রঞ্জু খন্দকার, গাইবান্ধা থেকে: তখনও পৌষের বেলা শেষ হয়নি। মধ্য পৌষের মধ্য দুপুর। তবে রোদের তেজ তেমন নেই। আমরা ডিঙিতে করে শীতে শীর্ণ হয়ে যাওয়া করতোয়া পারি দিয়ে পৌঁছেছি ছোট্ট এক চর বালুপাড়ায়। উদ্দেশ্য–চরের মানুষের জীবন দেখা, জীবীকার খোঁজ নেওয়া। সঙ্গে সামান্য হাওয়া বদল।
আমার সঙ্গী স্কুলশিক্ষক শাহওয়াজ কবীর জানালেন, এই অঞ্চলটি তিন জেলার সঙ্গমস্থল। আমরা আছি গাইবান্ধার পলাশবাড়ী উপজেলার কিশোরগাড়ী গ্রামে। এই চরের ঠিক পূর্ব-উত্তরে রংপুরের পীরগঞ্জের বদলাপাড়া আর উত্তর-পশ্চিমে দিনাজপুরের ঘোড়াঘাটের শিঙ্গিগাড়ী।
এখানকার ভূগোলটা আরেকটু ভালো করে ব্যাখ্যা করলেন শাহওয়াজ। ‘করতোয়া এখানে বাঁক নিয়ে পশ্চিম থেকে দক্ষিণে বয়ে গেছে। নদীর গতিপথ তিন জেলাকে বিচ্ছিন্ন করেছে। করতোয়ার দক্ষিণে গাইবান্ধা। আর উত্তরে রংপুর, দিনাজপুর। এমন ভূগোল জীবন ও জীবীকা দেখার জন্য আদর্শ, একঘেয়েমি দূর করার জন্যও,’ বললেন তিনি।
কিশোরগাড়ীর ভেকিপাড়া থেকে ছোট্ট নৌকায় ছোট নদী পার হয়ে ওপাশে একই গ্রামের বালুপাড়া চর। গিয়েই দেখি, কয়েক কিষান-কিষানী খেত থেকে আলু তুলছেন। মুখে তাদের মিষ্টি হাসি। রোদ পড়ে ঝকমক করছে। করবে-ই না বা কেন? বাজারে তখন আলুর কেজি ৫৫-৬০ টাকা।
কৃষকেরা বললেন, এগুলা মধ্যম সময়ের আলু। এরপর বাজারে আরও একবার আলু নামবে। তখন দাম কিছুটা কমবে। যারা আগুর (আগাম) আলু করেছিলেন, তারা দাম আরও বেশি পেয়েছেন।
মনে থাকার কথা, এবার ভরপুর শীতেও বাজারে আলুর দাম খুব কমেনি। মৌসুমের শুরুতে কেজিপ্রতি বিক্রি হয়েছে ৭০-৭৫ টাকা পর্যন্ত। এখনও কেজি ৩৫-৫০ টাকা।
এবার আলুর বাজার চড়া কেন জানতে চাইলে কৃষক মোজাফফর হোসেন বলেন, এবার আলুর দাম বেশি থাকায় অনেকে স্টোর (গুদাম) থেকে আগেই আলু এনে বিক্রি করেছেন। ফলে বীজ আলু কম পড়েছে। এ কারণে আলুর আবাদও কমেছে। এর প্রভাব আবার পড়েছে বাজারে। অর্থাৎ দামের ঊর্ধ্বচক্রে পড়েছে আলু।
এই মোজাফফরেরই আলুর খেতে কাজ করছিলেন কৃষকেরা। তাঁর বাড়ি এই বালুপাড়া চরেই।
কথায় কথায় মোজাফফর জানান, তিনি বরাবরই বাজার বুঝে ফসল ফলানোর চেষ্টা করেন। এবার আগেই বুঝেছিলেন, আলুর দাম হবে। সে কারণে অনেকে অন্য আবাদ করলেও তিনি আলুই লাগিয়েছেন। ফলও পাচ্ছেন।
মোজাফফর শুধু আলুর আবাদই করেননি। তিনি একই খেতে ফাঁকে ফাঁকে ভুট্টাও লাগিয়েছেন।
বোঝা গেল, মোজাফফর একজন বুদ্ধিমান কৃষক। তিনি বললেন, আলু উঠে গেলেই ভুট্টার গাছ বড় হবে। তখন এক চাষে একই খেত থেকে ভুট্টাও পাওয়া যাবে।
এক খেতে শুধু আলু আর ভুট্টার আবাদ করেই ক্ষান্ত হননি মোজাফফর। তিনি বললেন, প্রায় তিন বিঘা জমিতে তিনি একই সঙ্গে কয়েক ফসলের আবাদ করেছেন।
পাশেই আরেকটি খেতে মোজাফফর নিয়ে গেলেন আমাদের। সেখানে দেখা গেল, একপাশে পেঁয়াজ-মরিচের চাষ। তার পাশ দিয়ে ছিটিয়েছেন মূলা আর পালংয়ের বীজ। বুনেছেন রসুনও। আলু তো রয়েছেই। অর্থাৎ এক খেতে ৬ ধরনের ফসল চাষ করেছেন মোজাফফর।
শুধু বুদ্ধিমান নন, মোজাফফর যথেষ্ট পরিশ্রমীও বটে। জানালেন, জমিকে পর্যাপ্ত খাতির-যত্ন না করলে জমিও আপনাকে খাতির করবে না। মাটিকে পরিশ্রম দিলে মাটি তা কয়েক গুনে ফিরিয়ে দেয়। তাই লেগে থাকার বিকল্প নেই।
বাজারে আনাজপাতির দাম বাড়লে কৃষকের হাহাকার ভালো চোখে দেখেন না মোজাফফর। তাঁর বক্তব্য, যে জিনিস চাষ করলেই পাওয়া যায়, তার জন্য বাজারের দিকে চেয়ে থাকব কেন? দাম বাড়লে হাহুতাশই বা করব কেন? কৃষকের সন্তানের হাহাকার মানায় না।
মোজাফফর আবাদি জমির এক ইঞ্চিও ফেলে রাখতে রাজি নন। তিনি বলেন, চরের জমি হচ্ছে সোনা। এখানে কিছু ছড়িয়ে দিলেও ফুলেফলে ভরে ওঠে। মরিচের সময় মরিচ, ভুট্টার সময় ভুট্টা। এ ছাড়া ধান, গম, আলু তো আছেই। এই সোনাফলা জমি ফেলে রাখব কোন দুঃখে?
আশপাশের কৃষকেরা মোজাফফরের কথায় সায় দিয়ে যাচ্ছিলেন। ততক্ষণে পৌষের বেলা প্রায় শেষ। আমরা চরের অন্য দিক ঘুরতে পা বাড়াই। নদীর তীর ঘেঁষে কোথাও শাকপালংয়ের আবাদ, কোথাও হাসছে সরিষা। কোথাও পটলের মাচা নতুন করে তুলে দিচ্ছেন কৃষক। চরের জীবন, জীবীকা কিছুটা হলেও দেখে নৌকা বাড়ালাম বাড়ির দিকে।
আসার পথে সঙ্গী শাহওয়াজের মন্তব্য, আসলেই, মোজাফফরের মতো ৬ ফসলী চাষি থাকলে চর তো সোনাফলা মাটিই বটে!
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।