সেদিন শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অপেক্ষা করছিলেন সৌদি আরবে যাওয়ার ফ্লাইটের জন্য, হাতে ছিল একটি নন-ডিসক্লোজার অ্যাগ্রিমেন্ট। হঠাৎ ফোন বাজল – বহু কাঙ্খিত সেই মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির চূড়ান্ত ইন্টারভিউ কল! কিন্তু হৃদস্পন্দন বাড়লেও মনটা ভরল না। “এই চাকরিটা নিলে কি আমার ক্যারিয়ার গ্রোথ ঠিক পথে থাকবে? দায়িত্ব কতটুকু দেবে? টিম কেমন?” – এইসব প্রশ্ন জমে থাকলেও মুখ ফুটে বলতে পারলেন না, শুধু ‘হ্যাঁ স্যার, নো স্যার’ করে গেলেন। ছয় মাস পরেই আবিষ্কার করলেন, চাকরির বাস্তবতা আর ইন্টারভিউতে বলা কথার মধ্যে আকাশ-পাতাল তফাৎ! শাহজালালের মতো হাজারো প্রার্থীর স্বপ্ন ভেঙে যায় শুধুমাত্র একটি সহজ কারণেই – চাকরি ইন্টারভিউতে সঠিক প্রশ্ন জিজ্ঞাসা না করা।
Table of Contents
ইন্টারভিউ শুধু আপনার যোগ্যতা যাচাইয়ের মঞ্চ নয়, এটা একটি দুই-মুখী রাস্তা। আপনি যেমন কোম্পানির জন্য উপযুক্ত কিনা তা তারা বিচার করছে, তেমনি এই প্রতিষ্ঠান, এই টিম, এই ভূমিকাটি আপনার জীবনের পরের কয়েক বছরকে গড়ে দেবে। ঢাকার গুলশানে অবস্থিত ‘ক্যারিয়ার ভিশন কনসাল্টিং’-এর প্রধান ক্যারিয়ার স্ট্র্যাটেজিস্ট ড. ফারহানা হক বলছেন, “ইন্টারভিউতে নীরবতা বা শুধু ‘জি স্যার’ বলাটা প্রার্থীর সবচেয়ে বড় ভুল। সঠিক, গভীর ও কৌশলগত প্রশ্ন না করাটা শুধু সুযোগ হারানো নয়, ভবিষ্যতের হতাশার বীজ বপন করা। বাংলাদেশের বাজারে যেখানে চাকরি পরিবর্তনের হার বাড়ছে, সেখানে ইন্টারভিউই আপনার ক্যারিয়ার ট্রাজেক্টরি ঠিক করে দিতে পারে।”
চাকরি ইন্টারভিউতে সঠিক প্রশ্ন জিজ্ঞাসা না করার এই নীরব সংকট শুধু ব্যক্তিগত ক্ষতির কারণ হয় না, এটি জাতীয় মানবসম্পদ উন্নয়নের পথেও বাধা। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অফ ম্যানেজমেন্ট (বিআইএম)-এর সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, প্রায় ৬৮% বাংলাদেশি প্রার্থী নতুন চাকরিতে জয়েন করার ৬ মাসের মধ্যে কিছু না কিছু হতাশার মুখোমুখি হন, যার বড় কারণ ইন্টারভিউ পর্যায়ে ভূমিকা ও প্রত্যাশা সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা না থাকা।
কেন চাকরি ইন্টারভিউতে আপনার প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করাটা অপরিহার্য? (গুরুত্ব ও মনস্তত্ত্ব)
ইন্টারভিউর সেই চাপের মুহূর্তে মনে হতে পারে, বেশি প্রশ্ন করলে হয়তো ইমপ্রেশন খারাপ হবে। কিন্তু বাস্তবতা একেবারে উল্টো। আপনার প্রশ্নই ইন্টারভিউয়ারকে বলে দেয় –
- আপনি সত্যিই আগ্রহী ও প্রস্তুত: শুধু CV তে যা আছে তা পড়ে আসেননি, আপনি কোম্পানি, ভূমিকা, টিম সম্পর্কে গভীরভাবে জানতে চান। এটি আপনার আন্তরিকতা ও ইনিশিয়েটিভ দেখায়। ঢাকার একটি রেপুটেড এফএমসিজি কোম্পানির এইচআর হেড আরিফুল ইসলাম বলেন, “যে প্রার্থী গুছিয়ে, রিসার্চ করে ভালো প্রশ্ন করে, তাকে আমরা সিরিয়াস ক্যান্ডিডেট হিসেবে দেখি। ওই মুহূর্তেই মনে হয়, এই লোকটা শুধু চাকরি চায় না, এই টিমে কন্ট্রিবিউটও করতে চায়।
- আপনার বিচারক্ষমতা ও স্ট্র্যাটেজিক থিংকিং: সুচিন্তিত প্রশ্ন আপনার সমস্যা সমাধানের দক্ষতা, বিশ্লেষণী ক্ষমতা এবং দীর্ঘমেয়াদী চিন্তার প্রতিফলন ঘটায়।
- কোম্পানি কালচার ও আপনার ফিটনেস: প্রশ্নের মাধ্যমে আপনি বুঝতে পারবেন এই প্রতিষ্ঠানের পরিবেশ, মূল্যবোধ, কাজের ধরন আপনার ব্যক্তিত্ব ও জীবনযাত্রার সাথে খাপ খায় কিনা। এটা শুধু চাকরি নয়, আপনার ক্যারিয়ারের সঠিক বাসস্থান খুঁজে নেওয়া।
- আপনার ভবিষ্যতের জন্য তথ্য সংগ্রহ: ইন্টারভিউ শুধু তাদের জন্য নয়, আপনার জন্যও। এই চাকরি নিলে আপনার পরবর্তী ২-৫ বছর কেমন যাবে? আপনি কী শিখবেন? কোথায় পৌঁছাতে পারবেন? এই সিদ্ধান্তের ভিত্তি হওয়া উচিত স্পষ্ট তথ্য, শুধু আকর্ষণীয় প্যাকেজ বা কোম্পানির নাম নয়।
- আত্মবিশ্বাস ও সমান অংশীদারিত্বের সংকেত: সঠিক প্রশ্ন জিজ্ঞাসা আপনার আত্মবিশ্বাস প্রকাশ করে এবং ইন্টারভিউকে একটি আলোচনায় পরিণত করে, যেখানে উভয় পক্ষই একে অপরকে মূল্যায়ন করছে। এটি ‘ভিক্ষা’ করার মতন অনুভূতি দূর করে।
মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব: ইন্টারভিউয়াররা দিনে অনেক প্রার্থীর মুখ দেখেন। আপনার স্মরণীয় হওয়ার সবচেয়ে কার্যকর উপায় হল এমন প্রশ্ন করা যা তাদের চিন্তা করায়, যা সাধারণত কেউ জিজ্ঞাসা করে না। এটি পজিটিভভাবে আলাদা করে আপনাকে।
মনে রাখুন: একটি ইন্টারভিউয়ে আপনি যতটা না উত্তর দেন, তার চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ আপনি কী প্রশ্ন করেন। এটি আপনার প্রফেশনালিজম, আগ্রহ এবং ভবিষ্যতের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির পরিষ্কার জানান দেয়।
চাকরি ইন্টারভিউতে জিজ্ঞাসা করার জন্য সেরা প্রশ্নের ক্যাটাগরি ও উদাহরণ (গভীর বিশ্লেষণ)
এবার আসুন সেই কাঙ্ক্ষিত প্রশ্নগুলোর কাছে যাই। শুধু ‘কাজের পরিবেশ কেমন?’ বা ‘বেতন কত?’ এই ধরণের সাধারণ প্রশ্ন নয়। আপনাকে জিজ্ঞাসা করতে হবে এমন প্রশ্ন যা ভূমিকা, টিম, কোম্পানি এবং আপনার ভবিষ্যতের সম্ভাবনার গভীরে যাবে। এখানে কৌশলগত ক্যাটাগরিতে সাজানো কিছু শক্তিশালী প্রশ্নের উদাহরণ দেওয়া হল:
১। ভূমিকা ও প্রত্যাশা সম্পর্কিত গভীর প্রশ্ন (Role & Expectations):
এই প্রশ্নগুলো আপনাকে বুঝতে সাহায্য করবে যে আপনি প্রতিদিন কী করবেন, আপনাকে কী অর্জন করতে হবে এবং কীভাবে আপনার সাফল্য পরিমাপ করা হবে।
- “এই পজিশনে যোগদানের পর প্রথম ৩০/৬০/৯০ দিনের জন্য আমার জন্য কি কি কী অর্জন বা মাইলস্টোন সেট করা আছে?” (প্রথম দিকের সাফল্যের পরিষ্কার ধারণা পেতে)
- “এই রোলের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ কী, এবং আপনি মনে করেন একজন সফল প্রার্থীকে সেটা মোকাবেলায় কী কী করতে হবে?” (কঠিন দিকগুলো বুঝতে এবং আপনার প্রস্তুতি দেখাতে)
- “এই টিম বা ডিপার্টমেন্টের জন্য চলতি বছর/পরবর্তী কোয়ার্টারের সবচেয়ে জরুরী প্রজেক্ট বা লক্ষ্য কী? এই ভূমিকা সেগুলো অর্জনে কীভাবে সাহায্য করবে?” (ভূমিকার কৌশলগত প্রভাব বোঝার জন্য)
- “আমার পূর্বসূরী এই ভূমিকায় কী অর্জন করেছিলেন যা আপনি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন? অথবা, যদি পদটি নতুন হয়, তাহলে এই ভূমিকা সৃষ্টির পেছনের প্রাথমিক চালিকাশক্তি কী ছিল?” (ইতিহাস ও প্রেক্ষাপট বোঝার জন্য)
- “এই পজিশনে পারফরম্যান্স মূল্যায়ন কিভাবে করা হয়? কী কী মেট্রিক্স বা KPI (Key Performance Indicators) এর উপর ফোকাস করা হয়?” (সাফল্য পরিমাপের মানদণ্ড জানতে)
২। টিম গতিশীলতা ও ম্যানেজমেন্ট স্টাইল (Team Dynamics & Management):
আপনার বস এবং সহকর্মীরাই আপনার দৈনন্দিন কাজের অভিজ্ঞতা গড়ে দেবেন। এই প্রশ্নগুলো সাহায্য করবে পরিবেশটি আপনার জন্য উপযুক্ত কিনা তা বুঝতে।
- “আমি সরাসরি কার কাছে রিপোর্ট করব? আপনি তাঁকে/তাঁদের ম্যানেজমেন্ট স্টাইল কিভাবে বর্ণনা করবেন?” (সুপারভাইজারের সাথে সামঞ্জস্য বোঝার জন্য)
- “যে টিমের সাথে আমি কাজ করব, তাদের সম্পর্কে কিছু বলুন? (উদাহরণ: অভিজ্ঞতার স্তর, সহযোগিতার ধরন, টিম কালচার)” (সহকর্মীদের সাথে সম্পর্কের ধরন জানতে)
- “টিমের মধ্যে সহযোগিতা এবং জ্ঞান ভাগাভাগি কিভাবে উৎসাহিত করা হয়? কোন টুলস বা প্রক্রিয়া আছে কি?” (কাজের ধরন বোঝার জন্য)
- “যদি টিমের মধ্যে মতবিরোধ বা চ্যালেঞ্জ দেখা দেয়, সেটা সাধারণত কিভাবে ম্যানেজ বা সমাধান করা হয়?” (কনফ্লিক্ট রেজোলিউশন কালচার বোঝার জন্য)
- “এই পজিশনের জন্য টিমের মধ্যে কার সাথে সবচেয়ে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করতে হবে এবং সেই সম্পর্কগুলো গড়ে তোলার ক্ষেত্রে কী কী গুরুত্বপূর্ণ?” (স্টেকহোল্ডার ম্যাপিং)
৩। কোম্পানি সংস্কৃতি, মূল্যবোধ ও ভবিষ্যৎ (Company Culture, Values & Growth):
কোম্পানির বাহ্যিক ইমেজের চেয়ে ভেতরের সংস্কৃতিই আপনার দীর্ঘমেয়াদী সুখ-সন্তুষ্টি নির্ধারণ করে।
- “কোম্পানির মূল্যবোধগুলো (Core Values) দৈনন্দিন কাজে এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণে কিভাবে প্রতিফলিত হয়? আপনি কি কোনও বাস্তব উদাহরণ দিতে পারবেন?” (শুধু ওয়েবসাইটের বুলেট পয়েন্টের বাইরে গিয়ে বাস্তবতা বোঝার জন্য – অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ)
- “ইন্টারভিউ প্রক্রিয়ায় আমার সাথে যাদের দেখা হয়েছে, তারা কোম্পানিতে সবচেয়ে বেশি কোন জিনিসটির জন্য পছন্দ করেন?” (অভ্যন্তরীণ কর্মীদের সত্যিকারের মতামত পেতে)
- “কোম্পানির বর্তমান বৃদ্ধি বা ট্রান্সফরমেশনের সবচেয়ে বড় চালিকাশক্তি কী? আগামী ১-২ বছরে কোন দিকে ফোকাস করা হচ্ছে?” (কোম্পানির দিকনির্দেশনা ও স্থায়িত্ব বোঝার জন্য)
- “কর্মীদের পেশাগত বিকাশের জন্য কোম্পানি কী ধরণের সুযোগ বা রিসোর্স প্রদান করে? (যেমন: প্রশিক্ষণ, মেন্টরশিপ, কনফারেন্স, কারিগরি সেশন ইত্যাদি)” (আপনার নিজের বৃদ্ধির সুযোগ যাচাই)
- “কোম্পানি কর্মী-জীবনের ভারসাম্য (Work-Life Balance) কতটা সমর্থন করে? বাস্তবে সেটা কেমন দেখা যায়? (বিশেষ করে প্রজেক্টের চাপের সময়)” (আপনার ব্যক্তিগত জীবনের সাথে সামঞ্জস্য বোঝার জন্য)
৪। আপনার বৃদ্ধি, বিকাশ ও পথচলা (Your Growth & Trajectory):
এই চাকরি শুধু বর্তমান নয়, আপনার ভবিষ্যতের ক্যারিয়ারের জন্য একটি সিঁড়ি।
- “এই ভূমিকায় একজন ব্যক্তি কিভাবে শেখে এবং বৃদ্ধি পায়? শেখার জন্য কি নির্দিষ্ট রিসোর্স বা সুযোগ আছে?” (দৈনন্দিন শেখার সুযোগ বোঝার জন্য)
- “এই পজিশনে সফল ব্যক্তিদের জন্য সাধারণত ক্যারিয়ারে পরবর্তী কোন দিকে অগ্রসর হওয়ার সুযোগ থাকে? কোম্পানির ভেতরে বা বাইরে?” (দীর্ঘমেয়াদী ক্যারিয়ার পাথ বোঝার জন্য)
- “এই বিভাগ বা টিমে আগে যারা এই ধরনের ভূমিকায় ছিলেন, তারা এখন কোথায় আছেন?” (ক্যারিয়ার প্রোগ্রেশনের বাস্তব উদাহরণ পেতে)
- “এই ভূমিকায় কর্মরত ব্যক্তির জন্য আপনি দীর্ঘমেয়াদে কী কী অর্জন আশা করেন?” (ভবিষ্যতের প্রত্যাশা ও আপনার সম্ভাব্য প্রভাব বোঝার জন্য)
৫। ইন্টারভিউ প্রক্রিয়া ও পরবর্তী পদক্ষেপ (Interview Process & Next Steps):
শেষ করার আগে প্রক্রিয়াটি পরিষ্কার করে নিন।
- “ইন্টারভিউ প্রক্রিয়ার পরবর্তী ধাপগুলো কী কী এবং এর জন্য আনুমানিক সময়সীমা কত?” (পরবর্তী পদক্ষেপ জানতে)
- “আপনার মতে, এই ভূমিকার জন্য আদর্শ প্রার্থীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য বা দক্ষতা কী কী?” (তাদের অগ্রাধিকার বোঝার শেষ সুযোগ)
- “আমার প্রোফাইল বা দক্ষতা নিয়ে আপনার কোনও উদ্বেগ বা প্রশ্ন আছে কি, যা আমি এখনই ক্লিয়ার করতে পারি?” (যেকোন ভুল বোঝাবুঝি দূর করার সাহসী সুযোগ – শুধুমাত্র তখনই জিজ্ঞাসা করুন যদি ইন্টারভিউ ভাল গিয়ে থাকে এবং আপনি আত্মবিশ্বাসী হন)
কোন প্রশ্ন এড়িয়ে চলবেন? (বিপদ চিহ্নিতকরণ)
ইন্টারভিউতে সঠিক প্রশ্ন জিজ্ঞাসা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি কিছু প্রশ্ন এড়িয়ে চলাও সমান জরুরি। এই প্রশ্নগুলো নেতিবাচক ইমপ্রেশন তৈরি করতে পারে বা অপরিণত মনে হতে পারে:
- শুরুতেই বেতন, ছুটি বা সুযোগ-সুবিধা নিয়ে প্রশ্ন: “স্যালারি কত?”, “কতদিন ম্যাটারনিটি লিভ পাব?”, “বোনাস কত?” – এসব প্রশ্ন ইন্টারভিউয়ের শুরুতেই জিজ্ঞাসা করলে মনে হতে পারে আপনি শুধু টাকার জন্যই আগ্রহী। প্রথমে ভূমিকা, কোম্পানি এবং আপনার ফিট নিয়ে আলোচনা শেষ করুন। বেতন-সুবিধার আলোচনা সাধারণত চূড়ান্ত পর্যায়ে বা অফার স্টেজে হয়।
- যে তথ্য সহজেই অনলাইনে পাওয়া যায়: “আপনার কোম্পানি কী করে?”, “আপনাদের প্রধান পণ্য কী?” – এটি দেখায় আপনি রিসার্চ করেননি। কোম্পানির ওয়েবসাইট, লিংকডইন পেজ, খবর গুগল করে জেনে নিন।
- নেতিবাচক বা অভিযোগমূলক প্রশ্ন: “কর্মীরা এখানে কেন বেশি দিন থাকে না?”, “গত কয়েক বছরে এত এমপ্লয়ি কেন চলে গেল?” – এমন প্রশ্ন আক্রমণাত্মক বা বিরূপ মনে হতে পারে। ইতিবাচকভাবে কোম্পানি কালচার জানার চেষ্টা করুন।
- হ্যাঁ/না তে উত্তর দেওয়া যায় এমন সাধারণ প্রশ্ন: “কাজের পরিবেশ ভালো?”, “টিম ওকে?” – গভীর তথ্য পাওয়া যায় না, আলোচনাও বাড়ে না। খোলামেলা প্রশ্ন (Open-ended) জিজ্ঞাসা করুন।
- অত্যধিক ব্যক্তিগত প্রশ্ন ইন্টারভিউয়ারকে: “আপনার বেতন কত?”, “আপনি এখানে কতদিন থাকবেন?” – এটি অপ্রাসঙ্গিক এবং অস্বস্তিকর।
প্রশ্ন জিজ্ঞাসার সর্বোত্তম সময় ও পদ্ধতি
শুধু সঠিক প্রশ্নই নয়, কখন এবং কিভাবে সেগুলো জিজ্ঞাসা করবেন তাও গুরুত্বপূর্ণ:
- সময়: ইন্টারভিউয়ের শেষে সাধারণত ইন্টারভিউয়ার আপনাকে জিজ্ঞাসা করবেন, “আপনার কি কোন প্রশ্ন আছে?” এটাই আপনার মূল সুযোগ। খুব দেরি করে জিজ্ঞাসা করবেন না যাতে পর্যাপ্ত সময় না থাকে।
- সংখ্যা: ৩-৫টি ভালভাবে প্রস্তুতকৃত, গভীর প্রশ্ন আদর্শ। ১০টি প্রশ্নের তালিকা নিয়ে বসবেন না।
- অগ্রাধিকার: আপনার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নগুলো আগে করুন। সময় কম হলে বাকিগুলো পরে জিজ্ঞাসা করতে পারেন।
- পদ্ধতি:
- শুনুন মনোযোগ দিয়ে: ইন্টারভিউয়ের সময় যা বলা হচ্ছে, তার সাথে সম্পর্কিত ফলো-আপ প্রশ্ন করুন। এটি আপনার আগ্রহ ও উপস্থিত বুদ্ধির পরিচয় দেয়।
- প্রাকৃতিকভাবে সংযুক্ত করুন: “আপনি একটু আগে [বিষয়] নিয়ে বলছিলেন, সেটা সম্পর্কে আমার আরেকটি প্রশ্ন আছে…”
- বিশেষভাবে প্রস্তুত করুন: শুধু সাধারণ প্রশ্ন নয়, কোম্পানির সাম্প্রতিক খবর, তাদের ইন্ডাস্ট্রির ট্রেন্ড বা তাদের নিজস্ব প্রেস রিলিজের রেফারেন্স দিয়ে প্রশ্ন করুন। “আমি দেখলাম গত মাসে আপনারা [নির্দিষ্ট প্রজেক্ট/প্রাপ্তি] ঘোষণা করেছেন। এই ভূমিকা সেই ধরনের উদ্যোগে কীভাবে অবদান রাখতে পারে?” – এই ধরণের প্রশ্ন অত্যন্ত শক্তিশালী।
- নোট রাখুন: ইন্টারভিউ চলাকালীন গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট নোট করুন, যাতে পরে সেগুলোর উপর ভিত্তি করে প্রশ্ন করতে পারেন।
- স্পষ্ট ও সংক্ষিপ্ত করুন: দীর্ঘ ভূমিকা না করে সরাসরি প্রশ্নে আসুন।
- উত্তরের উপর ভিত্তি করে চালিয়ে যান: ইন্টারভিউয়ারের উত্তরের মধ্যে যদি আরও জানার বিষয় থাকে, ফলো-আপ প্রশ্ন করুন (যদি সময় থাকে)।
জেনে রাখুন (FAQs)
ইন্টারভিউয়ের শুরুতে প্রশ্ন করলে কি খারাপ লাগবে?
সাধারণত ইন্টারভিউয়ের শেষে প্রশ্ন করার সুযোগ দেওয়া হয়। তবে, ইন্টারভিউ চলাকালীন যদি কোনও বিষয় সম্পূর্ণ অস্পষ্ট থাকে যা আপনার উত্তরদানে প্রভাব ফেলতে পারে, বা ইন্টারভিউয়ার যদি উৎসাহিত করেন (“কোনও প্রশ্ন আছে কি এখনই?”), তাহলে বিনয়ের সাথে জিজ্ঞাসা করুন। জোর করে চাপিয়ে দেবেন না।
কতগুলি প্রশ্ন প্রস্তুত করা উচিত?
অন্তত ৭-১০টি প্রশ্ন প্রস্তুত করুন। ইন্টারভিউ চলাকালীন কিছু প্রশ্নের উত্তর ইতোমধ্যেই পাওয়া যেতে পারে। সেক্ষেত্রে, আপনার তালিকা থেকে সেগুলো বাদ দিতে পারবেন। ৩-৫টি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করার সুযোগ পাবেন।
ইন্টারভিউয়ার যদি আমার প্রশ্নের উত্তর না জানে?
এটা অস্বাভাবিক নয়, বিশেষ করে যদি প্রশ্নটি খুব স্পেসিফিক হয়। ইন্টারভিউয়ার হয়তো বলবেন, “ভালো প্রশ্ন, আমি নিশ্চিত নই, আমি খুঁজে আপনাকে জানাবো” বা “সেটা [অন্য ব্যক্তির নাম] আপনাকে ভালো বলতে পারবেন।” এতে হতাশ হবেন না। এটি আপনার প্রশ্নের গভীরতাকেই নির্দেশ করে। ধন্যবাদ জানিয়ে এগিয়ে যান।
টেকনিক্যাল বা খুব স্পেসিফিক প্রশ্ন ইন্টারভিউতে করা উচিত?
হ্যাঁ, যদি সেগুলো সরাসরি ভূমিকার দৈনন্দিন দায়িত্ব বা চ্যালেঞ্জের সাথে সম্পর্কিত হয় এবং আপনি বুঝতে পারেন যে ইন্টারভিউয়ার (প্রায়ই হবু ম্যানেজার বা টিম লিডার) সে বিষয়ে জ্ঞান রাখেন। এটি আপনার প্র্যাকটিক্যাল জ্ঞান ও ভূমিকা বুঝতে আগ্রহ দেখায়। তবে অত্যধিক নিচুতলার বা হাইপোথেটিক্যাল টেকনিক্যাল প্রশ্ন এড়িয়ে চলুন।
মাল্টিপল ইন্টারভিউ রাউন্ডে একই প্রশ্ন বারবার জিজ্ঞাসা করা যাবে?
হ্যাঁ, কিন্তু কৌশলী হতে হবে। ভিন্ন ইন্টারভিউয়ারকে একই প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করে আপনি বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে উত্তর পেতে পারেন, যা আপনাকে আরও সম্পূর্ণ ছবি দেবে। প্রশ্নটি জিজ্ঞাসার সময় বলতে পারেন, “আমি এই বিষয়ে [অন্য ইন্টারভিউয়ারের নাম]-এর সাথে আলোচনা করেছিলাম, আপনার দৃষ্টিভঙ্গিটাও জানতে চাই…”
প্রশ্ন করার পর ইন্টারভিউ শেষে ধন্যবাদ ইমেইলে কি আমার প্রশ্নের উত্তর উল্লেখ করা উচিত?
যদি কোনও প্রশ্নের উত্তর ইন্টারভিউয়ারের কাছ থেকে না পেয়ে থাকেন এবং সেটা আপনার সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য গুরুত্বপূর্ণ হয়, তাহলে ইমেইলে বিনয়ের সাথে আবারও জিজ্ঞাসা করতে পারেন। “ইন্টারভিউয়ের সময় আমি [বিষয়] সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেছিলাম। সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে এই বিষয়ে আরেকটু তথ্য জানা আমার জন্য সহায়ক হবে, যদি সম্ভব হয় দয়া করে শেয়ার করেন।”
চাকরি ইন্টারভিউতে সঠিক প্রশ্ন শুধু তথ্য সংগ্রহের হাতিয়ার নয়, এটি আপনার পেশাদারিত্ব, দূরদৃষ্টি এবং নিজের ক্যারিয়ারের প্রতি দায়িত্ববোধের জ্বলন্ত প্রমাণ। শাহজালাল বিমানবন্দরে হারানো সেই সুযোগ যেমন তাকে শিখিয়েছিল, তেমনি আপনিও মনে রাখুন – ইন্টারভিউ কক্ষে আপনার কণ্ঠস্বরই নির্ধারণ করবে পরবর্তী কয়েক বছর আপনি কোথায়, কাদের সাথে এবং কীভাবে কাটাবেন। প্রস্তুত হোন, গবেষণা করুন, সেই গভীর, চিন্তা উদ্রেককারী প্রশ্নগুলো করুন যা আপনার ভবিষ্যৎ নিয়োগকর্তাকে জানান দেবে: আপনি শুধু একটি পদই খুঁজছেন না, আপনি খুঁজছেন একটি সাফল্যময় যাত্রার অংশীদারিত্ব। আজই আপনার পরবর্তী ইন্টারভিউয়ের জন্য সেই পারফেক্ট প্রশ্নগুলোর তালিকা তৈরি করুন, এবং নিজের ক্যারিয়ারের নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে নিন।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।