মিজানুর রহমান টিটু, সন্দ্বীপ : ‘ও আমার বাংলা মা তোর আকুল করা রূপের সুধায় হৃদয় আমার যায় জুড়িয়ে’ এ কথার সত্যতা যথাযথভাবে বোঝা যায় যখন আমরা বাংলাদেশের বিভিন্ন দর্শনীয় স্থানে ঘুরতে যাই। এটি আরও ভালো করে উপলব্ধি করতে পারবেন যদি আপনার ঘুরতে আসেন প্রাকৃতিক সম্পদ ও সৌন্দর্যের অপার লীলাভূমি সন্দ্বীপে।
চতুর্দিকে নদী আর সাগর বেষ্টিত এই দ্বীপটি স্থানীয় জনগণের কাছে ‘সাগর কন্যা দ্বীপ’ নামেই বেশি পরিচিত। বঙ্গোপসাগরের মেঘনার মোহনায় অবস্থিত চট্টগ্রামের দ্বীপ উপজেলা সন্দ্বীপ ইতিহাস ও ঐতিহ্যেও ভরপুর। এখানে আসলে ভালো লাগার এক অনন্য দৃশ্যপট ভেসে উঠবে আপনার চোখের সামনে।
সাধারণত নভেম্বর থেকে মার্চ এই সময়টা বিস্তীর্ণ সবুজে ছাওয়া এই দ্বীপে বেড়ানোর জন্য ভালো সময়। বছরের অন্যান্য সময় সমুদ্রপথে এই দ্বীপে আসাটা অনেকটা ঝুঁকির। কারণ মাঝে মধ্যে সাগর অনেক বেশি উত্তাল থাকে।
যেভাবে আসা যায় এই দ্বীপে: বাংলাদেশের যে কোন অঞ্চল থেকে সন্দ্বীপ উপজেলায় যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম নৌপথ। মোট নৌপথ ২২ নটিক্যাল মাইল। দ্বীপ থেকে মূল ভূখন্ডে যাতায়াতের জন্য রয়েছে বিআইডাব্লিউটিসি’র ২ টি স্টিমার ঘাট ( যার একটি বর্তমানে বন্ধ রয়েছে ) এবং ৫ টি জেলা পরিষদের ফেরীঘাট রয়েছে।
চট্টগ্রাম থেকে কুমিরাঘাট: চট্টগ্রামের একে খান থেকে প্রাইভেট গাড়ি বা লোকাল বাসে কুমিরাঘাট আসা যায়। লোকাল বাস ভাড়া জনপ্রতি খরচ হবে ১৫ টাকা, প্রাইভেট গাড়িতে আসলে ৩০০-৩৫০ টাকা খরচ পরতে পারে।
কুমিরাঘাট থেকে সন্দ্বীপ গুপ্তছড়া ঘাট : চট্টগ্রাম থেকে দ্বীপে পৌঁছানোর সহজরাস্তা ‘কুমিরা টু গুপ্তছড়া ঘাট’ । এখান থেকে যেতে হবে জাহাজ ও স্পিডবোটে। অবশ্য অনেক সময় ট্রলারে করেও যেতে পারেন। জাহাজে দ্বীপ পর্যন্ত পৌঁছাতে সময় লাগবে দেড় থেকে দুই ঘন্টা, স্পিডবোটে দ্বীপ পর্যন্ত পোঁছাতে সময় লাগে ২০-২৫ মিনিট। জাহাজে শ্রেণীভেদে বিভিন্ন দামের টিকেট পাবেন। স্পিডবোটের টিকেট পাবেন জনপ্রতি ২৫০ টাকা করে এবং শিশুদের জন্য হাফ টিকেট নিলে চলবে। কুমিরা থেকে সন্দ্বীপ চ্যানেল অতিক্রম করার সময়টা বেশ রোমাঞ্চকর। সাগরের ঢেউ এবং সেই সাথে গাঙচিলদের পাশাপাশি উড়ে চলা আপনার যাত্রাপথের ক্লান্তি ভুলিয়ে দেবে।
যদি আপনি সকালে সাতটার দিকে কুমিরা থেকে রওনা হন তাহলে সকাল সাড়ে সাতটা নাগাদ পৌঁছে যাবেন দ্বীপে। যদি খুব কম সময় নিয়ে বেড়াতে যান তাহলে রাতে না থেকে ঐদিনই যে কোন সময় স্পিডবোটে করে ফিরে আসতে পারেন চট্টগ্রামে। আর যদি সাগর কন্যার রাতের সত্যিকার মোহনীয় রূপ দেখতে চান তাহলে রাত্রিযাপন করতে পারেন এখানে।
থাকার ব্যবস্থা: সন্দ্বীপে এখন থাকার জন্য বেশ ভালো কিছু আবাসিক হোটেল রয়েছে। খুব স্বল্প খরচে থাকা যায় এসব হোটেলে। গুপ্তছড়া ঘাট থেকে ভাড়ায় চালিত মোটরসাইকেল বা সিএনজি করে সন্দ্বীপ কমপ্লেক্স চলে গেলে পেয়ে যাবেন আবাসিক হোটেল। গ্রিনচিলি, জামান গেস্ট হাউজ, রয়েল ইনে থাকার ভালো ব্যবস্থা আছে।
থাকার ব্যবস্থা হয়ে গেলে খাওয়া নিয়ে কোন চিন্তা নাই। হোটেলেও খেতে পারেন আবার খাওয়ার জন্য বাইরের রেস্টুরেন্টও বেছে নিতে পারেন। সন্দ্বীপে ঘুরতে এলে শিবের হাটের ঐতিহ্যবাহী বিনয়সাহার দোকানের ছানার মিষ্টি, মহিষের দই ও ডাব অবশ্যই একবার হলেও খেয়ে দেখবেন। এই দ্বীপের ডাব একাধারে মিষ্টি ও সুস্বাদু।
দ্বীপবন্ধু মুস্তাফিজুর রহমান জেটি: সন্দ্বীপ গুপ্তছড়া ঘাটে এই নবনির্মিত জেটিটি অবস্থিত। জেটির দুই পাশের ল্যাম্পপোস্টের আলোর সৌন্দর্য দেখে আপনি মুগ্ধ হবেন। সাগরের গর্জনের শব্দের সাথে সাথে সাগরের শীতল হাওয়া আপনাকে এনে দিবে অনাবিল প্রশান্তি। এই জেটির দুই পাশে রয়েছে ম্যানগ্রোভ বন যা জেটির সৌন্দর্য দ্বিগুণ বৃদ্ধি করেছে । সিনেমা, নাটক ও মিউজিক ভিডিও শ্যূটিংয়ের জন্য এটি হতে পারে ভালো স্পট। এখানে আপনি চাইলে জেটির ল্যাম্প পোস্টের আলোর নিচে করতে পারেন বারবিকিউ পার্টি।
সমুদ্র সৈকত: সৈকতটি সন্দ্বীপের রহমতপুরে ইউনিয়নে অবস্থিত। এটি রহমতপুর পুরাতন স্টিমারঘাট নামে পরিচিত। পড়ন্ত বেলায় পশ্চিম আকাশে তেজ কমে যাওয়া সূর্যটা সৈকতের প্রান্তজুড়ে ছড়িয়ে দেয় রক্তবর্ণ আভা। এই সমুদ্র সৈকতে আপনি দেখতে পাবেন সূর্যাস্তের নয়নাভিরাম দৃশ্য। সৈকতটি ভ্রমণ পিপাসুদের তীর্থস্থানে পরিণত হয়েছে। সমুদ্র সৈকতটির দৈঘ্য প্রায় ১০ কিলোমিটার।
সবুজ চর: নাম শুনেই হয়তো অনেকটা অনুমান করতে পারছেন কেন এই জাইগাটির নাম সবুজচর। স্থানীয় অনেকে এই স্থানটিকে গ্রিনল্যান্ডও বলে। এই জাইগাটি সন্দ্বীপের দীর্ঘাপাড়া ইউনিয়নে অবস্থিত। সবুজ ঘাসের গালিচায় মোড়ানো এই চরটি। যতদূর চোখ যাবে সবুজ আর সবুজের নয়নাভিরাম দৃশ্য আপনাকে মুগ্ধ করবে। এই চরে রয়েছে ম্যানগ্রোভ বন। বনে রয়েছে বক, মাছরাঙা, বালিহাঁস, ময়না, টিয়া ও ঘুঘুসহ হরেক রকম পাখি। শীতকালে অতিথি পাখির কলকাকলীতে মুখরিত হয়ে ওঠে এই গ্রীনল্যান্ডটি। এখানে আসলেই হাজার হাজার গরু, ছাগল ও মহিষের ছুটে চলা পাল দেখার সুযোগ মিলবে। আপনি চাইলে ক্যাম্প করে এখানে রাত্রি যাপন করতে পারবেন। সাথে দেশি হাঁস ও মুরগীর বারবিকিউ করার সুযোগতো থাকছেই। এই জাইগায় স্বল্প মূল্যে দেশি হাঁস, মুরগী ও ছাগল পাওয়া যায়। মোটরসাইকেল ও অটোরিকশা ভাড়া নিয়ে সন্দ্বীপ কমপ্লেক্স থেকে ৩০-৪০ মিনিটে মধ্যে পৌঁছে যাওয়া যায় এই সবুজচরে।
নিরাপত্তা : আপনি কোথাও ঘুরতে যাবেন আর নিরাপত্তার কথা ভাববেন না তা কী হয়! আপনার নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য এখানে রয়েছে বাংলাদেশ পুলিশ ও কোস্টগার্ড। নিরাপত্তার বিষয়ে চিন্তা করার কোনও প্রয়োজন নেয়। এই দ্বীপের স্থানীয় লোকজন অনেক আন্তরিক ও অতিথিপরায়ণ। প্রতিদিনকার ব্যস্ত জীবন থেকে একটু মুক্তি পেতে চাইলে ঘুরে যেতে পারেন সাগর কন্যার দ্বীপ থেকে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।