ঢাকা-ময়মনসিংহ এক্সপ্রেসওয়ের মতো লম্বা রুটে এটি খুবই উপকারী।
ফরওয়ার্ড কলিশন ওয়ার্নিং (FCW) ও অটোনোমাস ইমার্জেন্সি ব্রেকিং (AEB):
- কী কাজ করে: FCW সিস্টেম সেন্সর ব্যবহার করে সামনের গাড়ি, পথচারী বা বাধার দূরত্ব ও আপেক্ষিক গতি মেপে সম্ভাব্য সংঘর্ষের পূর্বাভাস দেয়। এটি সাধারণত ড্যাশবোর্ডে ভিজুয়াল সতর্কতা, শব্দ সংকেত বা স্টিয়ারিং/সিটের কম্পনের মাধ্যমে চালককে সতর্ক করে। AEB সিস্টেম আরও একধাপ এগিয়ে। যদি চালক সতর্কতা সত্ত্বেও যথাসময়ে ব্রেক না করে, তাহলে AEB স্বয়ংক্রিয়ভাবে ব্রেক প্রয়োগ করে সংঘর্ষ এড়াতে বা সংঘর্ষের তীব্রতা কমাতে সাহায্য করে।
- কেন গুরুত্বপূর্ণ: শহুরে রাস্তায় অমনোযোগিতা, ক্লান্তি বা দৃষ্টিসীমার বাইরে থেকে হঠাৎ কেউ (বিশেষ করে শিশু) রাস্তায় চলে এলে FCW এবং AEB জীবন বাঁচাতে পারে। ইউরো NCAP এর মতে, AEB প্রযুক্তি সামনের গাড়ির সাথে রিয়ার-এন্ড কলিশন ৩৮% পর্যন্ত কমাতে পারে। পথচারীদের সাথে সংঘর্ষের ঝুঁকিও এটি উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস করে। বাংলাদেশের ব্যস্ত ও অনিয়ন্ত্রিত ট্রাফিক পরিবেশে এই ফিচার অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক।
লেন ডিপার্চার ওয়ার্নিং (LDW) ও লেন কিপিং অ্যাসিস্ট (LKA):
- কী কাজ করে: LDW ক্যামেরা দিয়ে রাস্তার লাইন চিহ্নিত করে। ইঙ্গিত ছাড়াই (ব্লিঙ্কার না জ্বালিয়ে) গাড়ি যখন লাইন ক্রস করে অন্য লেনে চলে যেতে থাকে, তখন LDW সিস্টেম শব্দ, ভিজুয়াল বা ভাইব্রেশন অ্যালার্টের মাধ্যমে চালককে সতর্ক করে। LKA সিস্টেম আরও সক্রিয়ভাবে কাজ করে। গাড়ি লাইন ক্রস করলে এটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে স্টিয়ারিংয়ে হালকা টর্ক প্রয়োগ করে গাড়িকে তার নিজ লেনে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করে।
- কেন গুরুত্বপূর্ণ: দীর্ঘ ভ্রমণে ক্লান্তিতে বা অমনোযোগিতায় গাড়ি লেন ছেড়ে বিপরীত লেনে চলে যাওয়া বা রাস্তার পাশে ড্রেন/ডাইভাইডারে ধাক্কা লাগার ঝুঁকি তৈরি হয়। বাংলাদেশের অনেক মহাসড়কে লেন ডিসিপ্লিনের অভাব আছে। LDW এবং LKA এই ধরনের একক গাড়ি দুর্ঘটনা রোধে কার্যকর ভূমিকা রাখে। বিশেষ করে রাতে বা বৃষ্টির সময় দৃষ্টি সীমিত হলে এই সিস্টেমের গুরুত্ব আরও বেড়ে যায়।
ব্লাইন্ড স্পট মনিটরিং (BSM) / ব্লাইন্ড স্পট ডিটেকশন (BSD):
- কী কাজ করে: গাড়ির পাশের এবং পেছনের কিছু অংশ চালকের সরাসরি দৃষ্টিসীমার বাইরে থাকে, যাকে ব্লাইন্ড স্পট বলে। BSM সিস্টেম সাধারণত রিয়ার বাম্পারে লাগানো রাডার সেন্সর ব্যবহার করে এই ব্লাইন্ড স্পটে অন্য গাড়ি বা বাইকের উপস্থিতি শনাক্ত করে। সিগন্যাল দিলে (সাইড মিরর বা ডোর পিলারে LED জ্বলে ওঠার মাধ্যমে) এটি চালককে সতর্ক করে।
- কেন গুরুত্বপূর্ণ: বাংলাদেশে মোটরসাইকেল, থ্রি-হুইলার (ইজিবাইক, অটোরিকশা) এবং অন্যান্য যানবাহনের ভিড়ে লেন পরিবর্তন বা ওভারটেক করা ঝুঁকিপূর্ণ। BSM এই বিপদজনক ম্যানুভারের সময় পাশে বা পেছনে আসা যান সম্পর্কে সময়মতো সতর্ক করে দুর্ঘটনার ঝুঁকি কমায়। ঢাকার মত শহরে যেখানে বাইক ও অটোরিকশা সর্বত্র, এই ফিচার অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।
- রিয়ার ক্রস ট্রাফিক অ্যালার্ট (RCTA):
- কী কাজ করে: রিভার্স গিয়ারে থাকাকালীন, RCTA সিস্টেম (সাধারণত BSM এর সেন্সরই ব্যবহার করে) গাড়ির পেছন দিকের দুই পাশ থেকে আসা যানবাহন (যেমন পার্কিং লট বা গলি থেকে বের হওয়ার সময়) শনাক্ত করে। এটি চালককে শব্দ ও ভিজুয়াল সতর্কবার্তা দিয়ে সতর্ক করে।
- কেন গুরুত্বপূর্ণ: বাংলাদেশের শহরগুলোর রাস্তা ও গলি খুবই সরু এবং দৃষ্টিসীমা সীমিত। ব্যাক আপ করার সময়, বিশেষ করে পার্কিং এরিয়া বা বাসা থেকে গাড়ি বের করার সময় পেছন থেকে আসা গাড়ি, বাইক বা পথচারী দেখা যায় না। RCTA এই ধরনের সংঘর্ষ প্রতিরোধে সহায়ক।
আপনার গাড়ির নিরাপত্তা ফিচার: বাছাই, রক্ষণাবেক্ষণ এবং সচেতনতা
এতসব নিরাপত্তা ফিচার এর কথা জেনে এখন প্রশ্ন আসে, আপনার গাড়িতে কী কী ফিচার থাকা উচিত? এবং সেগুলো কীভাবে ঠিকঠাক রাখবেন?
- কেনার আগে নিরাপত্তা রেটিং চেক করুন: গাড়ি কেনার সময় শুধু দাম, লুক্সারি বা ফুয়েল এফিশিয়েন্সি দেখবেন না। অবশ্যই গ্লোবাল NCAP বা ASEAN NCAP এর নিরাপত্তা রেটিং (স্টার রেটিং) চেক করুন। ৪ বা ৫ স্টার রেটেড গাড়িগুলোতে প্রয়োজনীয় নিষ্ক্রিয় নিরাপত্তা ফিচার (স্ট্রং সেল, মাল্টিপল এয়ারব্যাগ, ভালো ক্রাম্পল জোন) এবং প্রায়ই কিছু সক্রিয় নিরাপত্তা ফিচার (ABS, ESC) স্ট্যান্ডার্ড থাকে। বাংলাদেশে বিক্রি হওয়া জনপ্রিয় কিছু হ্যাচব্যাক, সেডান এবং SUV-তে এখন ৪-৫ স্টার রেটিং পাওয়া যায়।
- প্রয়োজনীয় মিনিমাম ফিচার: বাংলাদেশের রাস্তার বাস্তবতায় নিম্নলিখিত ফিচারগুলো অত্যাবশ্যক বলে আমি মনে করি:
- সিট বেল্ট (সব আসনে): সাথে প্রি-টেনশনার ও ফোর্স লিমিটার থাকলে ভালো।
- এয়ারব্যাগ: অন্তত ড্রাইভার এবং ফ্রন্ট প্যাসেঞ্জার ফ্রন্টাল এয়ারব্যাগ। সাইড/কার্টেন এয়ারব্যাগ থাকলে আরও ভালো।
- ABS: পিচ্ছিল রাস্তায় নিয়ন্ত্রণ রক্ষার জন্য।
- ESC: স্থিতিশীলতা রক্ষার জন্য, বিশেষ করে উচ্চগতিতে বা বাঁক নেওয়ার সময়।
- ব্রেক অ্যাসিস্ট: জরুরি ব্রেকিংয়ে কার্যকারিতা বাড়াতে।
- হেড রেস্ট্রেইন্ট (সব আসনে): হুইপল্যাশ প্রতিরোধের জন্য।
- আপগ্রেডেড নিরাপত্তার জন্য ADAS: আপনার বাজেট অনুমতি দিলে, ADAS ফিচার যেমন ACC, FCW, AEB, LDW, LKA, BSM, RCTA নিরাপত্তাকে আরেক ধাপ এগিয়ে নেবে। বিশেষ করে যারা নিয়মিত হাইওয়ে ভ্রমণ করেন বা শহরের ব্যস্ত রাস্তায় গাড়ি চালান, তাদের জন্য এগুলো অমূল্য।
- রক্ষণাবেক্ষণই নিরাপত্তা: নিরাপত্তা ফিচারগুলো যান্ত্রিক ও ইলেকট্রনিক সিস্টেম। এদের সঠিকভাবে কাজ করার জন্য নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ জরুরি।
- সার্ভিসিং: ম্যানুফ্যাকচারারের নির্দেশিত সময়ে গাড়ি সার্ভিসিং করুন। বিশেষ করে ব্রেক সিস্টেম (ABS, BA এর সাথে সম্পর্কিত), সেন্সর এবং ইলেকট্রনিক কন্ট্রোল ইউনিট (ESC, TCS, ADAS এর জন্য) ঠিক আছে কিনা চেক করান।
- এয়ারব্যাগ চেক: এয়ারব্যাগ সিস্টেমের ওয়ার্নিং লাইট জ্বললে অবিলম্বে অথরাইজড সার্ভিস সেন্টারে দেখান। নিজে এয়ারব্যাগের সামনে কোনো কিছু বসাবেন না বা সিস্টেমে হাত দেবেন না।
- সেন্সর পরিষ্কার রাখা: ADAS সিস্টেমের ক্যামেরা, রাডার সেন্সরগুলো পরিষ্কার রাখুন। ধুলা, কাদা বা তুষার সেন্সরের কার্যকারিতা ব্যাহত করতে পারে।
- সিট বেল্ট ও এনক্রিশন পয়েন্ট: সিট বেল্ট টানলে স্মুথলি লক হয় কিনা, রিট্র্যাক্ট করে কিনা চেক করুন। কোনো সংঘর্ষের পর সিট বেল্ট ও প্রি-টেনশনার রিপ্লেস করানো প্রয়োজন হতে পারে।
- চালকের সচেতনতা: সবচেয়ে বড় নিরাপত্তা ফিচার হলো একজন সচেতন, দক্ষ এবং দায়িত্বশীল চালক। কোনো প্রযুক্তিই বেপরোয়া ড্রাইভিং, ওভারস্পিডিং, মোবাইল ফোন ব্যবহার বা মদ্যপ অবস্থায় গাড়ি চালানোর ঝুঁকি পুরোপুরি দূর করতে পারে না। নিরাপত্তা ফিচারগুলোকে সহায়ক হিসেবে ভাবুন, প্রতিস্থাপন হিসেবে নয়। সর্বদা ডিফেন্সিভ ড্রাইভিং অনুশীলন করুন।
গাড়ির নিরাপত্তা ফিচার কোনো বিলাসিতা নয়; এগুলো প্রয়োজনীয় জীবন রক্ষাকারী সরঞ্জাম। প্রতিটি ব্রেক, প্রতিটি এয়ারব্যাগ, প্রতিটি সতর্ক সংকেত আপনার এবং আপনার প্রিয়জনের অমূল্য জীবনকে সুরক্ষিত রাখার জন্য এক একটি প্রতিজ্ঞা। বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান যানবাহনের ভিড় এবং দুর্ঘটনার মর্মান্তিক পরিসংখ্যান আমাদের বারবার স্মরণ করিয়ে দেয় – নিরাপত্তাকে অবহেলা করার কোনো সুযোগ নেই। আপনার পরবর্তী গাড়ি কেনার আগে, বা আপনার বর্তমান গাড়ির সক্ষমতা জানার জন্য, সময় নিয়ে এর নিরাপত্তা ফিচার গুলো বিস্তারিত ভাবে জানুন। ব্রোশার পড়ুন, ডিলারশিপে জিজ্ঞাসা করুন, অনলাইনে রিভিউ ও ক্র্যাশ টেস্ট রেজাল্ট দেখুন। মনে রাখবেন, একটি নিরাপদ গাড়ি শুধু যন্ত্রপাতির সমষ্টি নয়; সেটি আপনার পরিবারের জন্য একটি চলন্ত সুরক্ষিত আশ্রয়স্থল। আজই আপনার গাড়ির নিরাপত্তা ফিচারগুলো চেক করুন, তাদের রক্ষণাবেক্ষণ নিশ্চিত করুন, এবং সর্বোপরি, একজন দায়িত্বশীল চালক হিসেবে নিরাপদ ড্রাইভিং চর্চা করুন। আপনার একটু সচেতনতাই পারে একটি প্রাণ বাঁচাতে, একটি পরিবারকে অশ্রু থেকে রক্ষা করতে।
জেনে রাখুন (FAQs)
গাড়ির নিরাপত্তা ফিচার গুলোর মধ্যে কোনটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ?
সিট বেল্টকে প্রায় সব বিশেষজ্ঞই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও মৌলিক নিরাপত্তা ফিচার হিসেবে স্বীকৃতি দেন। এটি দুর্ঘটনায় মারাত্মক আঘাত ও মৃত্যুর ঝুঁকি উল্লেখযোগ্যভাবে কমায় (৫০% পর্যন্ত)। এটি এয়ারব্যাগসহ অন্যান্য সকল নিরাপত্তা ব্যবস্থার কার্যকারিতার ভিত্তি। সিট বেল্ট ছাড়া এয়ারব্যাগ নিজেও বিপজ্জনক হতে পারে। তাই প্রতিটি যাত্রার শুরুতে, প্রতিটি আসনে বসে সিট বেল্ট পরা অপরিহার্য।এডাপ্টিভ ক্রুজ কন্ট্রোল (ACC) কি বাংলাদেশের রাস্তায় ব্যবহারের জন্য উপযোগী?
হ্যাঁ, তবে কিছু সীমাবদ্ধতা সাথেই। ACC হাইওয়েতে দীর্ঘ ভ্রমণের সময় চালকের ক্লান্তি কমাতে এবং নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখতে খুবই কার্যকর, বিশেষ করে ঢাকা-চট্টগ্রাম বা ঢাকা-ময়মনসিংহ এক্সপ্রেসওয়ের মতো রাস্তায়। তবে, বাংলাদেশের শহুরে রাস্তায়, যেখানে যানজট, অনিয়মিত লেন পরিবর্তন, রিকশা-বাইকের আনাগোনা বেশি, সেখানে ACC এর কার্যকারিতা সীমিত হতে পারে। চালককে সর্বদা মনোযোগ সহকারে সিস্টেমকে মনিটর করতে হবে এবং প্রয়োজনে হস্তক্ষেপ করতে প্রস্তুত থাকতে হবে।পুরনো গাড়িতে কি আধুনিক নিরাপত্তা ফিচার (যেমন ESC বা AEB) যুক্ত করা সম্ভব?
দুর্ভাগ্যবশত, সক্রিয় নিরাপত্তা ফিচার যেমন ESC, AEB, লেন কিপিং অ্যাসিস্ট ইত্যাদি জটিল ইলেকট্রনিক ও মেকানিক্যাল সিস্টেমের সমন্বয়ে কাজ করে, যা গাড়ির মূল ডিজাইনের সাথে গভীরভাবে সংযুক্ত। এগুলো সাধারণত পুরনো গাড়িতে রেট্রোফিট বা পরে লাগানো প্রায় অসম্ভব এবং অত্যন্ত ব্যয়বহুল। নিষ্ক্রিয় নিরাপত্তার ক্ষেত্রে, কিছু মৌলিক ফিচার (যেমন অতিরিক্ত এয়ারব্যাগ – যদি গাড়ির ডিজাইন অনুমতি দেয় এবং প্রফেশনালি ইনস্টল করা যায়, কুয়ালিটি চাইল্ড সিট) যুক্ত করা সম্ভব হতে পারে। তবে সর্বোত্তম নিরাপত্তার জন্য আধুনিক নিরাপত্তা স্ট্যান্ডার্ড মেনে তৈরি নতুন বা কম ব্যবহৃত গাড়ি বেছে নেওয়াই ভালো।নিরাপত্তা ফিচার থাকলেও দুর্ঘটনা কেন ঘটে?
নিরাপত্তা ফিচারগুলো দুর্ঘটনার ঝুঁকি এবং ঘটে গেলে আঘাতের তীব্রতা কমাতে ডিজাইন করা হয়েছে, এগুলো দুর্ঘটনা ঘটবেই না তার গ্যারান্টি দেয় না। বেপরোয়া ড্রাইভিং (অতিরিক্ত গতি, মদ্যপ অবস্থায় গাড়ি চালানো), চালকের ভুল (মনোযোগের অভাব, ফোন ব্যবহার), রাস্তার খারাপ অবস্থা, যান্ত্রিক ত্রুটি (নিরাপত্তা ফিচার ঠিক আছে কিনা তার রক্ষণাবেক্ষণ না করা), বা অন্যান্য বাহ্যিক কারণ (অনিয়ন্ত্রিত অন্যান্য যান) দুর্ঘটনার কারণ হতে পারে। নিরাপত্তা ফিচার সর্বোচ্চ কার্যকর তখনই যখন একজন দায়িত্বশীল চালক নিরাপদ ড্রাইভিং প্র্যাকটিস অনুসরণ করেন।বাচ্চাদের জন্য সবচেয়ে নিরাপদ আসন কোথায় এবং কোন ফিচার গুরুত্বপূর্ণ?
বাচ্চাদের জন্য সবচেয়ে নিরাপদ আসন হলো গাড়ির রিয়ার সিট। বিশেষ করে রিয়ার সিটের মাঝখানের আসনটিকে প্রায়শই সবচেয়ে নিরাপদ মনে করা হয়, কারণ এটি সাইড ইমপ্যাক্ট থেকে সবচেয়ে দূরে থাকে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ফিচার হলো বাচ্চার বয়স, ওজন ও উচ্চতা অনুযায়ী সঠিক মানের চাইল্ড সিট বা বূস্টার সিট এবং সেটির সঠিক ইনস্টলেশন ও ব্যবহার। নিশ্চিত করুন বাচ্চা সিট বেল্ট বা হারনেসে সঠিকভাবে বাঁধা আছে। রিয়ার এয়ারব্যাগ (যদি থাকে) সক্রিয় থাকলে, রিয়ার-ফেসিং চাইল্ড সিট সামনের সিটে বসানো উচিত নয়। সর্বদা গাড়ির ম্যানুয়াল এবং চাইল্ড সিটের নির্দেশিকা অনুসরণ করুন।- গাড়ির নিরাপত্তা ফিচার সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য কোথায় পেতে পারি?
- গাড়ির মালিকানার ম্যানুয়াল: আপনার গাড়ির নির্দিষ্ট মডেলের নিরাপত্তা ফিচার, তাদের কাজ করার পদ্ধতি এবং রক্ষণাবেক্ষণ সংক্রান্ত বিস্তারিত তথ্যের জন্য এটি সর্বোত্তম উৎস।
- নির্মাতার ওয়েবসাইট: গাড়ি কোম্পানিগুলো তাদের ওয়েবসাইটে বিভিন্ন মডেলের নিরাপত্তা ফিচারের বিস্তারিত বর্ণনা এবং ভিডিও ডেমো প্রদান করে।
- স্বাধীন নিরাপত্তা সংস্থা: Global New Car Assessment Programme (Global NCAP – https://www.globalncap.org/), ASEAN NCAP (https://www.aseancap.org/) এর ওয়েবসাইটে বিভিন্ন গাড়ির ক্র্যাশ টেস্ট রেজাল্ট এবং স্টার রেটিং দেখতে পারবেন, যা নিরাপত্তা ফিচারের কার্যকারিতার সরাসরি প্রমাণ।
- বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপঞ্জ (BRTA): (https://www.brta.gov.bd/) সড়ক নিরাপত্তা ও যানবাহন নীতিমালা সংক্রান্ত তথ্য পেতে পারেন।
- নির্ভরযোগ্য অটোমোটিভ রিভিউ ওয়েবসাইট/ম্যাগাজিন: দেশি-বিদেশি বিশ্বস্ত অটোমোটিভ মিডিয়া গাড়ির নিরাপত্তা ফিচার নিয়ে গভীর পর্যালোচনা করে থাকে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।