সাইফুল ইসলাম, মানিকগঞ্জ : তীব্র গ্যাস সঙ্কটে দিশেহারা হয়ে পড়েছে মানিকগঞ্জের তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির ১২ হাজারের বেশী আবাসিক গ্রাহকেরা। দীর্ঘদিন ধরে চলমান এ গ্যাস সঙ্কটে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে নিম্ন আয়ের সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবন। মানিকগঞ্জে আবাসিক গ্রাহকদের দিনের পর দিন গ্যাস না মিললেও মাস শেষ হলেই বিল পরিশোধ করতে হচ্ছে প্রায় আড়াই কোটি টাকা।
তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির মানিকগঞ্জ আঞ্চলিক কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, মানিকগঞ্জে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির ১২ হাজার ১০২ জন সাধারণ আবাসিক গ্রাহক, ৩৯ টি মিটার যুক্ত আবাসিক গ্রাহক, ২৯টি বাণিজ্যিক, ৪৩টি শিল্প, ৩২টি ক্যাপটিক পাওয়ার, ও ১৮টি সিএনজি ফিলিং স্টেশনে গ্যাস-সংযোগ রয়েছে। এসব আবাসিক গ্রাহকের সাড়ে ২৪ হাজারের বেশি চুলার মধ্যে মধ্যে দুই চুলার সংখ্যা প্রায় সাড়ে ২৩ হাজার এবং বাকিগুলো এক চুলা। যার জন্য প্রতিমাসে বিল পরিশোধ করতে হয় প্রায় আড়াই কোটি টাকা। এছাড়া বাণিজ্যিক, শিল্প ও অন্যান্য মিলে আরো ৪ কোটি টাকাসহ মোট বিল আসে প্রায় সাড়ে ৬ কোটি টাকা। তিতাস গ্যাসের আবাসিক গ্রাহক ব্যতিত বাণিজ্যিক, শিল্প ও অন্যান্য গ্রাহকদের ব্যবহারের উপর বিল পরিশোধ করা লাগলেও আবাসিক গ্রাহকদের ক্ষেত্রে গ্যাস ব্যবহার না করলেও মাস শেষে বিল পরিশোধ করতে হয়।
আরো জানা গেছে, ঢাকার সাভারের আশুলিয়া থেকে সঞ্চালন পাইপের মাধ্যমে মানিকগঞ্জে গ্যাস সরবরাহ করা হয়। আশুলিয়া, সাভার ও ধামরাইয়ে চাহিদা মেটানোর পর গ্যাস মানিকগঞ্জে সরবরাহ করা হয়। ওই এলাকার বিভিন্ন কারখানায় গ্যাসের চাহিদা বেশি থাকায় এই লাইনের গ্যাস মানিকগঞ্জ আসার আগেই অধিকাংশ গ্যাসই ব্যবহৃত হয়ে যায়। এজন্য মানিকগঞ্জে গ্যাসের চাপ কম।
গত এক মাস ধরে বিভিন্ন সময়ে মানিকগঞ্জ জেলা শহরের বিভিন্ন এলাকায় সরেজমিনে দেখা যায়, জেলা শহরের বিভিন্ন বাসাবাড়িতে সিলিন্ডার গ্যাসে রান্না করছেন গৃহিনীরা। যেসব পরিবারের সিলিন্ডার কেনার সামর্থ্য নেই তাদের লাকড়ির চুলায় রান্না করতে দেখা যায়। এছাড়া, সিএনজি ফিলিং স্টেশনে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ রয়েছে। এতে সিএনজি চালিত যানবাহন মালিক-শ্রমিক ও সাধারণ যাত্রীদের চরম ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। গ্যাস সরবরাহ বন্ধ থাকায় অচল হয়ে গেছে গ্যাসনির্ভর অনেক শিল্প-কারখানা। তবে সপ্তাহের নির্দিষ্ট দিনে ভোর ৩টা-৪টার দিকে গ্যাসের দেখা মিললেও দুই তিন ঘণ্টার মধ্যে আবার চলে যায়।
বান্দুটিয়া এলাকার রিকশা চালক মিন্টু মিয়া বলেন, আমি ভাড়া বাসায় থাকি। সে বাসায় গ্যাসের লাইন ফিট করা আছে, কিন্ত গ্যাস থাকেনা। কিন্ত মাস শেষ হলেই গ্যাসের বিল দিতে হয়। আবার বার-তের শ’ টাকা খরচ করে গ্যাসের সিলিন্ডারও কিনতে হয়। এত খরচ হলে আমরা চলবো কিভাবে?
ফাতেমা নামের এক গৃহবধূ বলেন, দীর্ঘ দিন ধরেই তো লাইনের গ্যাস নাই। এ সমস্যা তো দীর্ঘ দিন ধরেই চলতেছে, কবে ঠিক হবে জানি না। জানুয়ারী মাসে লাইনের গ্যাস দিয়ে এক কাপ চা ও বানাতে পারিনি। মাস শেষে বিল তো ঠিকই নেয়। এটা আমাদের মত সাধারণ মানুষের উপর এক প্রকার জুলুম।
নাহিদুল ইসলাম নামের এক বেসরকারি চাকুরিজীবি বলেন, আমি অল্প বেতনে চাকরি করি। স্ত্রী সন্তান নিয়ে ভাড়া থাকি। এখন সংসার চালানোই কঠিন হয়ে পড়েছে। গ্যাসের বিল তো ঠিক মতই দেই, কিন্তু গ্যাস তো পাই না।
সিএনজি চালিত অটোরিক্সা চালক মোঃ রুবেল হোসেন বলেন, টাঙ্গাইল অথবা হেমায়েতপুর গিয়ে গ্যাস আনতে হয়। গ্যাস আনতে যাওয়া আসার পথেই অর্ধেক গ্যাস শেষ হয়ে যায়। গ্যাস সঙ্কটের কারণে অনেকেই গাড়ি চালানো বন্ধ করে দিয়েছে।
মেসার্স গুডলাক সিএনজি ফিলিং স্টেশনের মালিক মোঃ সিরাজুল ইসলাম বলেন, শেষ রাতের দিকে দেড়-দুই ঘন্টা গ্যাস থাকে। গ্যাসের চাপ নেই বললেই চলে। গ্যাসের ঘনত্ব কম থাকায় কাস্টমারের মাইলেজ কম হয়। যে কারণে গাড়ি চালক, সাধারণ যাত্রী ও আমাদের অনেক ক্ষতি হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে স্টেশনটি বন্ধ করা ছাড়া উপায় নেই।
গ্যাস সঙ্কটের কারণে শিল্প কারখানার কোন ক্ষতি হচ্ছে কি’না জানতে চাইলে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) মানিকগঞ্জ জেলা কার্যালয়ের উপ-ব্যবস্থাপক মোঃ মাহবুবুল ইসলাম বলেন, গ্যাস সঙ্কটের কারণে ইতোমধ্যে মানিকগঞ্জের অনেক শিল্প কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। বর্তমানে বিসিক এলাকায় গ্যাস নির্ভর কোন শিল কারখানা নেই। এছাড়া মানিকগঞ্জে গ্যাসের তীব্র সঙ্কট থাকায় নতুন করে কোন শিল্প কারখানা তৈরি হচ্ছেনা। বিসিক এলাকায় তিতাস গ্যাসের সাব স্টেশন নির্মাণ করা হলেও এখানে গ্যাস সাপ্লাই নেই।
মানিকগঞ্জ পৌরসভার মেয়র মোঃ রমজান আলী বলেন, মানিকগঞ্জে দীর্ঘ দিন ধরেই গ্যাসের সঙ্কট চলছে। গ্যাসের সঙ্কট নিয়ে এর আগে আমরা আন্দোলন সংগ্রামও করেছি। এ নিয়ে মামলা-হামলার শিকারও হয়েছি। গ্যাস না দিয়ে মাসে মাসে যে বিল নেওয়া হচ্ছে এতে জনগণের উপর জুলুম করা হচ্ছে। গ্যাস না দিয়ে বিল নেয়ার ফলে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হচ্ছে।
এ ব্যাপারে মানিকগঞ্জ জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ আব্দুল লতিফ বলেন, গ্যাস সঙ্কটের বিষয়ে আমরা তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছি। এরপর মাঝখানে গ্যাসের সঙ্কট কিছুটা কম ছিল। গ্যাস সঙ্কটের বিষয়ে তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, এ সমস্যা দূর করতে তারা বিকল্প ব্যবস্থা নিচ্ছে। তবে গ্যাস সরবরাহ না থাকলেও বিল নেওয়ার বিষয়টা তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ বলতে পারবে।
এ বিষয়ে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির মানিকগঞ্জ আঞ্চলিক কার্যালয়ের ব্যবস্থাপক প্রকৌশলী হাদী মোহাম্মদ আব্দুর রহিম বলেন, মানিকগঞ্জে গ্যাসের সমস্যা আছে এটা ঠিক আছে। তবে গ্যাস বিলের বিষয়টা সরকারি নিয়ম। বিলের বিষয়ে আমার কিছু করার নেই। তবে গ্যাস সঙ্কটের যে সমস্যা আছে সেটা সমাধান করতে আমাদের চেষ্টা অব্যাহত আছে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।