জুমবাংলা ডেস্ক : বিয়ে মানেই ঘটক পাখি ভাই। বহু বছরের ঘটকালি জীবনে একে একে বিয়ে দিয়েছেন ২৩ হাজারেরও বেশি। ঘটকজীবনের প্রথম দিকে তিনি যখন বাড়ি বাড়ি ঘুরে ঘটকালি করতেন, তখন তাঁর এক বন্ধু তাঁকে পাখির সাথে তুলনা করে তাঁর নাম দেন পাখিভাই, সেই থেকে চলছে ওই নাম। তবে ঘটকের আসল নাম আশরাফ হোসেন।
বলা চলে এই কাজে দীর্ঘ ৪৫ বছরের অভিজ্ঞতা তার। তিনিই বাংলাদেশে প্রথম ঘটকালিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছেন। বিয়ের ঘটকালি পেশার পথিকৃৎ ঘটক পাখি ভাই মুখোমুখি হয়েছেন গণমাধ্যমের
বিয়ের ঘটকালি মহৎ কাজ। ঠিক কোন ভাবনা থেকে এই পেশা বেছে নিয়েছেন?
ঘটক পাখি ভাই: আমি বরিশালের মানুষ। এই পেশায় আমি ইচ্ছে করে আসিনি। আমি তখন খুলনায় চাকরি করতাম। অনেকে জানতে চাইতো- আমার বোনটা বড় হয়ছে, আপনার পরিচিত ছেলে আছে কিনা কিংবা আমার ছেলের জন্য মেয়ে খুঁজছি- আপনার পরিচিত ভালো কোনো মেয়ে আছে কিনা? তখন টুকটাক এর-ওর ঘটকালি করতাম। তবে সেটা দাওয়াত খাওয়া কিংবা পয়সাকড়ি পাওয়ার জন্য নয়।
পাকিস্তান আমলে আমি প্রচণ্ড অসুস্থ হয়ে পড়ি। অন্য কাজ করার মতো আমার শারীরিক অবস্থা ছিল না। তখন চিন্তা করলাম, আমি যেহেতু ঘটকালি ভালো বুঝি, সুতরাং এখানে একটু মনোযোগ দেই। তারপর ১৯৭৩ সালে আমি ঢাকা চলে আসি। তখন মানুষ আমাকে চিনতো না, অফিসে অফিসে যেতাম, অবিবাহিত ছেলে-মেয়ের খোঁজখবর নিতাম। তখন কেউ এভাবে কাজ করত না। কাজ করতে গিয়ে মানুষের কাছ থেকে ব্যাপক সাড়া পেলাম! ঢাকায় আমার থাকার জায়গা ছিল না। নবাবপুরে সাবিনা হোটেলে থাকতাম। হোটেলে থেকেই কাজকর্ম করতাম। সবাইকে হোটেলের টেলিফোন নাম্বার দিতাম। প্রতিদিন এতো ফোন আসতো যে, হোটেল ম্যানেজার আমার উপর খুব বিরক্ত হতো। এরপর আমি নিজেই আলাদা টেলিফোন নাম্বার নেই। এরপর ইস্টার্ন প্লাজায় ‘ঘটক পাখি ভাই’ নামে অফিস নিয়েছি। সময়টা ১৯৮৫ সাল। মজার ব্যাপার এই কাজ শুরু করতে গিয়ে আমার তেমন কোনো পুঁজি লাগেনি। হোটেলের সেই টেলিফোন বিক্রি করে ইস্টার্ন প্লাজায় অফিস নিয়েছিলাম। তখন অবশ্য ভাড়াও খুব কম ছিল।
আপনার নাম ‘ঘটক পাখি ভাই’ কীভাবে হলো? নিশ্চয়ই ছেলেবেলায় এই নাম ছিল না!
ঘটক পাখি ভাই: আমার আসল নাম কাজী আশরাফ হোসেন। বিয়ের ঘটকালি যখন বেশি বেশি করতে শুরু করলাম, তখন এ-বাড়ি, ও-বাড়ি যেতাম। পরিচিত লোকজন লক্ষ্য করতো আমি একটু আগেই এ-বাড়িতে ছিলাম, অথচ হঠাৎ অন্য বাড়িতে চলে গেছি। তখন তারা বলতো- পাখি চড়ে ডালে ডালে, আর তুমি চলো মানুষের বাড়ি বাড়ি! একজন একদিন বললো, তুমি এতো দ্রুত পাখির মতো এ-বাড়ি থেকে ও-বাড়ি যাতায়াত করো, তোমার নাম ‘পাখি ভাই’ নাকি? এভাবে মানুষের মুখে মুখে আমার নাম ‘ঘটক পাখি ভাই’ হয়ে গেছে। এখন কেউ আমাকে আশরাফ হোসেন নামে চেনে না।
আপনি তো এক জীবনে অনেক বিয়ের ঘটকালি করেছেন! সংখ্যাটা কত হবে?
ঘটক পাখি ভাই: বিয়ে মহব্বতের কাজ, পবিত্র কাজ। দীর্ঘ ৪৫ বছরে প্রায় ১৯ হাজার বিয়ের ঘটকালি করেছি। আমি এই পেশায় মিথ্যা কথা বলে কখনো ঘটকালি করিনি। মানুষকে ধোঁকা দেব, মিথ্যা বলে টাকা নেব- এভাবে আমি কখনো করিনি। তাহলে এতো বছর আমি কাজ করতে পারতাম না।
স্বামী-স্ত্রী জুটি মেলানোর ক্ষেত্রে কোন বিষয়গুলো আপনি লক্ষ্য করেন?
ঘটক পাখি ভাই: একটা ভদ্র ছেলে, ভালো ছেলে ছাড়া সংসার ভালোভাবে হয় না। ছেলে যদি একটু অন্যভাবে চলাফেরা করে, ওই ঘরে স্ত্রীর সুখ হয় না, শান্তি হয় না। এজন্য আমি মেয়েদের অভিভাবকদের বুঝাই, আপনারা সব সময় জেনেশুনে মেয়ের বিয়ে দেবেন। না জেনে হুট করে বিয়ে দিয়ে বিপদে পড়বেন না।
এটা তো মেয়ে পক্ষকে বুঝালেন, ছেলে পক্ষকে…
ঘটক পাখি ভাই: ছেলে পক্ষকেও বলি, আপনারা খোঁজখবর নেন। মেয়ের কোথাও কোনো অসুবিধা আছে নাকি? প্রেম পিরিতি করে নাকি? মেয়ের বাবা জোর করে বিয়ে দিচ্ছে নাকি? এগুলো আগে জানতে হবে। না জেনে আত্মীয়তা করবেন না। দেশের এমন কোনো জেলা নেই যেখানে আমি ঘটকালি করিনি। দেশের বাইরেও আমি অনেক বিয়ের কাজ করেছি। বিশেষ করে লন্ডন, আমেরিকা, সৌদি আরবসহ যেখানে বাঙালী বেশি রয়েছে।
আপনার এখানে পাত্র কিংবা পাত্রীপক্ষ কীভাবে আসে?
ঘটক পাখি ভাই: আমি পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেই। বিজ্ঞাপন দেখে মানুষ আসে। এসেই বলে, আমার ছেলে বিয়ে করবে, একটা ভালো মেয়ে দরকার, একটা ভালো ফ্যামেলি দরকার। মেয়ে পক্ষ বলে, এই রকম একটা ছেলে দরকার। উভয় পক্ষের পছন্দ মিলিয়ে দুই পক্ষকে তথ্য, ছবি ই-মেইল করি। আমার অফিসে দুই পক্ষকেই ডেকে বসার ব্যবস্থা করে দেই।
ঘটকালি করতে গিয়ে কখনো বিব্রত অবস্থায় পড়েছেন কিনা?
ঘটক পাখি ভাই: অনেক বিব্রতকর পরিস্থিতে পড়েছি। অনেকে বিয়ে করেছে কিন্তু আমার পাওনা পরিশোধ করেনি। উল্টাপাল্টা কথা বলেছে। যে মেয়েরা আমার প্রতিষ্ঠানে কাজ করে, তাদের কটূ কথা শুনিয়েছে। এটা হয়, এটা স্বাভাবিক। হাজার হাজার কাজ করি তো- দুই চারটা বিয়েতে এমন হতেই পারে। ব্যাপার না।
এক দুটি বিব্রতকর ঘটনার কথা যদি বলতেন…
ঘটক পাখি ভাই: বিয়ের আগে হয়তো ক্লায়েন্ট বলল, ‘ভাই এটা কোনো টাকাই না, বিয়ের পর আরো অনেক টাকা দেব-আপনি লিখে রাখেন।’ আমি লিখে রেখেছি, সেটা লেখাই আছে, কিন্তু টাকার আর খোঁজ নেই। জিজ্ঞেস করলে বলে, এই টাকা তো দেয়ার কথা ছিল না। এ নিয়ে ঝগড়া, খারাপ ব্যবহার, বকাবকি- এমন কাহিনি অনেক আছে।
ঘটকালির জন্য কত টাকা ফি নেন?
ঘটক পাখি ভাই: যাদের টাকাপয়সা কম, তাদের থেকে কম নেই। যাদের টাকাপয়সা আছে তাদের কাছে একটু বেশি নেই। অনেক বড় লোক আছে, বলতেও হয় না, তারা বুঝে নেয়। আমাদের প্রতিষ্ঠানের দুইটা অফিস, স্টাফদের বেতন এগুলো তো চালাতে হবে। ধরুন এই অফিস ভাড়াসহ মাসিক খরচ প্রায় দেড় লাখ টাকা। এছাড়া বেতনভূক্ত ছয়জন নারী স্টাফ রয়েছে। প্রতিদিন পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিতে হয়, নইলে মানুষ তো জানবে না- পাখি ভাই আছে নাকি মারা গেছে! কেউ ২০ হাজার, কেউ ৫০ হাজার দেয়। তবে সর্বনিম্ন রেট দশ হাজার টাকা। এর কম নিলে তো আমি চলতে পারবো না!
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।