জুমবাংলা ডেস্ক : কবে কোন দামে মুরগি বিক্রি হবে তা নির্ধারণ করা হয় মুঠোফোনে এসএমএস’র মাধ্যমে। বিক্রির আগের দিন রাতে এই মেসেজ চলে আসে পাইকারি ব্যবসায়ীদের কাছে। আবার চাহিদা বেড়ে গেলে ঘণ্টার ব্যবধানে খুদে বার্তার মাধ্যমে বেড়ে যায় মুরগির দাম। দেশে মুরগির দাম নির্ধারণে কোনও নীতিমালা কিংবা নির্দেশনা নেই। তাই উৎপাদন খরচের সঙ্গে ইচ্ছেমতো লাভ যোগ করেই বাজারে পাঠাতেন উৎপাদনকারীরা। ফলে মুরগির দাম বাড়তে বাড়তে খুচরা পর্যায়ে ২৯০ টাকা কেজি পর্যন্ত উঠেছে।
মুরগির দাম নিয়ে অস্থিতিশীল বাজার এবং ক্রেতার সাধ্যের বাইরে চলে যাওয়ার পরিস্থিতির মধ্যে মূল উৎপাদক, পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীদের সঙ্গে দুই দফা বৈঠক করে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর। প্রথম দফা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় গত ৯ মার্চ। ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলাপের পর প্রতিষ্ঠানটির মহাপরিচালক মনে করেন, উৎপাদন খরচের সঙ্গে লাভ যোগ করে কোনোভাবেই মুরগির দাম কেজিতে ২০০ টাকার বেশি হওয়া উচিত না। সরকারের চাপে এবং গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনের ভিত্তিতে সর্বশেষ গতকাল ১৯০-১৯৫ টাকা কেজিতে মুরগি বিক্রি করতে সম্মত হয় দেশের বড় চার করপোরেট কোম্পানি।
তবে খামারিদের দাবি, চার কোম্পানি দাম কমিয়ে দেওয়ার ঘোষণা দিলে যদি বাজার ঠিক হয় তাহলে ধরে নিতে হবে বাজারের নিয়ন্ত্রণ কার হাতে। অথচ এই বাজারের ৮০ শতাংশ মুরগি উৎপাদন করে প্রান্তিক খামারিরা এবং ২০ শতাংশ করপোরেট কোম্পানি।
মুরগি ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কোম্পানি থেকে বেঁধে দেওয়া দামের সঙ্গে লাভ যোগ করে ব্রয়লারের দাম নির্ধারণ করেন তারা। কোম্পানি এসএমএস কিংবা ফেসবুক মেসেঞ্জারের মাধ্যমে এই দাম ডিলারদের কাছে পাঠিয়ে দেয়। কোম্পানি এই দাম নির্ধারণ করে চাহিদার ওপর ভিত্তি করে। যেদিন চাহিদা বেশি থাকে, এক ঘণ্টার মধ্যে দাম বেড়ে যায় মুরগির। অথচ এই মুরগির উৎপাদন খরচ তখনও একই ছিল, শুধু লাভ বেড়ে যায়।
মুরগির খামারিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, একদিনের মুরগির বাচ্চা প্রতিদিন উৎপাদন হয় ২০ লাখ। একটি মুরগির বাচ্চা উৎপাদন খরচ ২৮ থেকে ৩০ টাকা। জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে মুরগির বাচ্চা ১০-১৫ টাকায় বিক্রি হয়েছে। গত ৩১ জানুয়ারি থেকে গতকাল পর্যন্ত মুরগির বাচ্চা ৬২ থেকে ৬৮ টাকা দর দিয়ে মেসেজ করলেও প্রকৃতপক্ষে তা বিক্রয় হয়েছে ৮০ থেকে ৮৫ টাকা। প্রকৃত দর অতিরিক্ত হওয়ায় তা মেসেজে লিখে পাঠায় না। এতে ধরা পড়ে যাওয়ার সুযোগ থাকে।
এদিকে বাংলাদেশ পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশন জানিয়েছে, সরকারি তদারকি না থাকায় হরিলুট চলছে পোলট্রি সেক্টরে। প্রতিদিন ব্রয়লার মুরগির চাহিদা ৩ হাজার ৫০০ টন। কিন্তু অস্বাভাবিক দাম ও প্রান্তিক খামারি পর্যায়ে উৎপাদন কমায় এখন দুই থেকে আড়াই হাজার টন সরবরাহ হচ্ছে। প্রান্তিক খামারিদের উৎপাদন খরচ আগে কম থাকলেও এখন প্রতি কেজিতে ১৬০-১৬৫ টাকা এবং করপোরেট কোম্পানিদের উৎপাদন খরচ ১৩০-১৪০ টাকা। কিন্তু পাইকারি পর্যায়ে বিক্রি হয়েছে সর্বোচ্চ ২৩০ টাকা পর্যন্ত।
সংগঠনটি জানিয়েছে, ব্রয়লার মুরগি প্রতি কেজিতে যদি অতিরিক্ত ৬০ টাকা মুনাফা ধরা হয় তবে প্রতিদিন অন্তত ২ হাজার টনে ১২ কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। গত ৩১ জানুয়ারি থেকে গতকাল পর্যন্ত ৫২ দিনে শুধু ব্রয়লার মুরগি থেকে ৬২৪ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে এই সিন্ডিকেট। এ ছাড়া প্রতি বাচ্চায় ৩০ টাকা অতিরিক্ত মুনাফা ধরা হলে আলোচ্য সময়ে মুরগির বাচ্চা বিক্রি থেকে ৩১২ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। ব্রয়লার মুরগি ও বাচ্চা বিক্রি থেকেই ৫২ দিনে ৯৩৬ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে শীর্ষ কয়েকটি করপোরেট প্রতিষ্ঠান।
পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশন জানিয়েছে, পোলট্রি ফিড ও মুরগির বাচ্চা শতভাগ উৎপাদন করে করপোরেট গ্রুপ। তারাই আবার আংশিক ডিম ও মুরগি উৎপাদন করে এবং চুক্তিভিক্তিক খামার করেন। এতে বাজার এসব প্রতিষ্ঠানের দখলে চলে যাচ্ছে।
খামারিরা জানান, করপোরেট প্রতিষ্ঠান মুরগির বাচ্চা উৎপাদন করছে ৩৫ টাকায়। এই বাচ্চাই বিক্রি করার জন্য এসএমএস দিচ্ছে ৬২-৬৮ টাকায়, কিন্তু বিক্রি হচ্ছে ৮০-৮৫ টাকায়। অথচ উৎপাদন খরচ কিন্তু সেই একই। বাচ্চা উৎপাদনের ক্ষেত্রে ৫-৭টি কোম্পানি বাজার সিন্ডিকেট করে রেখেছে বলে দাবি করেন তারা। দামের ক্ষেত্রে সব কোম্পানি সুযোগ নিলেও বড় কোম্পানি দাম কমালে কিংবা বাড়ালে ছোট ছোট কোম্পানিগুলো সেই পথেই হাঁটে। সব ব্যবসায়ী দাম কমানো কিংবা বাড়ানোর ক্ষেত্রে এক করপোরেট গ্রুপের দিকেই তাকিয়ে থাকে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক খামারি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, কয়েকশ’ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে চারটি প্রতিষ্ঠানকে নিয়ে বৈঠক করে দাম কমানো গেলে তাতে বুঝতে হবে বাজার কার নিয়ন্ত্রণে। তাদের দিকে ছোট থেকে মাঝারি ব্যবসায়ীরাও তাকিয়ে থাকে।
বাংলাদেশ পোল্ট্রি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সুমন হাওলাদার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, মুরগির দাম নির্ধারণ করার আগে বাচ্চা এবং ফিডের দাম নির্ধারণ করতে হবে। কারণ, এই বাচ্চাটি এক মাস পর মুরগি হিসেবে পাবেন। আজকে বাজারে যে মুরগি বিক্রি হচ্ছে ২৭০ টাকায়, সেটির বাচ্চার মূল্য ছিল ৬০-৭০ টাকা। এখন বাজারে ৯০ টাকা মূল্যের বাচ্চা উঠছে। তাহলে ৬০ টাকা মূল্যের বাচ্চার খরচ আর ৯০ টাকা মূল্যের বাচ্চার উৎপাদন খরচ কী এক হবে? প্রান্তিক খামারিদের থেকে করপোরেট কোম্পানির উৎপাদন খরচ কম কীভাবে হয়! সরকারের উচিত ছিল তাদের মুরগি উৎপাদন বন্ধ করা। তাদের তো ২০ শতাংশ মুরগি উৎপাদন আর প্রান্তিক খামারিরা বাকি ৮০ শতাংশ উৎপাদন করে। সরকারকে এদিকে নজর দিতে হবে। ১৩০-১৪০ টাকা উৎপাদন খরচে কীভাবে তারা ২৩০-২৪০ টাকায় পাইকারি বিক্রি করে, এরা কি মানুষ! গতকাল ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের ঘোষণা দেওয়ার পর এখন বাজারে দাম কমছে। তাহলে বোঝেন বিষয়টা।
ভোক্তা অধিদফতরের সভায় মহাপরিচালক এ এইচ এম শফিকুজ্জামান বলেন, ঢাকার বাইরের সঙ্গে ঢাকার বাজারের মূল্য ৩০ টাকা ব্যবধান। মুরগি নিয়ে যা চলছে আসলে প্রতিটি ভোক্তা ভুক্তভোগী হচ্ছেন। টাস্কফোর্সের বৈঠকে আমি বলেছিলাম এই বিষয়ে, সেখানে প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাও ছিলেন। তারাও বলছেন মুরগির উৎপাদন খরচ ১৬০-১৭০ টাকা। আমাদের গত ৯ তারিখের বৈঠকের পর ফিডের দাম আরও বেড়ে গেছে। উৎপাদনকারীদের সঙ্গে বৈঠকে তারা বলছে যে ফিডের দাম বাড়ার কারণে এই বৃদ্ধি হয়েছে। আজকের বৈঠকে গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিনিধিরা ছিলেন। তাদের কাছে সব তথ্য আছে, কীভাবে এসএমএস’র মাধ্যমে মুরগি নিলাম হচ্ছে। আমরা এতদিন হস্তক্ষেপ করিনি। জাতির কাছে পরিষ্কার হওয়া উচিত যে এই মুরগি বাবদ অতিরিক্ত ৫০-৬০ টাকা বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে ঢাকার বাজারে। এটি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য না। আমরা চাই পোল্ট্রি ইন্ডাস্ট্রি আরও বিকশিত হোক, সরকার বারবার হস্তক্ষেপ করলে এই শিল্প খারাপের দিকে যেতে পারে। আপনারা ইন্ডাস্ট্রি চালান আমরা সাপোর্ট দেবো, কিন্তু অতিরিক্ত দামে বিক্রি করলে আমরা সহায়তা করতে পারবো না। আমি আহ্বান করেছি অন্তত রমজান মাসে আপনারা একটি অবস্থায় আসেন। আপনারা একটু কম লাভ করেন।
এ সময় কাজী ফার্মসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাজী জাহেদুল হাসান বলেন, আমরা পোল্ট্রি ব্যবসায়ীরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে আমাদের ফার্ম থেকে সরাসরি মুরগি বিক্রি হবে। আমাদের ফার্ম থেকে মুরগি যাওয়ার পর কয়েক হাত বদল হয়, মূল্য বৃদ্ধি হয়। আমরা উৎপাদন বাড়াবো, তাতে দাম একটু কমবে বাজারে। আর এই রমজান মাসে আমরা ১৯০-১৯৫ টাকা কেজি দরে ব্রয়লার মুরগি বিক্রি করবো।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।