রফিকুল ইসলাম সেলিম : জঙ্গল সলিমপুর। থ্রিলার সিনেমার মতোই যেখানে সবকিছুর নিয়ন্ত্রণ অপরাধীদের হাতে। পাহাড়, টিলা, সবুজ অরণ্য ঘেরা পুরো এলাকা সন্ত্রাসের এক ভয়াল জনপদ। পেশাদার অপরাধী, ভয়ঙ্কর ভূমিদস্যুরা নির্বিচারে পাহাড়-টিলা, সবুজ বন বনানী উজাড় করে দখলে নেয় হাজার হাজার একর সরকারি খাস জমি। ওই জমি সাধারণ মানুষের কাছে বিক্রি করে হাতিয়ে নেয় কোটি কোটি টাকা। দখলদারেরা সেখানে অঘোষিত রাজা বনে যায়। চট্টগ্রাম মহানগরীর অতি কাছে হয়েও দীর্ঘ তিন দশক ধরে এই এলাকায় ছিল না প্রশাসনের কোন নিয়ন্ত্রণ। সেখানে অপরাধীদের কথায় চলত সবকিছু।
অবশেষে সেই ‘মগের মুল্লুক’ নিজেদের দখলে আনার উদ্যোগ নিয়েছে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসন। জঙ্গল সলিমপুরকে ঘিরে নেয়া হয়েছে উন্নয়নের মহাপরিকল্পনা। সেখানে গ্রিন শিল্পজোন, স্পোর্টস ভিলেজ, আর্মি স্টেডিয়াম থেকে শুরু করে হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতাল, আইকনিক মসজিদসহ কেন্দ্রীয় কারাগারের মতো গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জঙ্গল সলিমপুরে এসব প্রতিষ্ঠান হলে চাপ কমবে চট্টগ্রাম মহানগরীর ওপর। সেখানে একটি আধুনিক শহর গড়ে উঠবে। হাজার হাজার মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। অর্থনৈতিক অবস্থার আমূল পরিবর্তন ঘটবে। সেইসঙ্গে এ অঞ্চলের মানুষের ভাগ্যবদল হবে।
সরকারের এই মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে দীর্ঘদিন অবৈধভাবে সেখানে বসবাসকারী দখলদারদের উচ্ছেদে শুরু হয়েছে অভিযান। এরপরও পিছু হটছে না সরকারি দলের কোন কোন নেতার মদদপুষ্ট দখলদারেরা। র্যাব-পুলিশের সহযোগীতায় জেলা প্রশাসনের সাঁড়াশি উচ্ছেদ অভিযানেও বাধা দেয়ার চেষ্টা করছে তারা। অভিযানে গেলেই দখলদারদের সাথে সংঘাত-সহিংসতার ঘটনা ঘটছে। শিশু ও নারীদের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে তারা অভিযানে বাধা দিচ্ছে। করছে সড়ক-মহাসড়ক অবরোধ, মিছিল সমাবেশ। রাস্তা কেটে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করা হচ্ছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে গুলি করতে বাধ্য হচ্ছে প্রশাসন। সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার বায়েজিদ-ফৌজদারহাট অংশে উচ্ছেদ অভিযানে হামলা করে দখলদারেরা। এই সময় সংঘর্ষে পুলিশসহ ১০ জন আহত হয়েছেন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিতে ৩২৯ রাউন্ড রাবার বুলেট, টিয়ার সেল ছুড়ে পুলিশ। তবে প্রশাসনের তরফে হুঁশিয়ারী দিয়ে বলা হয়েছে, এক ইঞ্চি জমিও দখলদারদের কব্জায় থাকতে দেওয়া হবে না। অভিযান আরো জোরদার করা হবে।
এদিকে জঙ্গল সমিলপুরে সরকারের গৃহিত উন্নয়ন মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের অগ্রগতি নিয়ে আগামীকাল সোমবার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে উচ্চপর্যায়ের সমন্বয় সভা ডাকা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব আহমদ কায়কাউস এতে সভাপতিত্ব করবেন। জানা গেছে সভায় জননিরাপত্তা বিভাগ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ, গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার বিভাগ, বিদ্যুৎ বিভাগ, ভূমি মন্ত্রণালয়, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগ, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক মন্ত্রণালয়, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়, সুরক্ষা সেবা বিভাগ, আইন ও বিচার বিভাগের সিনিয়র সচিবদের উপস্থিত থাকতে বলা হয়েছে। চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার, ডিআইজি, চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার, জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারসহ কর্মকর্তারা ওই সভায় অংশ নেবেন।
জেলা প্রশাসনের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রাম মহানগরী থেকে মাত্র ১০ কিলোমিটার দূরে সীতাকুণ্ডের দুর্গম পাহাড়ি এলাকা জঙ্গল সলিমপুর পাহাড়ে ৫টি মৌজায় প্রায় ৩১০০ একর সরকারি খাসজমি আছে। এর মধ্যে ৩০ শতাংশ পাহাড় কেটে ধ্বংস করা হয়েছে। সলিমপুরের পূর্ব ও উত্তরে রয়েছে চট্টগ্রাম সেনানিবাস ও বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমি, পশ্চিমে বঙ্গোপসাগর ও দক্ষিণে চট্টগ্রাম মহানগর। এ পর্যন্ত জঙ্গল সলিমপুরে ৪০০ একর পাহাড় কাটা হয়েছে বলে জানিয়েছে জেলা প্রশাসন। চট্টগ্রাম মহানগর ছিন্নমূল বস্তিবাসী সমন্বয় সংগ্রাম পরিষদ নামের একটি সংগঠনসহ বেশ কয়েকটি সংগঠন সেই খাসজমি দখল করে প্রায় তিন দশক ধরে সেখানে পাহাড় কেটে ও জঙ্গল সাফ করে প্লট বিক্রি করে আসছিল। লোকজন সেই প্লট কিনে সেখানে বসতি ও দোকানপাট গড়ে তোলে।
দীর্ঘদিন থেকে সন্ত্রাসীরা ওই এলাকা নিয়ন্ত্রণ করে আসছে। সেখানে বসবাসকারীদের দেয়া হয় বিশেষ পরিচয়পত্র। ওই পরিচয়পত্র দেখিয়ে তারা সেখানে আসা-যাওয়া করতো। বহিরাগত কেউ এমনকি প্রশাসনের কোন লোকজনও সেখানে যেতে পারতো না। পুরো এলাকায় সিসি ক্যামেরা বসিয়ে গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করতো তারা। সেখানে অস্ত্র তৈরীর কারখানা আবিস্কার হয়েছে বেশ কয়েকবার। অভিযানে গিয়ে হামলার শিকার হয়েছে র্যাব-পুলিশের টিম। প্রকাশ্যেই চলত অস্ত্র, মাদকের ব্যবসা। লোকজনকে ধরে নিয়ে সেখানে জিম্মি করে আদায় করা হতো মুক্তিপণ। অনেকটা বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতোই ছিল পুরো এলাকা।
দশকের পর দশক পাহাড় টিলা নিধন করে এই অপকর্ম চললেও সবাই ছিল নীরব দর্শক। জেলা প্রশাসন বেশ কয়েকবার উদ্যোগ নিয়েও সেখান থেকে তাদের সরাতে পারেনি। সর্বশেষ জনশুমারি অনুযায়ী ওই এলাকায় প্রায় ১৯ হাজার মানুষ বসবাস করে। পাহাড়বেষ্টিত সলিমপুর ও আলি নগরে গত ৩০ বছরে শতাধিক একর পাহাড় কেটে গড়ে তোলা হয়েছে হাজার হাজার বাড়িঘর। বিভিন্ন সমিতি ও ব্যক্তির নামে এসব পাহাড় কাটা হয়েছে। প্রভাবশালী মহল এসব পাহাড় কেটে লাখ লাখ টাকায় জমির মালিকানা বিক্রি করেছে। এসব জমিতে হয়েছে বহুতল ভবন, পাকা বাড়ি।
বর্তমান জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মমিনুর রহমান সলিমপুর থেকে অবৈধ বসতি ও স্থাপনা উচ্ছেদের মাধ্যমে সরকারী খাস জমিগুলো উদ্ধার করে সেখানে মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নেন। জুলাই মাস থেকে উচ্ছেদ অভিযান শুরু হয়। জঙ্গল সলিমপুরে মহাপরিকল্পনার অংশ হিসেবে গত ৩০ জুলাই চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে বিভিন্ন সরকারি সংস্থার প্রতিনিধিদের নিয়ে সভা করেন প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব আহমদ কায়কাউস। সভায় তিনি সলিমপুরে অবৈধভাবে পাহাড় কাটা ও সরকারি খাস জমি দখলের উৎসব বন্ধ করতে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে নির্দেশ দেন। খাস জমি উদ্ধারের পাশাপাশি সলিমপুরে সন্ত্রাসীদের দৌরাত্ম্য কমাতে র্যাব-পুলিশ মাঠে নামে। এরই মধ্যে জঙ্গল সলিমপুর এলাকা পরিদর্শন করেছেন ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ, তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র এম রেজাউল করিম চৌধুরীসহ প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।
ইতোমধ্যে সেখানে কয়েক দফা উচ্ছেদ অভিযান হয়েছে। দখলদারদের অনেকে এলাকা ছেড়ে গেছে। তবে আগামী কয়েক মাসের মধ্যে পুরো এলাকা প্রশাসনের দখলে নেওয়া হবে। চট্টগ্রামের পুলিশ সুপার এস এম শফিউল্লাহ জানান, সেখানে অস্থায়ী পুলিশ ক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছে। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় পুলিশ সার্বক্ষণিক কাজ করছে। অপরাধীদের বিরুদ্ধে অভিযান চলমান রয়েছে। জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা জানান, সেখানে নিয়মিত অভিযান চলছে। উচ্ছেদ অভিযান অব্যাহত থাকবে।
অপর দিকে জঙ্গল সলিমপুরে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে একটি মহাপরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি সরকারি সংস্থা সেখানে প্রতিষ্ঠান করার জন্য জমি চেয়ে আবেদন করেছে। যার মধ্যে আছে- স্পোর্টস ভিলেজ, হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতাল, সাফারি পার্ক, ইকোপার্কসহ বিনোদনকেন্দ্র, চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগার-২, উচ্চক্ষমতার বেতার সম্প্রচার কেন্দ্র, পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির প্রশিক্ষণকেন্দ্র, কাস্টমস ডাম্পিং হাউজ, ভূমিহীনদের পুনর্বাসন, সবুজ শিল্প এলাকা, আনসার ভিডিপি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, পার্ক, নাইট সাফারি পার্ক, মসজিদ। এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে আগামী আড়াই তিন বছরের মধ্যে এটি একটি উপশহরে রূপ নিবে। সেখানে গার্মেন্টস কারখানা স্থাপনের জন্য ২০০ একর জমি বরাদ্দ চেয়ে সরকারকে চিঠি দিয়েছে রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ। তবে প্রশাসনের তরফে বিচ্ছিন্ন কোন কারখানা না করে পাহাড়বেষ্টিত প্রাকৃতিক পরিবেশে ‘গ্রিন ইন্ডাস্ট্রি জোন’ গড়ার নীতিগত সিদ্ধান্তের কথা বলা হচ্ছে। জঙ্গল সলিমপুরে মোট ৩১০০ একর ভূমির বেশির ভাগ পাহাড়বেষ্টিত। ব্যবহার উপযোগী ভূমি আনুমানিক ৭০০ থেকে ৮০০ একর। ডিজিটাল সার্ভের মাধ্যমে যাচাই-বাছাইয়ের পর গুরুত্ব বিবেচনা করে জায়গা বরাদ্দ দেয়া হবে। তবে অবশ্যই পাহাড় অক্ষত এবং জীববৈচিত্র্য অক্ষুণ্ন রেখে সেখানে উন্নয়ন করা হবে জানিয়েছেন প্রশাসনের কর্মকর্তারা।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।